ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসির সিয়াম

গল্প ॥ রিনির ফুল বাগান

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২৮ এপ্রিল ২০১৮

গল্প ॥ রিনির ফুল বাগান

অফিস থেকে ফিরেই রিনির বাবা টিভির সামনে বসে খবর দেখতে শুরু করেছেন। বাবার এমন কা- রিনির মোটেও ভাল লাগছে না। সাধারণত সন্ধ্যার পরপরই রিনিকে পড়তে বসায় ওর মা। পড়া শেষ হতে হতে রাত প্রায় নয়টা বেজে যায়। সামনেই ওর স্কুলে পরীক্ষা শুরু হবে। ক্লাস ওয়ান থেকে ফার্স্ট হয়ে টুতে উঠেছে রিনি। এই রেজাল্টটা যেন ধরে রাখতে পারে ও তাই মেয়েকে নিয়ে তার মায়ের এত খাটুনি। পড়া শেষ করে ঘুমানোর আগে এক ঘণ্টা টিভিতে কার্টুন দেখতে দেয় মা ওকে। আর এই সময়টাতেই এসে বাবা খবর দেখতে বসেছেন। একসময় রিনি লক্ষ্য করল খবরে বলা হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বনভূমিতে বৃক্ষ বা গাছপালার পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। অতিরিক্ত গাছপালা কাটার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাতে শুরু করেছে। আর এভাবেই চলতে থাকলে সুস্থভাবে মানুষের বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে। খবরে এমন কথা শুনে রিনির মনে বেশ কৌতূহল জাগল। বাবার কাছে জিজ্ঞাসা করল সে, আচ্ছা বাবা, গাছপালা কাটার সঙ্গে আমাদের বেঁচে থাকার কি সম্পর্ক? ছোট্ট মেয়ের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে বেশ খুশি হলেন বাবা। সত্যিই তো এই বিষয়গুলো সম্পর্কে ছোট থেকেই জানা উচিত সবার। তবেই তো বড় হয়ে খেয়াল খুশিমতো গাছপালা কাটা বা নষ্ট করার কথা কখনও ভাববে না তারা। কারণ, তারা বুঝতে পারবে পরিবেশ রক্ষায় গাছপালা কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মেয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে জবাব দিলেন রিনির বাবা, হ্যাঁ মামণি, গাছপালার সঙ্গে পরিবেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। বলতে পার, গাছপালাই আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে। তাছাড়া বেঁচে থাকার জন্য আমরা যে নাক দিয়ে শ্বাস নেয়ার সময় অক্সিজেন গ্রহণ করি সেটা আমরা গাছপালা থেকেই পাই। গাছপালা না থাকলে প্রকৃতিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবে। আর অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় আমরাও আর তা গ্রহণ করতে পারব না। বাবার কথা শুনে চমকে উঠলো রিনি। বেঁচে থাকার জন্য গাছপালার এত বেশি গুরুত্ব, কিন্তু এরপরও কেন সবাই ইচ্ছেমতো গাছপালা কেটে পরিবেশের ক্ষতি করছে! এতে তো সবাই নিজেদেরই ক্ষতি করছে। মানুষগুলো এত বোকা কেন! এই বোকা বোকা মানুষগুলোর কথা ভেবে রিনির ভীষণ খারাপ লাগছে। সে আর টিভি না দেখে নিজের ঘরে ঘুমাতে চলে গেল। কিন্তু অনেকক্ষণ যাবত আলো নিভিয়ে শুয়ে থাকার পরও ঘুম আসছে না রিনির। সে ভাবতেই পারছে না বোকা বোকা মানুষগুলোর বোকামোর জন্য তারও বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে একসময়। পরেরদিন সকালে স্কুলে গিয়ে রিনি তার ক্লাস টিচার আয়েশা আক্তারকে তার গতরাতের সব কথা খুলে বলল। ছোট্ট একটা মেয়ের পরিবেশ ও নিজেদের সুস্থ জীবন নিয়ে এত সচেতনতা দেখে ম্যাম এক কথায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি মনেমনে ভাবতে শুরু করলেন, ছোট্ট এই মেয়েটা এত সুন্দর করে যে বিষয়টা বুঝতে