ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জয়নুবা, পারুল শোনালেন তাদের জয়ের গল্প

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২৯ এপ্রিল ২০১৮

জয়নুবা, পারুল শোনালেন তাদের জয়ের গল্প

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জয়নুবা আক্তার। নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার চকরাজা গ্রামের আবুল জলিলের মেয়ে। তিনি বর্তমানে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চাকরি করছেন। পরিবারের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে জয়নুবা নিজের পড়ালেখা শেষ করলেও তার অনেক সহপাঠী বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে মাধ্যমিকের আগেই ঝরে পড়েছে। জয়নুবা জানান, ‘অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে ৩০ জন সহপাঠীর মধ্যে ২৯ জনের বিয়ে হয়ে যায়। ওই সময়ে যদি আমার বিয়ে হয়ে যেত তাহলে হয়ত আমি আজ এই জায়গায় আসতে পারতাম না। আমার এই অর্জনের পেছনে ‘ব্রতী’ সংগঠনের অবদান অনেক বেশি। আমি যখন নবম শ্রেণীতে পড়ি, তখন আমার গ্রামে ‘ব্রতী’ আসে। তখন তারা আমার পরিবারকে বাল্য বিয়ের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে বুঝিয়েছে। নবম-দশম শ্রেনীতে আমি স্কুলে একাই ক্লাস করেছি।’ গর্বের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের গ্রামে সাড়ে তিন শ’র বেশি পরিবার। তার মধ্যে মেয়ে হয়ে আমি সর্বপ্রথম গ্র্যাজুয়েট হতে পেরেছি। আমি অবাক করে দিয়েছি তাদের, যারা ধারণা করতেন, মেয়েদের দ্বারা কিছু হবে না, কিছু সম্ভব না। মেয়েরা কখনও পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হতে পারে না। এখন আমার বাবা শরীরিক অসুস্থতার কারণে কোন কাজ করতে পারেন না। আমার ছোট দু’টো ভাই বোন আছে। ছোট ভাইটাকে এখন ডিগ্রিতে পড়াশুনা করাচ্ছি। ছোট বোনটাও অনার্সে পড়াশুনা করছে। আমার পরিবারের দায়িত্ব আমি নিয়েছি। আমি দেখিয়ে দিয়েছি।’ বর্তমানে জয়নুবা চকরাজা ব্রতী’তে সহকারী কর্মসূচী সঞ্চালক হিসেবে রয়েছেন। নওগাঁর আরেকজন প্রতিবন্ধী মেয়ে পারুল খাতুন। তার একটি পায়ে সমস্যা। পারুল মান্দা থানার চর শ্যামরায় গ্রামের মোঃ আফসার ম-লের মেয়ে। প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে বাবা মায়ের খুব চাপ ছিল মেয়েকে আগে ভাগে বিয়ে দেয়ার। কিন্তু ব্রতী তাদের বুঝিয়ে পারুলের বিয়ে আটকায়। পারুল এখন অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। শুধু চকরাজা বা চর শ্যামরায় গ্রামটি নয়; রাজশাহী ও নওগাঁর এ রকম এক শ’টি গ্রাম বাল্যবিয়ে মুক্ত করেছে ব্রতী নামের একটি সংস্থা। আর এই কাজে তাদের সহযোগিতা করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। শুধু বাল্য বিয়ে নয়, নিরাপদ পানির জন্য নদীর পানি সুপেয় করার ‘ইকোলোজিক্যাল সার্ফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ করেছে সংস্থাটি। শনিবার সকালে বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রহমান সেমিনার কক্ষে ব্রতী এক জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করে। ‘এগিয়ে চলছে ব্রতী: ‘বাল্যবিয়ে মুক্ত ১০০টি গ্রাম’ এবং ‘নদীর পানি সুপেয়’ করার সাফল্য উপলক্ষে এ সেমিনার করা হয়। এই সেমিনারেই জয়নুবা, পারুল তাদের জয়ের গল্প শোনান। সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রধান সমন্বয়ক (এসডিজি) মোঃ আবুল কালাম আজাদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক রীনা রায়, গবেষক ড. এ এইচ খান। বিটিভির সাবেক মহাপরিচালক ম. হামিদ সভাপতিত্ব করেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ব্রতীর পরিচালক শারমিন মুরশিদ। শারমিন মুরশিদ বলেন, ‘আমরা শুধু বাল্যবিয়ে মুক্ত করেছি, তা কিন্তু নয়। আরও অনেক কিছু মুক্ত করেছি। এই ১০০ গ্রামের মধ্যে ৮৮টি শতভাগ স্যানিটেশন গ্রাম। এক শ’টি গ্রামে ঝরে পড়া শিশুর হার শূন্য। প্রতিটা গ্রামের শতভাগ ছেলে মেয়ে স্কুলগামী। যৌতুক, নারী নির্যাতন ও খোলা জায়গায় ইভটিজিং বলে আমরা যে জিনিসটা জানি তাও নেই। একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গ্রামগুলোয় একটা নীরব পরিবর্তন এসেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাল্যবিয়ে এসডিজির প্রতিটি লক্ষ্য পিছিয়ে দিতে পারে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে তরুণদের মধ্যে যদি পরিবর্তনের হাওয়া লাগিয়ে দেয়া যায় তাহলে উন্নতি হবে এবং আমরা সেটা করতে পেরেছি। বাল্যবিয়ে হলে স্বাস্থ্য খারাপ হয়, অর্থনীতি খারাপ হয়, দারিদ্র বেড়ে যায়। দারিদ্রের কারণে অভিভাবকরা বাল্যবিয়ে দিতে চান। এটা এক ধরনের মানসিকতা। এই জায়গাটা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা বড় কঠিন। কিন্তু আরেকটা সত্য আছে, আমাদের সমস্যার সমাধানগুলো অত্যন্ত সরল, অত্যন্ত সহজ এবং করা খুব সম্ভব। ব্রতীর কাজগুলোকে সাধুবাদ জানিয়ে প্রধান অতিথি মোঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ব্রতী যে কাজ করেছে তা খুবই ভাল কাজ। তাদের এই কাজ দেখে অন্যরাও যাতে উদ্বুদ্ধ হয় আমরা যে বিষয়ে কথা বলব, কাজ করব। তিনি আরও বলেন, ‘দু’দিন আগেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা দেখছি মেয়েদের অগ্রযাত্রা ছেলেদের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভাল। শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে না দেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। ২০২১ সাল উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়া লক্ষ্য। এটাই হচ্ছে দেশ এগিয়ে যাওয়া। বঙ্গবন্ধু যা বলেছেন যার যা আছে তাই নিয়ে তৈরি থাক। তিনি যেটা চিন্তা করেছেন গ্রামে-গঞ্জের সকলকে সম্পৃক্ত করে এগিয়ে যাওয়া। তাহলেই তো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।’ সেমিনারের এক পর্যায়ে তিনি প্রতিবন্ধী পারুলের পায়ের অবস্থা লক্ষ্য করেন। তার পায়ের জন্য এক ধরনের বিশেষ জুতা বানিয়ে দিলে সে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারবে। তাই তিনি অনুষ্ঠানে বসেই পারুলের জুতার ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দেন। রবিবারই তার পায়ের মাপ নিয়ে জুতা বানিয়ে দেয়া হবে। পারুলও হাটতে পারবে স্বাভাবিকভাবে। বিশেষ অতিথি ড. জাফর আহমেদ খান বলেন, এ দেশের জনগণ যদি আমাদের সত্যিকারের শক্তি হয় তাহলে আমরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছি তাতে এক সময় এই উপমহাদেশে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে পরিগণিত হব।’ ‘বাল্য বিয়ের বিশেষ আইনটি বিবেচনার তাগিদ দেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক রীনা রায়। তিনি বলেন, ‘বিশেষ বলতে এখানে নির্দিষ্ট কোন বয়সের কথা বলা হয়নি। তাই এই আইনটির বিষয়ে সরকারকে বিবেচনা করার অনুরোধ জানাই।’
×