ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জীবন্ত আর্কাইভ রাজনীতিক বখতিয়ার কবীর

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ২৮ এপ্রিল ২০১৮

জীবন্ত আর্কাইভ রাজনীতিক বখতিয়ার কবীর

হারানো সব কিছু সংরক্ষণ করাই যেন সৈয়দপুরের বর্ষীয়ান রাজনীতিক আলহাজ বখতিয়ার কবীরের দায়িত্ব। এই আকুতিতে আজ তিনি একজন জীবন্ত আর্কাইভ। এবার নিজে ইতিহাস হয়ে সংরক্ষণের সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ করতে ছুটছেন বাংলা অক্ষরের সঠিক প্রয়োগমাত্রা শেখাতে সৈয়দপুরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারে-দ্বারে। ১৯৪২ সালে ৩১ অক্টোবর সৈয়দপুর শহরের নতুন বাবু পাড়া এলাকায় এক রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম বখতিয়ারের। তার বাবা ডাঃ জিকরুল হক ছিলেন বিখ্যাত চিকিৎসক ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ৯ ভাই বোনের মধ্যে সকলের বড় বখতিয়ার ১৯৬৪ সালে বি কম পাস করে তৎকালীন হাবিব ব্যাংকে কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। দেখেছেন পিতার রাজনৈতীক দর্শন। বাবা ডাঃ জিকরুল হক আওয়ামী লীগের মনোনয়নে যুক্তফ্রন্টে ১৯৫৪ সালে এমএল এ নির্বাচিত হন। পরে বঙ্গবন্ধুর সহচর হওয়ায় ১৯৭০ এর নির্বাচনে এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য) নির্বাচিত হন। পরিবারে বড় সন্তান হওয়ায় কয়েক বছর পর চাকরি ত্যাগ করে বাড়িতে আসেন। যোগ দেন পিতার সঙ্গে। ১৯৬৭ সালে সৈয়দপুর বাংলা হাইস্কুল মাঠে জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বেলিত হয়ে মনোনিবেশ করেন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে। তবে ১৯৭১ এর উর্দুভাষী ও স্থানিয় রাজাকারদের রোষানলে পড়ে তার পরিবারের পিতা ও চাচারা মিলে ৯ জন শহীদ হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ ও ১৯৭৮ সালে পরপর দুইবার সৈয়দপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। চেয়রম্যান থাকাকালে ১৯৭৭ সালে সৈয়দপুর স্টেডিয়াম, টাউনহলসহ ট্রাক টার্মিনালের ভিত্তি স্থাপন করেন। রাজনৈতিক জীবনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে সফরসঙ্গী হয়েছিলেন বর্তমান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ ও প্রয়াত পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের। ১৯৭৬ সালে জয়পুরহাটের পীর সাহেব মোঃ মজিবর রহমানের কাছে এ দুই নেতার আওয়ামী লীগ ভাঙ্গা এবং ত্যাগ না করার শপথেও ছিলেন তিনি। এমনকি শেখ মনির সঙ্গে ছিল বড় ভাই-ছোট ভাই সম্পর্ক। তাই স্থানীয় রাজনীতিতে সৈয়দপুর যুব লীগের দায়িত্ব পালন করেন। সৈয়দপুর পৌরসভার বর্তমান মেয়র আমজাদ হোসেন সরকার বলেন, পৌরসভার সব জমি তিনি কিনেছেন। এমনকি আদর্শ স্কুল ও কলেজ এলাকায় ৭৮ শতক জায়গাও কেনা তার হাতে। এ জনপদের ক্রীড়ায় রয়েছে তার প্রধান স্পর্শ। নবীন-প্রবীণ খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে রেলওয়ে মাঠের প্রতিযোগিতা ক্রীড়াঙ্গন উজ্জীবিত করেছিল। রের নতুন বাবুপাড়ায় বাসভবনে গিয়ে কথা হয় প্রবীণ এ রাজনীতিক, সমাজকর্মী আলহাজ বখতিয়া কবীরের সঙ্গে। তিনি