ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলা নাটকে প্রথম অভিনেত্রী সুকুমারী দত্ত

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ২৭ এপ্রিল ২০১৮

বাংলা নাটকে প্রথম অভিনেত্রী সুকুমারী দত্ত

নারী, তার সম্মান, মর্যাদা, শিক্ষা-দীক্ষা, অধিকার আদায়ে অধিকন্ত ব্যর্থ। অথচ নারী ছাড়া কোন ক্ষেত্র পুরোপুরি প্রস্তুত হয়েছে, কোন অবস্থা সফল সম্পন্ন হয়েছে? এ কথার উত্তর আমাদের জানা থাকলেও দিতে অপারগ তার উত্তর। বিপ্লব, বিদ্রোহ, সংগ্রাম, স্বাধীনতা, সাহিত্য, প্রেম-ভালবাসা, রাজনীতি, ঘর-সংসার, অধিকার-আদায় সবক্ষেত্রে নারী প্রয়োজনীয় সঙ্গী। তেমনি এক হতভাগী নারী সুকুমারী দত্ত যে কিনা নিজেকে ‘হীনজন’ বলে আখ্যা করেছেনÑ তার রচিত ‘অপূর্বসতী’ নাট্যগ্রন্থের উৎসর্গপাতায় লিখেছেন, বঙ্গবিদ্যা-হিতৈষিণী মহারাণী শ্রীমতী স্বর্ণময়ী মহাশয়ের পবিত্র করকমলে নাটকখানি উপহৃত হইল। নিজের নাটকে অভিনয় করেছেন গোলাপী এবং লিখেছেনও তিনিই। নাট্যকলায় পারদর্শিনী এই নারী যে, একটি সামাজিক দলিল রেখে গেছেন তা সত্যিইÑনাট্যাতিহাসের ভূগোলে বড় নির্ণয়ক। প্রথম নারী নাট্যকার, প্রথম নারী অভিনেত্রী হিসেবেও নাট্যাতিহাসে সুবিদিত হয়ে রইলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রথম নারী নাটক প্রণেত্রী এবং প্রথম নারী অভিনেত্রী হিসেবে সুকুমারী দত্ত বাংলা নাট্যজগতে নারী অভিনেত্রীদের পথিকৃৎ হিসেবে ইতিহাস হয়ে আছেন। ইতিহাসের অংশ হিসেবে তার সঙ্গে আছেন জগত্তারিণী, এলোকেশি ও শ্যামা এই চারজন নারী। দেড় শ’ বছর পূর্বে এমনটাই ছিল রীতি যে, তিনি পুরুষ কিন্তু মঞ্চে নারী। দর্শকরা তাই উপভোগ করত। এক শ’ চুয়াল্লিশ বছর আগে এই চার নারীকে দিয়ে স্ত্রী চরিত্র অভিনয় করানো শুরু করে বেঙ্গল থিয়েটার তাদেরই একজন গোলাপ সুন্দরী পরে সুকুমারী দত্ত সেই বীরজায়া যাকে শিক্ষিত-সাহিত্য ভাষায় বাররমণী কিংবা বারাঙ্গনা আর অভদ্র-ইতরভাষায় বেশ্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়। গোলাপ সুন্দরী সুকুমারী দত্তসহ তিনজন বারাঙ্গনা নিয়ে মোট চারজন নারী অভিনেত্রী নিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার চালু হয় ১২৮০ বঙ্গাব্দের ১ ভাদ্র। বারাঙ্গনা নিয়ে থিয়েটার করায় তাদের যথেষ্ট বিদ্রƒপ এমনকি গালাগালি পর্যন্ত সহ্য করতে হয়েছিল। ১৮৭২ সালে ন্যাশনাল থিয়েটার স্থাপিত হলে বাংলা রঙ্গমঞ্চ জগতে তখন থেকে নতুন হাওয়া বইতে শুরু করে। এর পূর্বে নাটকে স্ত্রী ভূমিকায় পুরুষ অভিনেতারাই অভিনয় করতেন। এতে অভিনয়ের স্বাভাবিকতা নষ্ট হতো। মধুসূদন, বিদ্যাসাগর, উপন্দ্রেনাথ দাস স্বাভাবিক অভিনয়ের জন্য অভিনেত্রী নেয়া উচিত কিনা এ বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত অভিনেত্রী গ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু বিদ্যাসাগর অসম্মতি জানিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের অসম্মতির পরেও বেঙ্গল থিয়েটার প্রথম চারজন অভিনেত্রী গ্রহণ করলেন। বলাবাহুল্য ভদ্রঘরের কোন মহিলা তখন অভিনয়ে যোগ দিতে রাজি ছিলেন না তাই অগত্যা এই চারজন বারাঙ্গনা নিয়ে বেঙ্গল থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয়। ১৮৭৩ সালের ১৬ আগস্ট মাইকেল মধুসূদনের সন্তানদের আর্থিক সাহায্যের জন্য বেঙ্গল থিয়েটারে ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের অভিনয় হয়। শর্মিষ্ঠার ভূমিকায় সুকুমারী দত্ত অভিনয় করে