ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুরাইয়া বেগম

গল্প ॥ গেন্দু মিয়ার স্বপ্ন উড়ান

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ২৭ এপ্রিল ২০১৮

গল্প ॥ গেন্দু মিয়ার স্বপ্ন উড়ান

প্লাস্টিকের বস্তার ওপর বসে ডান পা বাঁ পায়ের ওপর তুলে দিয়ে হাড়জিরজিরে শরীর নিয়ে আরামসে বিড়ি ফুঁকছে গেন্দু মিয়া। গোঁফের দৈর্ঘ্য এসে ছুঁয়েছে দাড়ির গোড়া। ঠোঁট বলতে যে একটা অঙ্গ আছে, এই মানুষটাকে দেখলে তাৎক্ষণিকভাবে বোঝার কোন উপায় নেই। হাঁটুর ওপর ডান কনুই রেখে, গোঁফের ফাঁক দিয়ে মুখগহ্বরের অদৃশ্য গুহায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে বিড়ির পেছনের অংশ। তারপর নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। কিছুক্ষণ পরপর বিড়ির ডগায় জমে যাওয়া ছাইটুকু আবার একই ভঙ্গিতে মুখগহ্বরের গুহায় লুকিয়ে থাকা লকলকে জিহ্বার মধ্যখানে চেপে ধরছে। রাস্তায় ফেলে দেয়া কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল সকাল থেকে খুঁজে খুঁজে জমা করেছে বসে থাকা প্লাস্টিকের বস্তায়। কিছুক্ষণের বিরতি-বিড়ি টানার সঙ্গে চলে আয়েস করে ছাই খাওয়া। শাহবাগ মোড়ের ফুলের দোকান আর জাদুঘরের মাঝখানে সিটি কর্পোরেশন বেশ চওড়া করে আইল্যান্ড বানিয়েছে। সুদৃশ্য আইল্যান্ডের কোণে অনেকটা জায়গাজুড়ে মনোরম স্থাপনার উপর বড় স্ক্রিনের এলসিডি মনিটর। আগে সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি সশব্দে চলত মনিটর। বেশ ক’দিন যাবত বন্ধ আছে। চত্বরের বাকি জায়গাটা হয়ে উঠেছে ভাসমান মানুষদের আড্ডাস্থল। কেউ বা জমিয়ে বিড়ি টানছে, কেউ বা আরাম করে ঘুমিয়ে নিচ্ছে। সকাল থেকে একটা রাজনৈতিক দলের লোকজন ছোট ছোট দলে এসে জমায়েত হচ্ছে জাদুঘরের সামনের রাস্তায়। বিকেল নাগাদ জমে উঠবে এদের আন্দোলন। এখন যে যার মতন সভাস্থল ঘিরে জটলা করছে- পান খাচ্ছে, বিড়ি ফুঁকছে। গেন্দু মিয়া আড়চোখে নজর রাখছে সেদিকে। বিড়ির ছাই খেতে খেতে গেন্দু মিয়া রাস্তা দিয়ে ছুটে চলা গাড়ি, রিক্সা, সাইকেল দেখে। তোবড়ানো শরীরের কিয়দংশ নোংরা কাপড়ে আচ্ছাদিত। পরনের লুঙ্গিটা শেষ কবে পানির ছোঁয়া পেয়েছে- গেন্দু নিজেই মনে করতে পারে না। ময়লায় সয়লাব গায়ের সাদা গেঞ্জিটা গাঢ় বাদামি রং ধারণ করেছে। মাঝে মাঝে লুঙ্গির ভেতর বাঁ হাত ঢুকিয়ে এলোপাতাড়ি চুলকায়। উরুসন্ধিতে বেশ খানিকটাজুড়ে দাদের সংক্রমণ। চুলকানো শেষ করে হাত বের করে এনে তর্জনী চালায় নাকের ভেতর। খুক খুক করে কাশে, থুক করে একদলা থুতু ছুড়ে মারে শূন্যে- যেন নিজের আঙ্গিনায় বসে রোদের ওম নিচ্ছে এমনি ভাব! খেয়ালই করেনি- থুতুর দলা গিয়ে পড়েছে ওর দিকে পিঠ দিয়ে বসে থাকা মর্জিনার শরীরে। একসময় মর্জিনার পটলচেরা চোখের চাউনিতে খান খান হয়ে যেত গেন্দুর বুক। দোহারা গড়নের পুষ্ট শরীরটা যখন কোমড় দুলিয়ে সামনে দিয়ে হেঁটে যেত- লোলুপ চোখে গেন্দু কেবল অদৃশ্য বাসর রচনা করে চলত। গেন্দুর প্রেম প্রেম ভাব দেখে লাস্যময়ী মর্জিনা খুন হয় হেসেই- ওই মিয়া এমন ছুক ছুক কইরা কোন লাভ নেই। এমন কাউয়ার লাহান গতর লইয়া মর্জিনারে স্বপ্ন দেইখো না। তোমার লাহান দশটা মরদ মর্জিনা পকেটে ঢুকায়া রাহে। ফুলের দোকান থেকে ফেলে দেয়া বাসি ফুলের মালা গেঁথে জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে, রিক্সায় বিক্রি করে মর্জিনা। গায়ে এসে থুতু লাগায় হাতের সুঁই-সুতো রেখে তেড়েমেরে কোমরে হাত দিয়ে সোজা এসে দাঁড়ায় গেন্দু মিয়ার সামনে। -ওই মিয়া চোক্ষে দেহ না? কোমনে ছেপ মারো, খবর নাই? আন্ধা কোনহানকার! অগ্নিমূর্তি ধারণ করে মর্জিনা। বিড়িতে সুখটান দিয়ে বিড়ির শেষ ছাইটুকুসহ গোড়াটা মুখে পুরে আরামছে চিবুচ্ছে গেন্দু মিয়া। হঠাৎ মর্জিনার হম্বিতম্বি শুনে তাকায় সেদিকে -কি কইলি? আমি চোক্ষে দেহি না? ওই ছেমরি আবার ক। মর্জিনাকে দেখে পুরনো ক্ষত যেন দগদগে হয়ে ওঠে। কোটরাগত চোখে আগুন ছড়িয়ে বস্তা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় গেন্দু মিয়া। -হারাদিন তো ওই কাম একখানই কর। রাস্তায় রাস্তায় পুরান কাগজ খোঁজন আর মাইসের শৈল্যে ছেপ মারণ। আর কয়দিন পরপর বিয়া করণ! ছোডুলোক একটা! -ওই মাগী, আমি ছোডুলোক আর তুই কোনহানের জমিদার হুনি? হারাদিন তো মাইনসেরে দেহানের লাইগ্যা পচা ফুলের মালা বান্দস আর রাইতে গিয়া রমনা পার্কে গতর বেচস। তোরে আমি বালা কইরা চিনি। তেড়ে মেরে এসে মর্জিনার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে থাকে গেন্দু। মর্জিনার শরীরের গাঁথুনি ভাল, কব্জিতেও বেশ জোর। এক ঝটকায় ভগ্নস্বাস্থ্যের গেন্দু মিয়াকে ঘাসের ওপর ফেলে দেয়। ততক্ষণে ওদের কলহ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উৎসুক লোকজন কেউ বা হাততালি দিচ্ছে, কেউ বা শিস দিচ্ছে ঠোঁটের ফাঁকে আঙ্গুল ঢুকিয়ে আর দুই একজন স্মার্টফোনে ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড করছে। ঘাসের ওপর দোমড়ানো শরীরে উঠে দাঁড়িয়ে আবার এসে মর্জিনার উপর হামলা করার আগেই ছোট্ট একটা ইটের টুকরোতে উষ্ঠা খেয়ে ফের ভূপাতিত হয় গেন্দু মিয়া। হাসির কোলোরল ওঠে উৎসুক জনতার মাঝে। আঁচলে মুখ চেপে খলখল করে হাসে মর্জিনা। এরই মধ্যে জ্যাম লেগে গেছে ফুলের দোকানের সামনের রাস্তায়। টহল পুলিশের ভ্যান থেকে দুজন কনস্টেবল এগিয়ে আসছে আর বিপুল প্রতাপে গেন্দু মিয়া আবারো আক্রমণ করতে যাচ্ছে মর্জিনাকে। -ওই মিয়া, মাইয়্যা মাইনসের লগে মারামারি করতেছো, তুমি ক্যামন পুরুষ মানুষ? শেষে তো জেল জরিমানা হইবো। সরো এইখান থেইক্যা। গেন্দু মিয়াকে থামাবার চেষ্টা করে পুলিশ দুজন। -অরে আমি শিক্ষা দিমু। যদি কোনদিন পাই ... বিষদাঁত ভাইঙ্গা দিমু, ওরে হালায়া ... ... ...! তড়পাতে থাকে গেন্দু মিয়া। - হ হ আইস আমার ধারে। তোর হেই অকর্মা... ... ছিবড়া বানায়া দিমু। হিঃ হিঃ করে হাসতে থাকে মর্জিনা। ততক্ষণে গেন্দুকে চ্যাঙদোলা করে পুলিশ দুজন জাদুঘরের দিকে নিয়ে যায় আর বলতে থাকে তাদের একজন - যাও ঘরে গিয়া ভাত খাও। মাথা ঠাণ্ঠা হইবো। পলাশী বাজার সংলগ্ন রাস্তার উত্তর কোণে ইডেন কলেজের পেছনের দেয়ালের পাশে গেন্দু মিয়ার পলিথিনের ডেরা। দেয়ালের সঙ্গে পেরেক গেঁথে আর ফুটপাথে ইট চাপা দিয়ে পলিথিন দিয়ে তৈরি সংসার। পলাশীর বাজারের বাথরুম থেকে প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করে তেলের ক্যানে আর ড্রেনে সারে প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম। গুটি কয়েক ভাঙা চোরা হাঁড়ি কড়াই, রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া শ্যাওলা জমা তেলের প্লাস্টিকের বোতল, দুটো টিনের থালা একটি স্টিলের গ্লাস তার তৈজসপত্র। ভাঙা একটা ট্রাংকে পুরনো কিছু জামাকাপড়। বস্তিতে থাকতে গেলে বেশ ভাল পরিমাণের ভাড়া গুনতে হয় ভাসমান মানুষদের মাস শেষে। কুড়িয়ে পাওয়া কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল বেঁচে দুই মুঠো ভাতই জোটে না তাতে আবার ভাড়া কোথা থেকে দেবে গেন্দু? এই ফুটপাথে থেকেও ক’দিন পরপরই পুলিশকে বখরা দিতে হয়, নইলে রাতে এসে লাঠিপেটা করে ঢেরাছাড়া করে। আবার কখনও কখনও গেন্দুর স্ত্রী ফজিলাকে নিয়ে যায়। নোংরা কাঁথার বিছানায় তেল চিটচিটে বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে গেন্দুর সপ্তম স্ত্রী ফজিলা। বয়স পঁচিশ কি ত্রিশ বোঝার উপায় নেই। এমনিতে একচোখ কানা সেই ছোট বেলা থেকে তারউপর ক’দিন আগে ড্রেনে পড়ে মেরুদ-ে ব্যথা পেয়েছে। ভাল করে হাঁটতে পারা তো দূরের কথা বসে থাকতেও কষ্ট ফজিলার। ডেরার মধ্যে শুয়ে, বসে থাকে- ইটের চুলায় কাগজ জ্বালিয়ে ভাত ডাল রান্না করে, যদি গেন্দু বাজার করে কিছু আনতে পারে। সকালেই ডাল চাল মিশিয়ে খিচুড়ি রান্না করে এখন ঘুম দিয়েছে। বউকে ঘুমাতে দেখে বিগড়ে যায় গেন্দু। -ওই হারামজাদী! হারাদিন খাওন আর ঘুম! আর কোন কাম নাই তোর? বলেই এলোপাতাড়ি লাথি মারতে থাকে ফজিলার গায়ে। আসলে তরতাজা মর্জিনার হাতে মার খেয়ে গেন্দুর সব রাগ উপচে পড়ে ফজিলার ওপর। ওর পুরুষত্বের দিকে আঙ্গুল তুলেছে মর্জিনা? ছোট্ট বেলায় বায়োস্কোপ দেখা নিয়ে মাতব্বরের ছেলের হাতে মার খেয়ে অ-কোষে চোটের কারণে পুরুষত্ব হারায় গেন্দু মিয়া। বাবা ছিল গ্রামের ছিঁচকে চোর। গেন্দুর মা গেন্দুকে দুই বছরের রেখে মারা যায়। বাপ আবার বিয়ে করে। সৎ মায়ের সংসারে অনাদরে বড় হওয়া গেন্দু রুক্ষ মেজাজের এক মানুষ হতে থাকে। এক মাস হাসপাতালে ভর্তি থেকে গেন্দু যখন একটু সুস্থ হয়ে ওঠে- মাতব্বরের ছেলেকে রড দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে গ্রাম ছাড়ে সে। আর কোনদিন ফিরে যায়নি গ্রামে। এই ঢাকা শহরে কত মানুষের কিল, লাথি খেয়ে বড় হয়েছে তার কোন হিসাব নেই। একটা বিড়ি