ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ

প্রদোষে প্রাকৃতজন ॥ বাংলাসাহিত্যের অমর সৃষ্টি

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ২৭ এপ্রিল ২০১৮

প্রদোষে প্রাকৃতজন ॥ বাংলাসাহিত্যের অমর সৃষ্টি

রাজা যখন অর্থব হয়ে যায়, বিলাসবাসনে ডুবে যায় বা প্রজাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন রাজ্যে অনাসৃষ্টি দেখা যায়, কেউ কাউকে পরোয়া করে না, সবাই স্বাধীনতা ভোগ করে এবং সেই অবাধ স্বাধীনতা থেকেই স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম হয়, সামন্ত-মহাসামন্তদের শক্তি দ্বিগুণ হয়, তারা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে নিজেদের শাসন-শোষণ কায়েম করে, যার ফলে প্রজাসাধারণ হয়ে যায় অবাঞ্ছিত, এভাবেই সেন সামাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হয়, শওকত আলী (১৯৩৬) ইতিহাসআশ্রিত সেন বংশের সর্বশেষ রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালকে থিম করে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ (১৯৮৪) উপন্যাসটি রচনা করেন। দ্বাদশ শতাব্দীর একেবারে শেষ দিকে বাংলায় মুসলমানদের আগমন এবং সেই সময়কালটাকে চিহিৃত করে উপন্যাসের কাহিনী বেড়ে উঠেছে, বিভিন্ন চরিত্রের সংমিশ্রণ, কাহিনীর চলমানতা একে গতিশীল করেছে আবার সামাজিক-রাজনৈতিক আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে একেক চরিত্র একেকটি কাহিনীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে একটা শক্ত কাঠামোয় দাঁড় করিয়েছে, সবসময় ইতিহাসের ওই সময়টাকে চরমভাবে যে ইঙ্গিত করেছে তার রূপ দেখতে পাওয়া যায়। পাঠকমাত্র অবগত যে, উপন্যাস হিসেবে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ এক অনন্য সৃষ্টি, অভিনব কল্পনায় বলা যাক, দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্যে বলা যাক বা চরিত্র চিত্রণের ব্যতিক্রমধর্মীতায়—-বিভিন্ন দিক বিবেচনা করলে বাংলাসাহিত্যে উপন্যাসটি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের তাৎপর্যপূর্ণ সংযোজন। বাঙালী বা বাংলাদেশ যেভাবে ওতপ্রেতভাবে জড়িত তা থেকে কাহিনীটি হয়ে উঠেছে অনন্য এক বিস্ময়। বাঙালী বা বাংলাদেশের আদি ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে যেমন সত্য, তেমনি তার একটা বৃহৎ ছবি চিত্রায়িত হয়েছে আখ্যানের সিংহভাগ জুড়ে, মোর্য-পাল বা গুপ্ত যুগে বাঙালী নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত সেভাবে কোনো শোষণের শিকার না হলেও সেনযুগে এসে তাদের সহায়-সম্বল যেমন লুণ্ঠিত হয়েছে, তেমনি মান-ইজ্জতও রেহায় পায়নি, বাঙালীকে কোণঠাসা করে রাখতে চেয়েছে সেই সমাজ, সেই শোষক রাষ্ট্র, তাই তো দেখা যায়, রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে সমাজের ব্রাহ্মণ অর্থাৎ উচ্চতরশ্রেণীর লোকেরা অর্থাৎ সামন্ত-মহাসামন্তরা কিভাবে নিচু শ্রেণীর মানুষের ওপর অত্যাচার করত তা পরিষ্কার দেখানো হয়েছে উপন্যাসের আদ্যপান্তে, তখনকার প্রাকৃতজন কিভাবে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিপর্যস্ত