ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

ধর্ষণের ছোবল

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ২৭ এপ্রিল ২০১৮

ধর্ষণের ছোবল

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই যৌন নির্যাতনের বিভীষিকার হাত থেকে এখনও আমাদের রেহাই মেলেনি। অধিকন্তু, দিন দিন যৌন নির্যাতনের মাত্রা ও এর ধরন পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এর ফলে ভুক্তভোগী হয়ে অনেকেই মারা যাচ্ছে। তথাপি, যৌন নির্যাতনের হাত থেকে নারী-পুরুষ কারোরই মুক্তি মিলছে না। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে যৌন নির্যাতনের স্বরূপ হিসেবে ধর্ষণের মাত্রাটা মাত্রাতিরিক্ত আকার ধারণ করেছে। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালেও স্বাধীন বাংলাদেশে বিউটিদের ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। এ রকম অসংখ্য ঘটনা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, অধিকাংশই সংবাদমাধ্যমে কিংবা পুলিশের রিপোর্টে আসছে না। এ রকম জঘন্য পরিস্থিতি থেকে রাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসতে হবে নতুবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ঐতিহাসিক অর্জন প্রশ্নের সম্মুখে চলে আসে। একটা সময় পত্রিকার পাতায় সমাজবিরোধী কোনরূপ (সেটা হোক পিটি ক্রাইম কিংবা হোয়াহট কালার ক্রাইম) কর্মকা- দেখলেই আমাদের গা শিউরে উঠত। তবে সম্প্রতি সমাজবিরোধী জঘন্য কর্মকা- ঘটে থাকলেও কেমন যেন ভাবলেশহীন হয়ে পড়েছি আমরা। প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে না যথাযথ। বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, জঘন্য কর্মকা- ঘটছে, তাতে আমার কি? আমি ও আমার পরিবার ভাল থাকলেই হলো, অন্যদের বিপদে এগিয়ে আসার কি দরকার? এভাবে কিন্তু আস্তে আস্তে নিজেদের বিপদ নিজেদের ঘরেই টেনে আনছি। প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের অভাবের কারণে অপরাধীরা বেশি করে সাহস ও উৎসাহ সঞ্চার করছে। এর ফলে একদিন আমি ও আমার পরিবারও এ বিপদের সম্মুখীন যে হবো না তার কোন নিশ্চয়তা নেই আমাদের কাছে। ন্যাশনাল সেন্টার ফর ভিক্টিমস অব ক্রাইম প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, জীবদ্দশায় শতকরা ১৯ ভাগ নারী এবং ২ ভাগ পুরুষ ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকে। যেখানে ৪৪ ভাগ নারী এবং ২৩ ভাগ পুরুষ অন্যান্যভাবে যৌন নির্যাতনের (ধর্ষণ বাদে অন্যান্য নির্যাতন) শিকার হয়ে থাকে। ব্যুরো অব জাস্টিস স্ট্যাটিসটিকসের তথ্যানুযায়ী, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে যৌন নির্যাতনের তথ্য উপাত্তে তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়নি। অর্থাৎ নির্দিষ্ট হারে যৌন নির্যাতন হচ্ছে। তবে যৌন নির্যাতনের শতকরা ৪০ ভাগের কম পুলিশের নিকট অভিযোগ হিসেবে আসে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, নির্যাতনের একটা বড় অংশ অপ্রকাশিত থেকে যায় যার পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণও অপ্রতুল পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশে কেন ধর্ষণ হচ্ছে? ঘটনার প্রেক্ষাপট ও সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে কারণসমূহকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। সমাজে অপরাধী থাকবে এটাই চিরবাস্তবতা। এমন কোন সমাজব্যবস্থা নেই যেখানে অপরাধী এবং অপরাধ নেই। পাশাপাশি অপরাধ ও অপরাধী দমনের জন্যও বিভিন্ন এজেন্সি কাজ করে থাকে। বাংলাদেশেও অপরাধ প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের জন্য সমাজে বসবাসরত জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের যৌথ উদ্যোগে প্রচেষ্টা নেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে; বাংলাদেশে একটার পর একটা লোমহর্ষক ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পরেও দ্রুত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি চালু হচ্ছে। আস্থা হারাচ্ছে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি। জনমনে দেখা দিচ্ছে উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা। তবে আমার মতে; বারংবার ধর্ষণের পেছনে যদি একটি কারণকে মুখ্য হিসেবে দায়ী করা হয় তা হলোÑ বিচারহীনতার সংস্কৃতি। ঘটে যাওয়া এসব ধর্ষণের ধর্ষণকারীদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হতো তাহলে