টানার পয়সাও থাকত না পকেটে। চায়ের দোকানে প্লেট পিরিচ ধোয়ার কাজ করত পেটে ভাতে। চা পান করে লোকজন আয়েস করে বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ত। বিড়ির গন্ধে ওর কেমন নেশা নেশা লাগত! গেন্দু অপেক্ষায় থাকত কখন মানুষটা বিড়ির টুকরোটা ফেলে দেবে। যেই টুকরোটা পাশে ছুড়ে মারত লোকটা- সঙ্গে সঙ্গে সেটি লুফে নিয়ে টান মারত গেন্দু। কেউ কেউ তামাকের অংশটা পুরো টেনে শেষ করত। তখন বিড়ির বাকি অংশটা গেন্দু মুখে পুড়ে চিবিয়ে খেত। সেই থেকে তার বিড়ির ছাই খাবার অভ্যাস। পুরুষত্ব হারিয়েও মনের ক্ষুধা মেটেনি গেন্দুর। তাই তো এক বউ যায় আরেক বউ আসে। বিয়ে করে ছয় মাস সংসার করলেই বউ কারও না কারও হাত ধরে পালিয়ে যায়। শেষমেশ এই ফজিলা জুটেছে। যদিও একচোখ কানা তবুও দেখতে শুনতে বেশ ছিল মেয়েটা। কাঁটাবনের মোড়ে, শাহবাগে- অন্যের বাচ্চা ভাড়া করে এনে বড় লোকদের গাড়ির পাশে হাত পেতে পেতে ভিক্ষা করত। হঠাৎ একদিন ড্রেনে পড়ে গেল, ভেঙ্গে গেল মেরুদণ্ডের হাড়। আকস্মিক হামলায় ধড়মড় করে উঠে বসে ফজিলা। -ওই হারামি, রাস্তার মোড়ে গিয়া বইলেওতো দুইডা টেহা পাস। ঘরে হুইয়া থাকলে কে তোরে টেহা দিবো হুনি? আমি হারাদিন খ্যাইটা মরি আর হ্যায় আরাম করে। বলতে বলতে কিল ঘুষি মারতে থাকে ফজিলার পিঠে। গলা ছেড়ে তারস্বরে চেঁচাতে লাগলো ফজিলা। -ওরে বাবাগো, মাগো, মাইরা ফালাইতে আছে গো। আমি পঙ্গু মানুষ ঘরের থোন বাইর হইতাম পারি না, ভিক্ষা করুম ক্যামনে? -খালি খাইবার পারছ! আর রাইতে ওই পুলিশ ব্যাডাগো ... ...! ওঠ, খাওন দে আমারে। বলেই একটা নোংরা তেলের ক্যানের পানি দিয়ে ফুটপাথে বসে হাতমুখ ধোয় গেন্দু মিয়া। এতটা খারাপ দশা গেন্দু মিয়ার ছিল না। একসময় বেশ সুদিন গেছে তার। শাহবাগে ভালই রোজগার হতো। নানা রাজনৈতিক দল কর্মসূচ নিয়ে এলেই গেন্দু ছিল তার অগ্রভাগে। দিন শেষে দুই আড়াই শ’ পকেটে জমত। সেইবার তো লাগাতার কর্মসূচী- রাস্তা বন্ধ করে মাসের অধিক চলল আন্দোলন। আহা! কি যে ছিল সেইসব দিন। তারমধ্যেই কেউ একজন বুঝিয়ে শুনিয়ে মতিঝিলে নিয়ে গেল। নতুন একসেট পাজামা, পাঞ্জাবি, টুপি পরিয়ে বসিয়ে দিল মতিঝিল শাপলা চত্বরে। ভাল খানাপিনাও জুটেছিল। সেইরাতে পুলিশের এমন মার খেলো গেন্দু মিয়া- সাধের পাজামা পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ফালাফালা। এক মাস বিছানা থেকে উঠতেই পারেনি। এখন আর সেইরকম বড় কর্মসূচীও আসে না আর গেন্দুর ভাগ্যের শিকেও শূন্য পড়ে থাকে। তবুও গেন্দু স্বপ্ন দেখে- আবার উত্তাল হবে শাহবাগ। দুপুরের ভাতঘুম শেষে গেন্দু মিয়া সন্ধ্যার আগে আবারও আসে শাহবাগে। বস্তাটা জায়গামতন আছে দেখে মনটা খুশি হয়ে ওঠে। আবারও গিয়ে বস্তার ওপর বসে। মর্জিনা ততক্ষণে নিজের কাজ গুটিয়ে চলে গেছে। লুঙ্গির কোচর থেকে বিড়ি নিয়ে ম্যাচের আগুনে ধরায়। আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়ে