ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

উৎপাদন বাড়লে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটবে, পাশাপাশি আমদানি ব্যয় সাশ্রয় হবে

দেশে মসলা উৎপাদনে অপার সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ২৯ এপ্রিল ২০১৮

দেশে মসলা উৎপাদনে অপার সম্ভাবনা

ওয়াজেদ হীরা ॥ খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করে আরও মুখরোচক করে তোলে মসলা। তবে প্রয়োজনীয় চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না মসলার উৎপাদন। অনেক ক্ষেত্রে চাষীদেরও তেমন একটা আগ্রহ নেই মসলা চাষে। এ জন্য বিপুল পরিমাণ মসলা প্রতি বছর আমদানিও করতে হচ্ছে। তবে এবার আমদানি কমাতে এবং দেশের মসলার উৎপাদন বাড়াতে গবেষণার ওপর জোর দিয়েছে সরকার। দেশে মসলার চাষাবাদ বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যেই একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। দেশের নানা প্রান্তে মসলা চাষের অপার সম্ভাবনা থাকলেও নানা কারণে তার প্রসার হয়নি। এবার সরকারের সহযোগিতায় আরও উন্মুক্ত হচ্ছে মসলার উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনার দুয়ার। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন উৎপাদন বাড়ানো হলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আমদানিও কমে যাবে এবং অর্থও সাশ্রয় হবে। মসলা কৃষি পণ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দিন দিন বাড়ছে জনসংখ্যা। আর ক্রমেই কমে যাচ্ছে খাদ্যশস্যের জমি। চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে মসলার জমি চলে এসেছে খাদ্যশস্য চাষের আওতায়। এ কারণে মসলার উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ব্যাপকভাবে। চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে মসলা আমদানি করে এ ঘাটতি পূরণ করা হয়। দেশের কৃষকের মধ্যেও মসলা উৎপাদনে আগ্রহ কমেছে। তুলনামূলক লাভজনক শস্য করার দিকেই ঝোঁক থাকে কৃষকের। প্রধান শস্য উৎপাদনের ফাঁকে উত্তরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে মরিচ ও পেঁয়াজ, আদা চাষ হয়। খোদ রাজধানীর বিভিন্ন বাসার ছাদে উৎপাদন হয় মরিচ। তবে সেটা বাণিজ্যিক না হলেও দেশের অনেক জায়গায় বাণিজ্যিক উৎপাদন হচ্ছে নানা ধরনের মসলার। বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন মসলার দামও পাওয়া যায় ভাল। তবে কৃষকরা অন্যান্য ফসলের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবেই মসলা বেশি চাষ করে থাকেন। নানা প্রচারে কৃষকদের আরও বেশি আগ্রহী করে তোলা গেলে অন্যান্য শস্যের মতো প্রচুর সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যেই সরকার মসলার উৎপাদন বৃদ্ধিতে গবেষণার জন্য ‘বাংলাদেশ মসলা জাতীয় ফসলের গবেষণা জোরদারকরণ’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনও পেয়েছে। জানা গেছে, গৃহীত প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৪ কোটি টাকা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেয়া হবে এই অর্থ। ২০১৭ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২২ সালের ৩০ জুন মেয়াদকালে বাস্তবায়িত হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় দেশের ৬৪টি জেলার ১৯৪টি উপজেলায় এটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) অধীন বগুড়ায় অবস্থিত মসলা গবেষণা কেন্দ্র। ইতোমধ্যে মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান কার্যালয়ের অধীনে তিনটি আঞ্চলিক কেন্দ্র ও পাঁচটি উপকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে এর সুফল দেশবাসী পাবেন বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে গত ২০ বছরে মসলার উৎপাদন আটগুণ বাড়লেও তার সঙ্গে বেড়েছে মসলার চাহিদাও। দেশে সারা বছর ব্যবহৃত মসলার ৬০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। বাকি ৪০ শতাংশ মসলা আমদানি করতে হয়। জানা গেছে, বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় ১৯৯৫ সালে বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ মসলা কেন্দ্রটি নানা গবেষণার মাধ্যমে এখন সফলতার মুখ দেখতে পাচ্ছে। এ গবেষণা কেন্দ্রে জাতের উন্নয়ন, উদ্যানতত্ত্ব, কীটতত্ত্ব, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, উদ্ভিদ প্রজনন, বিভিন্ন মসলা ফসলের ফিজিওলজি, ব্রিডিং পদ্ধতি, জৈব প্রযুক্তি, উদ্ভিদ পুষ্টি, বীজ উৎপাদন, রোগ ও পোকা মাকড় দমন, শস্য সংগ্রহের ব্যবস্থাপনা ও বাজার পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গবেষণার ফলাফল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমে কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয়। গবেষণায় তৈরি জাত বা বীজ বিএডিসির কাছে হস্তান্তর করা হয়। খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, বর্তমান বিশ্বে ১০৯ ধরনের মসলার চাষ করা হলেও বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রায় ৪৪টি মসলা। এর মধ্যে চাষ করা হয় মাত্র ৩৪টি। দেশে ব্যবহৃত মসলার মধ্যে আদা, হলুদ, মরিচ, রসুন, পেঁয়াজ, কালোজিরা, গোলমরিচ, দারচিনি, জাফরান, তেজপাতা, জিরা, জাউন, শলুক, আলুবোখারা, বিলাতি ধনিয়া, ধনিয়া, চিপস, সাদা এলাচ, কালো এলাচ, মেথি, শাহি জিরা, পার্সলে, কাজুবাদাম, পানবিলাস, দইং, কারিপাতা, পাতা পেঁয়াজ, পেস্তাবাদাম, জায়ফল, জয়ত্রি, লবঙ্গ উল্লেখযোগ্য। মসলা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ শফিকুল ইসলাম প্রকল্প বিষয়ে বলেন, আমরা প্রতিনিয়তই কাজ করছি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সেই কাজের আরও বেশি অগ্রগতি হবে। আরও বেশি গবেষণা করা যাবে। কৃষক প্রধান শস্যগুলোর পাশাপাশি মসলা চাষের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করে থাকে। একই সঙ্গে মোট কৃষি অর্থনীতিকেও এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। একনেকের ওই সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, দেশের যেসব জেলায় পেঁয়াজসহ নিত্য প্রয়োজনীয় মসলার চাষ বেশি হয় সেখানকার কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী পেঁয়াজসহ যে সব মসলার চাষ দেশে হয়, সেগুলোর উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলেও মন্ত্রী জানান। বিএআরআই সূত্র জানায়, গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি ও মানসম্মত মসলার বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও আয় বাড়িয়ে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নই এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। এর অংশ হিসেবে মসলা জাতীয় ফসলের টেকসই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। মসলা গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ কেএম খালেকুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, এখন পর্যন্ত মসলা কেন্দ্র ১৬টি মসলার ৩৬টি উন্নতজাত উদ্ভাবন করা হয়েছে যেগুলো মাঠপর্যায়ে চাষ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রসুন, পেঁয়াজ, মেথি, ধনিয়া, মৌরি, গোলমরিচ, কালো জিরা, পান, বিলাতি ধনিয়া ও আলুবোখারার বেশকিছু জাত সফলভাবে উদ্ভাবন করেছে মসলা গবেষণা কেন্দ্র। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এ প্রকল্পের আওতায় নেয়া হবে আরও কিছু উদ্যোগ। এর মধ্যে রয়েছে মসলার নতুন জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্তিকরণ, প্রজনন বীজ উৎপাদন, অঞ্চল ও সমস্যাভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদন প্যাকেজ তৈরি, মসলা ফসলের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য মানসম্পন্ন বীজ বপন, রোপণ, বীজ ও চারা, কলম ইত্যাদি উৎপাদন প্রযুক্তি ও পদ্ধতির উন্নয়ন, সেমিনার ও কনফারেন্স হল, কাভার্ড থ্রেশিং ফ্লোর, গ্রীন হাউস, মিস্ট হাউস, কোল্ড রুম, বিশেষায়িত কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ, মাঠদিবস ও মোটিভেশনাল ট্যুর, স্থানীয় ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষা। বাংলাদেশ মসলা গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে উৎপাদিত মসলার পরিমাণ ৩৫ লাখ টনেরও বেশি। এর পরও ১৪ লাখ টন আমদানি করতে হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪০ থেকে ৪২ শতাংশ মসলার চাহিদা মেটে আমদানির মাধ্যমে। আমদানি মসলার মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে দেশে ২১ হাজার ৬৬২ টন জিরা আমদানি হয়েছিল। যা আগের অর্থবছরে ২০১৫-১৬ এতই সময়ে দেশে ১৭ হাজার ৬৯২ টন জিরা আমদানি হয়েছিল।
×