ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাত্র ১১ বছর বয়সেই বার্ধক্যের ছাপ, অন্য শিশুরা মিশতে চায় না

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৮ এপ্রিল ২০১৮

মাত্র ১১ বছর বয়সেই বার্ধক্যের ছাপ, অন্য শিশুরা মিশতে চায় না

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ১১ বছরের নিতু অন্য শিশুদের চেয়ে বেশ আলাদা। তাকে দেখলে সমবয়সী শিশুরা রীতিমতো ভয় পেয়ে তার থেকে দূরে চলে যায়। আত্মীয়-স্বজনসহ প্রতিবেশীরাও তাকে দেখলে মুখ লুকায়। পড়ালেখাসহ ছবি আঁকায় দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও সমবয়সী শিশুর সঙ্গে স্কুলে পড়ার সুযোগ সে পায়নি। বাধ্য হয়ে তার পিতামাতা তাকে একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করেছেন। যদিও সে প্রতিবন্ধী নয়। বিচার-বুদ্ধিতে স্বাভাবিক শিশুদের হার মানাবে সে! কি দোষ এই শিশুটির? নিতু বিরল প্রজেরিয়া রোগে আক্রান্ত। হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জনগরের দিনমজুর বাবা কামরুল হাসান, মা জোসনা বেগম ও পাঁচ ভাইবোনের সঙ্গে তার বসবাস। ১১ বছর বয়সী এই শিশু দেখতে অনেকটাই প্রবীণদের মতো। এই বয়সেই সে মাথার চুল হারিয়েছে। ধীরে ধীরে পায়ের নখ পড়ে যাচ্ছে। শরীরের রগগুলো শক্ত হয়ে চামড়ার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে শরীরের চামড়ায় পড়েছে বার্ধক্যের ছাপ। চিকিৎসকরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, এ রোগে আক্রান্তদের গড় আয়ু মাত্র ১৩ থেকে উর্ধে ১৫ বছর। চিকিৎসা বিজ্ঞানের হিসেবে ৪০ লাখ মানুষের মধ্যে এমন রোগাক্রান্ত লোকের সংখ্যা মাত্র একজন। এরই মধ্যে শারীরিক নানা জটিলতায় ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট শিশু নিতু। চোখ দিয়ে, নাক দিয়ে পানি পড়াসহ ঘন ঘন জ্বরে ভুগছে শিশুটি। এরই মধ্যে তার চিকিৎসার খরচ যোগাতে নিঃস্বপ্রায় পরিবারটি। এ রোগের কোন চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই। বৃদ্ধদের মতোই নিতুকে সেবা করতে হবে। ক্রমেই শিশুটির জীবন আয়ু ফুরিয়ে এলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য উন্মুখ পরিবারটি। নিতুর মা জোসনা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, তার বাকি পাঁচ সন্তান সুস্থ-স্বাভাবিক হলেও নিতু এই বিরল রোগে আক্রান্ত। জন্মের পর থেকে ৩ মাস পর্যন্ত দেখতে সুস্থ বাচ্চা মনে হতো। ৩ মাস পর হঠাৎ তার পায়খানা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকেই জ্বরসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। অন্য শিশুদের মতো নিতুও বড় হতে থাকল কিন্তু সে দেখতে বৃদ্ধদের মতো হতে থাকল। তখন থেকে আত্মীয়-স্বজনসহ প্রতিবেশীরা নিতুকে ভাল চোখে দেখে না। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। ওর সঙ্গে সহজে মিশতেও চায় না। নিতুর মা আরও জানান,‘ওর যখন সাত বছর বয়স তখন স্থানীয় হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর পর জানতে পারি নিতু প্রজেরিয়া নামক রোগে আক্রান্ত। এই রোগের কোন চিকিৎসা নেই। যতদিন সে বাঁচবে এভাবেই তাকে বাঁচতে হবে। এজন্য নিতুকে সব সময় আদরযতেœ রাখতে হবে। আক্ষেপ করে এই মা জানান, নিতুকে দেখলে সবাই ভয় পায় এমনকি অনেকেই তাদের বাচ্চাদের থেকে দূরে রাখতে বলেন। মা হয়ে এসব সহ্য করতে না পেয়ে ওকে নিয়ে বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আর এ কারণে মেয়েটিও নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি রাখি আপা নিতুর দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি আমার মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো আদরযতœ করছেন। তার পরিবারের সঙ্গে মিশতে পেরে আমার মেয়েটি এখন কথা বলে, হাসে, খেলে। সম্প্রতি নিতুর দায়িত্ব নিয়েছেন হবিগঞ্জ জেলা মাদক বিরোধী শক্তি সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও নারী সমাজকর্মী চৌধুরী জান্নাত রাখী। মূলত তার কল্যাণেই দেশবাসী জানছে নিতু সম্পর্কে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনিই প্রথম নিতু সম্পর্কে জানিয়ে ছবি পোস্ট করেন। এরপর থেকে তা ভাইরাল হয়েছে। এই সমাজকর্মী জনকণ্ঠকে বলেন, আমার দুই মেয়ের মতো নিতুও আমার আরেকটা মেয়ে। মাত্র একমাস আগেই নিতুর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় একটি অনুষ্ঠানে। সেখানে তার মা নিতুকে নিয়ে এসেছিলেন। লক্ষ্য করে দেখলাম সেখানে উপস্থিত অনেকেই নিতুকে আড়চোখে দেখছেন। আমি স্বভাবতই কাছে গিয়ে নিতুর সঙ্গে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলি এবং পরবর্তীতে তাদের বাড়িতে যাই। এরপর থেকে নিতুর সঙ্গে আমার মা-মেয়ের সখ্য জন্মায়। আমি ফেসবুকে নিতুর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মাঝেমধ্যেই পোস্ট দেই। এভাবেই এখন গণমাধ্যমসহ দেশবাসী জানছে নিতু সম্পর্কে। কিন্তু আফসোস! এতদিন নিতুর কথা নিজ এলাকাবাসীসহ হবিগঞ্জ জেলাও জানত না। একটু আদর-ভালবাসা পেলেই যে এসব রোগী সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করতে পারে তা আমরা অনেকই বুঝতে চেষ্টা করি না। টাকাপয়সা কিংবা জিনিসপত্র নয় বরং ভালবাসা পেলেই এরা খুশী। আচার-আচরণ থেকে শুরু করে লেখাপড়া, খেলাধুলা সবকিছুতেই নিতু স্বাভাবিক শিশুর মতোই। আক্ষেপ করে চৌধুরী জান্নাত রাখি আরও বলেন, আমি প্রায় প্রতিদিন নিতুকে কোলে নিয়ে বাইরে বের হই। রাস্তায় মানুষ দেখে বলে এটা কে? আমি তাদের বলি আমার মেয়ে নিতু। অনেকেই আমাকে কটূক্তি করেছে। আর নিতুও বুঝে কেউ তাকে খারাপ কথা বললে। তখন বলে, ‘আল্লাহ আমাকে নেয় না কেন?’ নিতুর বাড়িতে টিভি নেই। কিন্তু সে টিভি দেখতে পছন্দ করে। সম্প্রতি আমার বোনের ছেলে নিতুকে টিভি কিনে দিয়েছে। বিষয়টি নিয়েও অনেকে বলেছে ‘মরেই তো যাবে, ওকে টিভি কিনে দিয়ে লাভ কি?’ এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় সর্বদা। একটি ছোট্ট শিশুর সঙ্গে আমাদের সমাজ খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি দেখায়! সে রাতটুকু বাদে প্রায় সারাদিনই আমার বাসায় থাকে। আমার মেয়েদের সঙ্গে খেলা করে। ছবি আঁকা, সাজগোজ করাসহ পরিপাটি থাকতে পছন্দ করে নিতু। এই সমাজকর্মীর মতে, একটু ভালবাসা, সহানুভূতি ও মানবিকতার পারে এসব শিশুকে অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখতে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের তথ্যমতে, প্রজেরিয়া মূলত এক ধরনের বিরল জেনেটিক ডিজঅর্ডার। প্রজেরিয়া শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘প্রজেরাস’ থেকে, যার অর্থ অপ্রাপ্তবয়স্ক বৃদ্ধ। ১৮৮৬ সালে সর্বপ্রথম ড. জোনাথন হাচিনসন এবং পরবর্তীতে ১৮৯৭ সালে ড. হেস্টিংস গিলফোর্ড এ রোগ সম্পর্কে ধারণা প্রদান করেন। তাই তাদের নাম অনুসারে একে হাচিনসন-গিলফোর্ড প্রজেরিয়াস সিনড্রমও বলা হয়। এলএমএনএ নামক এক ধরনের জিন শরীরে ল্যামিন-এ নামক প্রোটিন তৈরি করে যা কোষের ভেতরের নিউক্লিয়াসকে ধরে রাখে। এই জিনের মিউটেশনের কারণে যে পরিবর্তিত