তারপর ছাই গুঁজে দেয় জিহ্বার ডগায়। সামনেই ধবধবে সাদা রঙের মাইক্রোবাসে এক ভদ্রলোক বেনসন টানছে আর নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। লোকটাকে দেখে গেন্দুরও ইচ্ছে করে এমনি একটা গাড়িতে বসে সিগারেট টানতে। ইশ, বেনসনের ছাই খেতে কত নাজানি মজা! কোনদিন সাদা মাইক্রোবাসে চড়েনি সে। মনে মনে ভাবে- নরম নরম গদিআটা গাড়ির সিটগুলো কত আরামের! আহারে গেন্দুর যদি একটা গাড়ি থাকত! অনেকদিন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ শান্ত। বিরোধী দলগুলো কেমন যেন থিতিয়ে পড়েছে। সামনেই নাকি নির্বাচন। হয়ত আবার সরগরম হবে শাহবাগের চত্বর। গেন্দু স্বপ্ন দেখে- এবার টাকা জমিয়ে একটা সাদা গাড়ি সে কিনবেই। সকাল থেকে জমায়েত হওয়া দলটার মধ্যে বেশ উত্তেজনা খেয়াল করে গেন্দু মিয়া। কিছুক্ষণ পরপর সেøাগান দিচ্ছে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে- ‘আমাদের দাবি মানতে হবে, মানতে হবে।’ গেন্দু মিয়া অতশত বোঝে না। কেবল এই লাইনটাই তার মনে থাকে। গেন্দু উৎসুক দৃষ্টিতে অপেক্ষায় থাকে- দল ভারি করার জন্য কখন তার ডাক আসে! শুধু সেই নয়, বস্তি থেকে তারমতন এমন কতশত লোক ধরে নিয়ে আসে রাজনৈতিক মিছিল কিংবা মিটিং এ। হঠাৎ কি থেকে যে কি হয়ে গেল- লাঠিসোটা নিয়ে সভাস্থলে হামলে পড়ে বেশকিছু লোক। মুহূর্তে শুরু হয় মারামারি , দৌড়ঝাঁপ। কেউ কেউ দৌড়ে গিয়ে ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা বাস, প্রাইভেটকার ভাঙতে শুরু করে। ধুমধাম শব্দে শাহবাগের মোড়ে অবস্থিত দোকানের ঝাঁপ পড়তে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় পুলিশের লাঠিপেটা বিক্ষোভরত জনতার মাঝে। ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়তে থাকে। এতক্ষণ গেন্দু মিয়া বেশ উপভোগ করছিল পুরো ঘটনা। পুলিশের ফায়ারিং এ ভড়কে গিয়ে পালাবার জন্য ঠোঁটে বিড়ি নিয়েই দৌড় লাগায় গেন্দু। ছত্রভঙ্গ মানুষদের সঙ্গে দৌড়াচ্ছে সেও। হঠাৎ কোথা থেকে যেন ছুটে আসে তপ্ত বুলেট। গেন্দু মিয়ার পিঠ দিয়ে ঢুকে সোজা হৃদপি-ে ছোট্ট একটা ফুটো করে বেরিয়ে যায় বুক দিয়ে। সভাস্থলের কাছেই পিচঢালা রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে গেন্দু মিয়া। পাশেই ছাইসমেত পড়ে থাকে বিড়ির টুকরোটা। গেন্দু মিয়ার মৃতদেহ এখন আন্দোলনরত জনতার কাঁধে। ধবধবে সাদা কাফনে মোড়ানো গেন্দুর সংগ্রামী শরীর। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত শাহবাগ- ‘পুলিশের চামড়া, খুলে নেব আমরা’ ‘গেন্দু ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’ ‘মরলো কেন গেন্দু ভাই, সরকার তোমার জবাব চাই’ সাদা ঝকঝকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলেছে গেন্দু মিয়ার গ্রামের বাড়িতে। ধবধবে কাফনের ফাঁকে মুচকি হাসে আরেক গেন্দু মিয়া- শেষমেশ চড়তে পারলাম সাদা গাড়িতে ... ...!
×