ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নুরুল করিম নাসিম

হাওয়ায় হাওয়ায় হারিয়ে গেলেন

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ২৭ এপ্রিল ২০১৮

হাওয়ায় হাওয়ায় হারিয়ে গেলেন

জীবিত থাকতে কবি বেলাল চৌধুরী সম্পর্কে আমি এক অক্ষরও লিখিনি। এখন মারা যাওয়ার পর হঠাৎ এত তাড়াহুড়ো করে কেন লিখছি? তার সঙ্গে আমার এমন অসংখ্য স্মৃতি, স্মরণীয় ঘটনা কিংবা আড্ডার টুকরো টুকরো ছবিগুলো জোড়াতালি দিয়ে একটি দায়সারা গোছের লেখা তৈরি করা খুব কঠিন কাজ নয়। সে রকম আমার তেমন কোন ইচ্ছাই ছিল না। তার পরেও এই লেখা কেন? একটা অনুশোচনা, একটা কৃতজ্ঞতাবোধ অনেকদিন ধরে আমাকে অস্থির করে তুলেছিল, আমি কিছুতেই নিস্তার পাচ্ছিলাম না আসলে তাকে যারা অন্তরঙ্গভাবে জানতেন, তাদের মধ্যে অনেকেই বেঁচে নেই। কবি রফিক আজাদ, কবি ও প্রাবন্ধিক আব্দুল মান্নান সৈয়দ, কবি অরুণাভ সরকার, কবি সিকদার আনিমুল হকÑ এঁরা সবাই প্রয়াত। এঁরা ষাট দশকের এক একটি নক্ষত্র। যদিও আমি সত্তর দশকের (এই রকম দশক বিভাজন আমার একেবারেই পছন্দ নয়), বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার বয়সের ব্যবধান এক দশকেরও বেশি, তবুও একটা চমৎকার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার সঙ্গে। আমি গল্প, কবিতা লেখার ফাঁকে ফাঁকে বাইরের কবি ও সাহিত্যিকদের সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখতাম দেশের প্রধানতম বাংলা দৈনিকগুলোতে। শুরু হয়েছিল কবি আহসান হাবিবের প্ররোচনায় সেই সুদূর ১৯৬৯ সালে, তারপর সংবাদের তদানীন্তন সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত আমাকে দিয়ে নিয়মিত বিশ্বসাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ লেখাতেন মাসিক ‘কালি ও কলম’-এ। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণা করলাম এই কারণে যে, এ সময়টায় বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে ধানম-ির এক কফিশপে নিয়মিত আড্ডা হতো, তার হাতে থাকত কোন সাম্প্রতিক প্রকাশিত বিদেশী বইয়ের ফটোকপি। আমার জন্য তিনি সংগ্রহ করে নিয়ে আসতেন। আর আমাকে লিখতে প্ররোচিত করতেন। তিনিও মাঝে মধ্যে লিখতেন। কিন্তু তিনি তখন ‘সচিত্র সন্ধ্যানী’ নিয়ে এতটা ব্যস্ত যে সৃজনশীল লেখার জন্য অতটা সময় দিতে পারতেন না। ১৯৮০ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে আমি যখন বিদেশে চলে যাই দীর্ঘ ছয় বছরের জন্য, সেদিন বিকেলে শাহবাগে তিনি আমি ও কবি রফিক আজাদ সান্ধ্য আড্ডায় মেতে উঠি। এক পর্যায়ে কী এক কারণে তুমুল তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যায় দু’জনে। আমি বিহ্বল। আমি অসহায়। তখন কিভাবে, বিতর্কের সূত্রপাত আমি ঠিক বুঝতে পারি না। শুধু কয়েকটি শব্দ ‘কমিউনিস্ট’ বুর্জোয়া, দালাল আমার কানে বাজতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সব ঠিকঠাক হয়ে যায়। আমার মন ভাল হয়ে যায়। রফিক ভাই তার মোচে তা দিতে থাকেন। বেলাল ভাই ভিএস নাইপলের ‘এ্যামাং দ্য বিলিভারস : এ্যান ইসলামিক জার্নি’ বইটার ফটোকপি আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, প্লেনে বইটা পড়িও। বিদ্যাপ্রকাশ নাইপল আমার অচেনা নন। তার ‘হাউজ অব মি. বিশ্বাস’ আমাদের পাঠ্যসূচীতে ছিল। কিন্তু তার এই বইটি আমি আগে পড়িনি। বেলাল ভাই আমার বিদেশ যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। কবি শামসুর রাহমান কবি রফিক আজাদ এরা কেউ আমার বিদেশ যাওয়ার পক্ষে ছিলেন না। রাহমান ভাই সরাসরি বলেই ফেললেন, ‘টাকা পয়সা হবে, কিন্তু হারাবে অনেক কিছু।’ বেলাল ভাই উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলেন, জীবনে টাকা পয়সার দরকার আছে। আর বিদেশে না গেলে মানব সভ্যতা ও মানবসংস্কৃতির অনেক কিছুই জানা হয়নি। তারপর তিনি একটি বইয়ের তালিকা আমার হাতে তুলে দিলেন। তখন ই-মেইল ছিল না। সেলফোন আসেনি। তার পরও আমি আমার প্রিয় জন্মভূমির সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করিনি। ইনভেলপে তার লেখা পাঠিয়েছি ঢাকার পত্রপত্রিকায়। বেলাল ভাই পড়তেন প্রচুর। সাম্প্রতিকতম কবিতার বই, উপন্যাস-প্রবন্ধ তার কাছে পাওয়া যেত। কলকাতার কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে ঢাকায় এলে তার সঙ্গে চমৎকার সময় কাটত। সেই সব আড্ডায় অনেক সময় সঙ্গতকারণে আমি দীর্ঘ সময় থাকতে পারতাম না। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাকে রাত দশটার আগেই বাড়ি ফিরতে হতো। বাসায় তখন কড়া শাসন। বেলাল ভাইকে নিয়ে তেমন একটা লেখালেখি হয়নি। অসংখ্য লেখক তার হাত দিয়ে তৈরি হয়েছে, কিন্তু এরা পরবর্তী সময়ে তাকে মনে রাখেনি। এ বিষয়ে বেলাল ভাইয়ের কোন অনুশোচনা কিংবা অভিযোগ ছিল না। তিনি এসব ব্যাপারে খুব নির্বিকার ছিলেন। বাইরের সাহিত্যের ওপর যে বিপুল পড়াশোনা তার ছিল, চার ভাগের এক ভাগও তিনি লিখে যাননি। কোন কিছুতেই তিনি স্থির হতে পারেননি। আড্ডায় তার অফুরন্ত সময় চলে যেত। আব্দুল মান্নান সৈয়দ যেমন সময়কে কাজে লাগিয়ে ছিলেন, কবি বেলাল চৌধুরী তা করেননি। আমরা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছি। অনুবাদেও তিনি অনেক কাজ করেছেন। কিন্তু কোন কিছুই ঠিকঠাক গুছিয়ে যেতে পারেননি। পৃথিবীতে এ রকম কিছু সৃজনশীল মানুষ থাকেন, যারা নিজের জন্য সবকিছু গুছিয়ে যেতে পারেন না। তার অসংখ্য অগ্রহিত লেখাগুলো গ্রন্থিত হলে শুধু এ প্রজন্ম নয়, আমরা সবাই উপকৃত ও ঋদ্ধ হব।
×