প্রশংসা কুড়ান। এরপর ‘মায়া কানন’ এবং ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকেও তিনি অভিনয় করেন। ধীরে ধীরে সুকুমারী গোলাপ দর্শকদের প্রিয় অভিনেত্রী হয়ে ওঠেন। ২২ আগস্ট ১৮৭৪ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরুবিক্রম’ নাটকে তিনি ঐলবিলার ভূমিকায় অভিনয় করেনÑ এই অভিনয় সুকুমারীর জীবনে একটি স্মরণীয় ঘটনা। তাঁর সাফল্য ছিল আশাতীত। সবদিক থেকেই তিনি চারজন অভিনেত্রীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। ২ জানুয়ারি ১৮৭৫ উপন্দ্রেনাথ দাসের ‘শরৎ-সরোজিনী’ নাটকে গোলাপ শরতের বোন সুকুমারীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এই অভিনয়ে তাঁর কৃতিত্ব ছিল অসামান্য। এরপর থেকে গোলাপের নাম পাল্টে সুকুমারী নামেই সুপরিচিত হয়ে উঠলেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস গ্রন্থে’ জানা যায়, ১৮৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর গ্রেট ন্যাশনাল উপন্দ্রেনাথ দাসের ‘সুরেন্দ্র-বিনোদিনী’ নাটক প্রথম অভিনীত হয়। সুকুমারী এই অভিনয়ে বিনোদিনীর অভিনয় করেন।’ সুকুমারী এমারেন্ড থিয়েটারেও নিয়মিত অভিনেত্রী ছিলেন। সুকুমারীর সঙ্গে এই থিয়েটারে অভিনয় করত সুকুমারী, ক্ষেত্রমণি প্রমুখ নারীনাট্যজনরা। এর অল্পকাল পরে, বঙ্কিম চন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে গিরিশচন্দ্র রঙ্গমঞ্চকে প্রাণবন্ত করে রেখেছিলেন। বঙ্কিম চন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী, কপালকু-লা, মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ প্রভৃতি উপন্যাসর নাট্যরূপ ও অভিনয় জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘সুকুমারী দত্তের বিমলা, গিরিজায়ার অভিনয় দেখিয়াÑবঙ্কিম চন্দ্র বলিয়াছিলেন, ‘আজ বিমলা, গিরিজায়াকে জীবন্ত দেখিলাম।’ কপালকু-লায় মতিবিবি সাজতেন সুকুমারী। তার অভিনয় দর্শকচিত্র সর্বদা আকৃষ্ট করত। জ্যোতিরিন্দ্রিনাথ ঠাকুরের ‘অশ্রুমতি’ নাটকে সুকুমারী দত্তের অভিনয় দেখতে বেঙ্গল থিয়েটারই ভাড়া করে নেন ঠাকুরবাড়ির মহিলা ও পুরুষসমেতÑ২৩ সেপ্টেম্বর ১৮৭৯ সালে এই বিশেষ অভিনয় দেখতে যান ঠাকুরবাড়ির সকলে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, এদিন গোলাপীর (সুকমার) অভিনয়ে সকলেই পরিতৃপ্ত হয়েছিল। সুকুমারী দত্ত একাধারে সুঅভিনেত্রীই ছিলেন সুগায়িকাও ছিলেন। অভিনয় করেছেন প্রচুর যদিও তিনি একখান মাত্র নাটকই লিখেছেন- ‘অপূর্বসতী’ এবং তাই বাংলা নাট্যাতিহাসের প্রথম নারী নাট্যকার হিসেবে সুবিদিত হয়ে আছেন। অপূর্বসতী’ নাটক প্রথম প্রকাশিত হয় ১২৮২ বঙ্গাব্দের ৩ শ্রাবণ (১৮৭৫ খ্রিঃ, মূল্য ছিল ১ টাকা)। নাটকে পুরুষ চরিত্র ৮ এবং নারী চরিত্র ১০ জন। এ ছাড়াও আরও আট স্বল্পভাষিক অভিনয় করেছে। ‘অপূর্বসতী’ নাটকের নায়িতা নলিনী বেশ্যা হরমণির মেয়ে। নলিনী স্কুলে পড়ে। বিদ্যাচর্চায় খনিকটা অগ্রসরও হয়েছে। নাটকের আরম্ভে দেখতে পাওয়া যায় নলিনীর মায়ের বেশ্যালয় সম্বন্ধে তার বিরূপতা এবং ঘৃণা। বিদ্যার আশ্চর্য মহিমায় সে বোঝে যে এ নরককু-। কিন্তু তার মা হরমণির বিদ্যাচর্চা নেই বলেই হীন বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। স্ত্রীলোকের লেখাপড়া করা যে অবশ্যকর্তব্য নলিনী সে কথাও দর্শককে জানিয়ে দেয়। নলিনী চায় পবিত্র জীবনযাপন করতে আর মনমতো একটি শিক্ষিত বর। নলিনীর আশা ও স্বপ্ন সত্য হওয়ার