পারছে, এই একই বিষয়টা যারা গাছপালা নষ্ট করছে তারা বয়সে অনেক বড় হওয়ার পরও বুঝতে পারছে না। যদি বুঝত তাহলে আমাদের পরিবেশ সবসময় নির্মল থাকত। হুট করে ম্যামের মাথায় একটা বুদ্ধি চলে এলো। তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, অনেকেই গাছপালা নষ্ট করে পরিবেশের ক্ষতি করছে ঠিকই, তবে আমরা চাইলেই আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে কিছুটা হলেও সুন্দর রাখতে পারি। ম্যামের কথা শুনে ক্লাসের সবাই একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু কিভাবে, ম্যাম? ম্যাম এবার একটু মুচকি হাসলেন। এরপর বললেন, আচ্ছা ধর আমরা সবাই যদি নিজেদের বাসার সামনে, ছাদের ওপরে বা বারান্দায় টবে করে গাছ লাগাই, তাহলে ভেবে দেখ তো আমাদের সবার বাসায় ছোট হলেও একটা করে বাগান হয়ে যাবে। আর আমরা সবাই যখন এভাবে নিজেদের বাসায় গাছপালার ছোট ছোট বাগান তৈরি করব, তখন কিছুটা হলেও তো গাছপালার পরিমাণ বাড়বে নাকি! নষ্ট হওয়া গাছপালার পরিবর্তে পরিবেশ রক্ষায় অল্প অল্প করে বড় একটা অবদান রাখতে পারবে আমাদের তৈরি করা ছোট ছোট বাগানের সেসব গাছগুলো। তাই না? ম্যামের কথা শুনে সবাই খুব খুশি হলো। সত্যিই তো, এমনটা করলে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা তো অন্তত পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক থাকবে। স্কুল ছুটির পর বাসায় ফিরেই মায়ের কাছে ম্যামের দেয়া বুদ্ধিটার কথা খুলে বলল রিনির। পরিবেশ রক্ষায় মেয়ের এমন আগ্রহ দেখে মাও দারুণ খুশি হলেন। এবার মায়ের কাছে প্রশ্ন করলো রিনি, আচ্ছা মা, এতদিনের ঈদে পাওয়া আমার সব সালামীর টাকাগুলো তোমার কাছে যে রেখেছিলাম, ওগুলো তুমি কোথায় রেখেছ? উত্তরে মা বললেন, সব টাকাই খুব যতœ করে রেখে দিয়েছি রে মা। কেন? -ওগুলো দিয়ে যদি আমি আমাদের বাড়ির ছাদে গাছ কিনে বাগান করি তাহলে কেমন হবে বলতো মা? বিস্ময় কণ্ঠে জবাব দিলেন মা, কিন্তু তুমি না বলেছিলে ঈদের সালামি তে পাওয়া চকচকে নতুন টাকাগুলো দেখলেই তোমার আনন্দ লাগে। ওগুলো কখনও খরচ করবে না! -হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু ওই টাকা দিয়ে যদি গাছ কিনে বাগান তৈরি করে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করতে পারি, তবেই তো আমরা সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারবও। আর এটাই তো আমাদের সবার জন্য বেশি আনন্দের হবে, তাই না মা? -একদম ঠিক বলেছ মামণি। আচ্ছা, আগামীকাল তো শুক্রবার। তোমার বাবার অফিস নেই। আমরা বরং কাল বিকেলে সবাই মিলে গিয়ে একটা নার্সারি থেকে অনেকগুলো গাছ কিনে আনব। আর ছাদের ওপর খুব সুন্দর করে গাছগুলো দিয়ে বাগান সাজিও তুমি। -খুব মজা হবে মা। আমি রোজ বিকেল বেলা গাছগুলোতে পানি দিয়ে আসব। খুব যতœ করে বড় করব গাছগুলোকে। একদমই নস্ট হতে দেব না। রাত কেটে ভোর হলো। বিকেলের দিকে রোদটা খানিক কমে গেলে রিনি ওর বাবা মায়ের সঙ্গে গাছ কিনতে বের হলো। নার্সারিতে গিয়ে পছন্দ মত অনেকগুলো টবে লাগানো গাছ কিনে অবশেষে বাসায় ফিরলো তারা। বাড়ির ছাদটাকে রঙিন রঙিন ফুল আর কিছু ঔষুধিগাছ দিয়ে ভরে তুলল রিনির। কিছুক্ষণের মাঝেই বাগানের ছোট ছোট ফুল গাছগুলোতে ফুটে থাকা ফুলের সুবাসে ভরে উঠল চারপাশটা, চোখে মুখে ঠিক যেন একরাশ স্নিগ্ধতা মেখে নিয়ে বসেছে প্রকৃতি। ২য় বর্ষ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×