বলেন, খেলাধুলায় ১৯৭৪ সালে ঠাকুরগাঁয়ে মজিদ চ্যালেঞ্জ শীল্ড হয়। সেখানে মীরগড় ফুটবল একাদশের সৈয়দপুরের খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ খেলায় সৈয়দপুরের পক্ষে খেলেছিলেন পাকিস্তান ফুটবল একাদশের পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র খেলোয়াড় রাজশাহীর শামসু (বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলটের বাবা)। যা অনেক নাটকীয়তার পর ড্র হয়। আর পুরো দলটি ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। এ সব স্মৃতি সংরক্ষণে রয়েছে তার। যা তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানো হয়েছিল। এছাড়া চোখের সামনে যখনই কোন ইতিহাস সমৃদ্ধ খবর পেতেন তুলে রেখেছেন নিজের সংগ্রহশালায়। দেখা যায় আলমিরার মধ্যে পলিথিন দিয়ে মোড়ানো প্রায় তিন হাজার পুরনো পত্রিকা। ১৯৭২ সালের দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক বাংলা, দৈনিক আজাদ ও পরবর্তীতে দৈনিক জনকণ্ঠ, প্রথম আলো, মানব কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন। যেগুলো নানা বিচিত্র ঘটনায় সমৃদ্ধ। এর মধ্যে বেদনাবিধূর ১৫ আগস্ট, বিরল উড়ন্ত টিকটিকি, কারণ ছাড়াই বিচিত্র যত বিবাহ বিচ্ছেদ, কুকুরের দাঁতে কেন পোকা ধরে না, বাংলার চিরায়ত রূপ, বাদামী মাছরাঙা, কালা গোরা যুদ্ধ, আংটা ঘর ময়দানে জমি, বাংলার বিনোদন হিরো এবং জোসেফ ফুড়িয়া, পিয়েড়ি সাইমন ল্যাম্পাস, কার্ল ফ্রেডরিখ সাউস, আইজ্যাক নিউটন, লিওনার্দো অরলার এর গণিত বিষয়ক খবরগুলো সযতেœ রেখেছেন। সমাজ সচেতনতায় দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়তে সড়ক আন্দোলন, রাস্তায় ভ্যানে ঝুঁকিপূর্ণ ঢেউটিন বহনে লাল কাপড় বাঁধা, যেখানে-সেখানে পলিথিন না ফেলে পুড়িয়ে দেয়া কর্মকা- পরিচালনা আজও করছেন। এর পাশাপাশি ২০০৭ সাল থেকে সপ্তম পদ্ধতি অনুসরণ করে বাংলা হাতের লেখা সুন্দর করার কৌশল ও অক্ষর বিকৃতি রোধকরণ কাজ করছেন বলে জানান তিনি। সঠিক প্রবাহ, সঠিক আকৃতি, সমশির, সমপদ, সঠিক মাত্রার কাজ করা হচ্ছে প্রতিটি বিদ্যালয়ে। যাতে তারা সুন্দরভাবে বাংলা বানান লিখতে পারে। এতে বিকৃতি থাকবে না শব্দের। প্রমিত সঠিক বাংলা শব্দের ভা-ার নতুনরা সমৃদ্ধ করবে। এ লক্ষ্যেই কাজ করা। এতে ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণী মিলে এক যুগে ২২টি বিদ্যালয়ের প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে উপকরণ সরবরাহ করে লেখা শেখাচ্ছেন। তাই সকলের কাছে একজন জনপ্রিয় শিক্ষকে পরিণত হয়েছেন এ সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ। আর রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সব সফলতার চেয়ে বেশি তৃপ্তি পান স্মৃতি সংরক্ষণ আর সৃষ্টিশীল কিছু করতে। এর মাধ্যমে সমাজ ও দেশের জন্য কিছু অবদান রাখার কাজটি তাই আমৃত্যু চালিয়ে যেতে চান তিনি। এ বিষয়ে নীলফামারী জেলা প্রশাসক খালেদ রহিম বলেন, এ সংরক্ষকের মুক্তি যুদ্ধ ও দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কিত সংবাদের সম্ভার স্থানীয় লাইব্রেরিতে প্রদর্শন করা হলে বর্তমান প্রজন্মরা উপকৃত হবে। -এম আর মহসিন, সৈয়দপুর থেকে
×