প্রধান বাধা তার বৃদ্ধ মা হরমণি। হরমণিও চায় নলিনীর বিয়ে হোক। মেয়ে-জামাই তাকে দেখে-শুনে রাখুক। কারণ বৃদ্ধ হরমণির রোজগার নেই, যৌবন নেই সবপথ বন্ধ। হরিমণির ভাবনা নলিনীকে নিয়ে। নায়ক চন্দ্রকেতুর সামনে নলিনীকে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলে ধরল। উভয়ে প্রেমে পড়লো। হরমণি খুশি। এদিকে মাতাল লম্পট তরুবাবু এবং তার বন্ধু হরমণিকে পঞ্চাশ টাকার মাসোহারায় নলিনীকে চাইলে হরমণি টাকার লোভে নলিনীকে ঠেলে দিল আর এক বেশ্যার ঘরে। চন্দ্রকেতু ও নলিনী দু’জনের চিত্ত তখন চন্দ্র-লিনীময়। হরমণির লোভের কাছে নলিনীর বেশ্যাবৃত্তি বশ্যতা স্বীকারে নায়ক চন্দ্রকেতু মূর্ছান্বিত। নলিনীও চন্দ্রকেতুর বিরহে কেঁদে কেঁদে ওঠে। নলিনী মাকে তিরস্কার করে বলে, অর্থই কি তোমার এত হিতকারী হলো মা, যে তুমি সেই সামান্য অর্থের জন্য আমাকেও যৎপরোনাস্তি যন্ত্রণা দিতে উদ্যত হলে? একসময় হরমণি চন্দ্রকেতুকে তাড়িয়ে দেয়। নলিনী গোপনে চন্দ্রকেতুর কাছে চিঠি পাঠিয়ে সঙ্কেতময় স্থানে মিলিত হওয়ার আকাক্সক্ষা জানায়। সে মোতাবেক চন্দ্রও তার বন্ধু ব্রজেন্দ্র ও নলিনী তিনজনে কাশী রওনা হলো। কাশীতে এরা তিনজন যখন স্থিত হতে যাচ্ছে তখন কৃষ্ণকিশোর বাবু পুলিশ নিয়ে চন্দ্রকেতুকে ধরে নিয়ে চলে যায়। এ দৃশ্য দেখে নলিনী প্রায় উন্মাদের মতো হয়ে বিরহে আত্মহত্যা করে। কিছু দিন বাদে যমুনার তীরে চন্দ্রকেতু যখন বিরহদশায় নলিনীকে খুঁজছে তখন সাধুবেশী ব্রজেন্দ্রের সঙ্গে দেখা হলে তার কাছে সব শুনে চন্দ্রকেতু যমুনায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করল। বজেন্দ্র অপূর্বসতীর ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেও যমুনার জলে বন্ধুর মতোই আত্মহত্যা করল। একসঙ্গে তিনটি আত্মহত্যা রোমাঞ্চকর ব্যাপার। নায়ক চন্দ্রকেতু ও বারাঙ্গনা নায়িকা নলিনীর ব্যর্থপ্রেম ও মৃত্যুর মধ্যে পতিত হওয়ার ভেতর দিয়ে শেষ হয় তাদের ট্র্যাজিক কাহিনী। নলিনীর মা হরমণি শেষাঙ্কে বিলাপ আর আহাজারি করতে থাকে।। নাটকটির বিশেষত্ব হলো বারাঙ্গনার প্রেম এবং বারাঙ্গনার সমাজে স্থান নির্ণয়ের প্রচেষ্টার ইতিহাস। প্রথম মঞ্চায়ন হয় ১৮৭৫ এর ২৩ আগস্ট সুকুমারী দত্তের সাহায্যরজনী উপলক্ষে ‘অপূর্বসতী’ অভিনীত হয় দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটারে। দেবনারায়ণ গুপ্ত বলেছেন, গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য সুকুমারী দত্ত নাটকটি রচনা করেন। সুকুমারী যে নাট্যপ্রিয় বাঙালীর চিত্তে কতটা স্থান অধিকার করেছিলেন এই সাহায্যরজনী তার দৃষ্টান্ত। সুকুমারী মাইকলের সন্তানদের সাহায্যার্থে বেঙ্গল থিয়েটারে ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকে শর্মিষ্ঠার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আর তারই সাহায্যার্থে তারই নাটকের অভিনয়। মোট ৫টি অঙ্কে ১৪টি গর্ভাঙ্ক অর্থাৎ দৃশ্য সমন্বিত ‘অপূর্বসতী’ নাটকটি পরবর্তীতে বিজিতকুমার দত্তের সম্পাদনায় শামল জানার প্রচ্ছদে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি কর্তৃক পুনর্প্রকাশিত হয় এবং প্রথম নাট্য আকাদেমি সংস্করণ ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ এবং পুনর্মুদ্রণ হয় মার্চ ২০১৫। প্রকাশ করেন পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির প্রশাসন আধিকারিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, বর্তমান মূল্য ৫০ টাকা।
×