হতো তাও লক্ষ্য করা যায় সুস্পষ্ট। মায়াবতী এবং লীলাবতীর ঘটনা উপন্যাসের কাহিনীকে অন্য মাত্রা দেয়, মায়াবতী শুকদেবের কন্যা, বসন্তদাসের স্ত্রী, পিত্রালয়ে থাকে কারণ স্বামী তার বাণিজ্যে গেছে, গৃহে থাকলে দেহমিলনে ব্যাপক আনন্দ দেয় বাৎসায়ণের কামসূত্রের মতো, আর লীলাবতীর স্বামী অভিমন্যু দাস, যে ফুলশয্যার রাত্রে তার মুখ দু’হাতের অঞ্জলিতে নিয়ে বলছিল, আমার বিশ্বাস হয় না—-আমার বিশ্বাস হয় না। লীলাবতী জানতে চেয়েছিল, কি বিশ্বাস হয় না আপনার। উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়েছিল আর বলেছিল অভিমন্যু, বিবাহে বিশ্বাস হয় না, নারীতে বিশ্বাস হয় না, তোমাকে বিশ্বাস হয় না। লীলাবতী বোঝে একজন বদ্ধ উন্মাদের হাতে তুলে দিয়েছে তার মামা, এ’ বিয়ে আসলে একটা ছেলেখেলা, কারণ অভিমন্যুর মতো মানুষ কখনই স্বাভাবিক থাকতে পারে না, নিজের প্রতি যার বিশ্বাস নেই, সে কিভাবে অপরকে বিশ্বাস কবে! হিংস্র হয়েই সে উপন্যাসের কাহিনীতে ঘুরপাক খেয়েছে, শওকত আলী ‘প্রদোষে প্রাকৃতজনে’ প্রকৃতপক্ষে একজন হিংস্র মানুষের চিত্রাঙ্কন করে উপন্যাসের গতি বা মোড় ঘুরিয়ে সমাজের ভেতরের ঘাপটি মেরে থাকা নরপশুর রূপটাকে তুলে ধরেছেন। প্রদোষে প্রাকৃতজন আশির দশকে প্রকাশ পায়, পটভূমি নিয়েছেন দ্বাদশ শতাব্দীর সেন রাজত্বের বাংলাদেশ, ওই সময়ে রাজত্বে মাৎস্যান্যায় কায়েম হয়েছিল, সেন রাজত্বে কায়েম হয়েছিল ব্রাহ্মণবাদী সংস্কৃতি, বর্ণবাদকে শব্দের মোড়কে যত ভাগ-উপভাগে বিভক্ত করা হোক না কেন, শ্রেণী ছিল দুটো, এক অভিজাত দুই অন্ত্যজ, শুধু মানুষ নয়, ধর্মকর্ম-শিল্পকর্ম সমাজভাগে—-ভাষা ও সাহিত্য-ভাস্কর্য-কবিতা এমন কি মৃৎশিল্প পর্যন্ত অভিজাত ও অনভিজাতে বিভক্ত হয়ে পড়ে, সে সময় সমাজে ‘রৌরব’ নরকের ফতোয়া কঠোর ছিল, বর্ণবাদী বৈষম্য এত প্রকট ছিল যে, মন্দিরে ব্রাহ্মণরা পূজা অর্পণ করত, সে মন্দিরে অন্ত্যজ প্রাকৃতজনরা প্রবেশ করতে পারে না, তাদের সামাজিক মর্যাদা বলে কিছুই ছিল না, সেই সমস্ত অন্ত্যজগোষ্ঠী একটা সময় হিতাহিত ভুলে যায়, নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে, সেন রাজত্বের পতন তখন সাধারণ মানুষের কাম্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই বিশালসংখ্যাক মানুষ অধীর অপেক্ষায় ছিল, তুর্কী মুসলমানরা এসে সেন রাজত্বের পতন ঘটাক অথবা একটা বড় কিছু যুদ্ধ-বিগ্রহ করে তাদের একটা শিক্ষা দিয়ে যাক। পাঠক অবগত আছে, শ্যামাঙ্গ একজন কৃতী মৃৎশিল্পী, যার তুলনা হয় না, কিন্তু সে প্রাকৃতজন, সমাজে ওর সামান্যতম মূল্য নেই, বিশেষ করে ব্রাহ্মণ সামন্তশ্রেণীর কাছে সে অনেকটা অস্পর্শা, তার সৃষ্টিসম্ভার যথেষ্ট শিল্পোত্তীর্ণ-রুচিসম্মত এবং স্বকীয়তায় উজ্জ্বল, তারপরও শাস্ত্রের অনুশাসনে তাকে আবদ্ধ থাকতে হয়, মানতে হয় শাস্ত্রের বিধিবিধান, কারণ ওই একটাই তা হলো, ব্রাত্য বা সাধারণ নিম্নবিত্ত অর্থাৎ শ্রেণীহীন মানুষের জীবনাচারণ বা জীবনচিত্র তার শিল্পেকর্মে প্রতিফলিত হলে তা সামন্তশ্রেণীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এবং