ধর্ষণের মাত্রা কমে আসত নিঃসেন্দহে। তনু হত্যার পরেও বেশ কয়েকটি ধর্ষণের চিত্র দেখা যায়। যদি তনু হত্যার বিচার হতো তাহলে হয়ত পরের ধর্ষণগুলো নাও ঘটতে পারত। কারণ, অপরাধীদের মনে ভয় ঢুকে যেত। কাজেই, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে রাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসতে হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধকে সমাজ থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে না। অন্য একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়, যারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে প্রকারান্তরে ধর্ষিত হওয়ার ক্ষেত্রে ভিক্টিমদেরকেই দায়ী করা হচ্ছে। নারীর পোশাক, নারীর চালচলনকে ধর্ষণের জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে। পোশাকই যদি ধর্ষণের ফ্যাক্ট হয়ে থাকে তাহলে ৫-৬ বছরের বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণ করা হতো না। এ রকম ছুতো কারণ উল্লেখ করে ধর্ষককে আলোচনার বাইরে রাখা হয়। সুতরাং সামাজিক অবকাঠামো ধর্ষণের পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে থাকে। আবার অনেকে সময় এও দেখা যায়, সামাজিক তথা লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই ধর্ষণের ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। ধর্ষিতাকে পরিবার থেকে অভিযোগ করার বিষয়ে নিরুৎসাহ করা হয়। এ বিষয়টিও বারংবার ধর্ষণের জন্য অন্যতম একটি কারণ হিসেবে বিবেচিত। তাই, ধর্ষকের বিরুদ্ধে সকলেই সোচ্চার হতে হবে। অপরাধ বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে জানা যায়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও নারীর ক্ষমতায়নের অপ্রতুলতার কারণে নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। পরিবার এবং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার খুবই স্বল্প বিধায় নানাভাবে নারীদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে এবং ধর্ষণও এর ব্যতিক্রম নয়। কারণ ধর্ষণের মতো বিভৎস কা- ঘটিয়েও অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে দিনের পরদিন। পাশাপাশি আরও জানা যায়, একটি সমাজের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক স্বচ্ছতার উপরেও সমাজে নারীর উপর ব্যক্তিক ও সামষ্টিক আচরণের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। সমাজের এই উপাদানগুলোর মধ্যে অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হলে নারীর উপর নির্যাতন প্রকট আকারে দেখা যায়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ধর্ষণের সংস্কৃতি স্বাধীন বাংলাদেশকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির এত বছর পরেও আমাদের নারীদের কেন ধর্ষণের শিকার হতে হয়? কেন আমরা মানবিক ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র তৈরি করতে পারছি না? এ অবস্থা থেকে যে কোন মূল্যে উত্তরণ ঘটাতে হবে। তা না হলে আমাদের স্বাধীনতা কখনই অর্থবহ হবে না। ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধ থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য সরকারসহ দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্বশীল ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রথমত: নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে, পণ্য হিসেবে নয়। দ্বিতীয়ত: বাচ্চাদের স্কুলিং সম্বন্ধে (কি পড়ানো হচ্ছে, কি পড়ানো উচিত) পরিবারসহ দায়িত্বশীল সবাইকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। তৃতীয়ত: সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে (বাংলার কৃষ্টি, কালচার) দেশপ্রেমের বারিধারায় নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। চতুর্থত: সামাজিক সংগঠনগুলোকে (নাগরিক আন্দোলন, এনজিও এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন) সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিকরণের ক্ষেত্রে সকল মানুষকে একীভূত করতে হবে। পঞ্চমত: সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো ধর্ষণের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। শেষত: ধর্ষককে সামজিকভাবে বয়কট করতে হবে। এ বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ব্যাধি থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত রাখা সম্ভবপর।
×