ল্যামিন-এ প্রোটিন তৈরি হয় তা কোষের নিউক্লিয়াসকে অস্থিতিশীল করে ফেলে। ফলশ্রুতিতে দেহের কোষ খুব দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বয়োবৃদ্ধির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। জিনের মিউটেশনের কারণে প্রজেরিয়া হয়ে থাকলেও এটি মূলত বংশানুক্রমিক বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কোন রোগ নয়। অর্থাৎ সন্তান রোগটি তার মা-বাবার কাছ থেকে পায় না এবং তারা এ রোগের জিনও বহন করেন না। এ রোগে আক্রান্তরা গড়ে সাধারণত ১৩ বছর বেঁচে থাকে এবং প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে হার্ট এ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো সমস্যায় প্রজেরিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। শিশুর জন্মের প্রথম কয়েক মাসের মধ্যে এ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশ পায়। ১৮ থেকে ২৪ মাস বয়সে আরও লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ রোগের লক্ষণ প্রকট হয়ে ধরা দেয়। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের বৃদ্ধি চলতে থাকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে, মাথা শরীরের তুলনায় অনেক বেশি বড় হয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চামড়ায় ভাঁজ পড়তে শুরু“করে। এক কথায়, বেড়ে ওঠার আগেই বুড়িয়ে যেতে থাকেন তারা। জিনগত মিউটেশনের কারণে প্রজেরিয়া সৃষ্টি হওয়ায় এ রোগের এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ কার্যকর কোন চিকিৎসা নেই। তবে আশার কথা, এটি অত্যন্ত বিরল রোগ। প্রতি ৪০ লাখ এমনকি ৮০ লাখ শিশুর মধ্যে ১ জন শিশুর এ রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে, ২০১২ সালের মে মাসে মাগুরা মাতৃসদন হাসপাতালে বিরল প্রজেরিয়ায় আক্রন্ত শিশু বায়েজিদের জন্ম হয়। তখন থেকেই সে দেখতে বৃদ্ধ মানুষের মতো। বায়েজিদকে দেখে সবাই ভয় পেত। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বায়েজিদের শরীরে বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট হতে থাকে। জন্মের তিন মাসের মধ্যেই তার দাঁত ওঠে। এরপর থেকে নিয়মিত জ্বরসহ প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয় সে। অভাবের সংসারে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তার বাবা-মা নানা জায়গায় বায়েজিদের চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই শিশুটির জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। গত বছর ডিসেম্বরে সে মারা যায়। প্রজেরিয়া নিয়ে বলিউডে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। অমিতাভ বচ্চন, অভিষেক বচ্চন, বিদ্যা বালান প্রমুখ অভিনীত চলচ্চিত্রটির নাম হলো ‘পা’। ২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ ছবিতে অমিতাভ বচ্চনকে অভিষেক বচ্চনের ছেলের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। যদিও বাস্তব জীবনে অমিতাভ বচ্চন হলেন অভিষেক বচ্চনের বাবা। সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করেন প্রজেরিয়া রোগে আক্রান্ত ভারতের মুম্বাইয়ের নিহাল বিটলা। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মারা যান তিনি। নিহাল বিটলা প্রজেরিয়া সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার চালাতেন। প্রজেরিয়া সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তিনি ‘হ্যাটস অন ফর প্রজেরিয়া’ নামে প্রচার চালিয়েছিলেন।
×