এটাই ভবিতব্য বা শাস্ত্রীয় নির্দেশ। কিন্তু রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী মৃৎশিল্পে রূপ দিতে গিয়ে অতিসাধারণ নরনারীর জীবন বা রেখাচিত্র ফুটিয়ে তুলে ফেলেছে শ্যামাঙ্গ, ব্যাধ তরুণীর প্রণয়দৃশ্য-শবর যুবতির প্রতিমা-ধীবর রমণীর স্তন্যদান, এসব চিত্র ধর্মান্ধ সমাজের কাছে কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য ছিল না কখনও, যার কারণে গুরুদেব বসুদেব কঠিন কণ্ঠে বলে, এ হয় না, প্রাসঙ্গিকতার ব্যাপারটি তুমি ছলনাক্রমে আনছো, এ কেমন মুখাবয়ব, এ কেমন মুখভাব বলো? এ মানবিক লালিত্যে কি প্রয়োজন, শ্রীরামচন্দ্রের কি এই মুখাবয়ব হয় কখনো, জানকী আর যক্ষিণী মূর্তিতে যে কোন পার্থক্য নেই, এসব কাজ হবে না, বিনষ্ট করো। কিন্তু আজ্ঞাবাহী দাস শ্যামাঙ্গ কোনভাবে গুরুদেবের নির্দেশ মানতে রাজি নয়, নিজের শিল্পকর্ম সে ভাঙবে না, ফলস্বরূপ প্রতিবাদী শ্যামাঙ্গকে রাজ্য থেকে বের করে দেয়া হয়। বসুদেবও একজন নিষ্ঠাবান শিল্পী, নিজের ভাগ্যের উন্নতির জন্য আজ সে নিষ্ঠাবান গোলামে পরিণত হয়েছেন। ব্রাহ্মণ রাজার আনুকুল্যে থেকে সর্বসাধারণ মানুষ অর্থাৎ নিম্নবিত্ত বা নিম্নবর্ণরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত থেকেছে, নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়েছে আর সামস্ত-মহাসামন্ত ব্রাহ্মণ প্রভূরা ভোগবিলাসে জীবন অতিবাহিত করেছে, রাজার চারপাশে থেকে রামরাজত্ব কায়েম করেছে, লুটপাট-হত্যা-রেপ করে সমাজকে বোঝাতে চেয়েছে, তারাই মহৎ-সর্বসর্বা, অথচ নীচুশ্রেণীর মানুষেরা শুধু অত্যাচার সহ্য করেছে, অত্যাচারিত হয়েছে কিন্তু কোনক্রমে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারেনি, সে বিষ যেন তাদের দখলে, বিষ দিয়ে দেশবাসীকে শাসন করতে চেয়েছে, সমাজ-রাষ্ট্রে যখন এমন অবস্থা, কারো প্রতি কারো মায়া-মমতা ভালবাসা নেই, হিংসা-দ্বেষ সমাজকে কুঁড়ে-কুঁড়ে খাচ্ছে, সবখানে একটা অস্থিরতা, মানুষ শান্তি-শান্তি করে ছুটছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। লীলাবতী প্রতিবাদী চেতনায় অক্ষম অর্থাৎ নপুংশক স্বামী অভিমন্যু দাসের গৃহত্যাগ করে শ্যামাঙ্গের সন্তান গর্ভে ধারণ করে, কিন্তু লীলাবতীর ইচ্ছে পূরণে ধর্মান্ধ সমাজ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, তার ইচ্ছে যবনধর্ম গ্রহণ করার, কারণ সে মানুষের মর্যাদা পেতে চায়, মানুষের মতো বাঁচার ইচ্ছেয় সে উন্মাদ হয়ে ওঠে, এদিকে অভিমন্যু সেনরাজের সৈন্যদলে যোগ দিয়েছে শোনা গেলেও, মূলত সে ছিল গোয়েন্দা, শ্যামাঙ্গ জানতো, অতিশীঘ্রই এদেশে দুর্ধর্ষ এবং হিংস্র যবনজাতি আসছে, ওরা আসলে ব্রাহ্মণ রাজপুরুষ সামন্ত-মহাসামন্তদের মধ্যে যুদ্ধ হবে, সে যুদ্ধে যবনরা জিতবে, তারা ছিলো পরাক্রমশালী, নীতিবান, তাদের ধর্ম উদার, মানুষকে তারা সম্মান দিতে জানে, ভালবাসতে জানে এবং সে কারণে এদেশীয় মানুষরা যবনধর্ম গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়, যবনজাতির জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকে, কারণ তারা নিরাপত্তা দেবে, সমস্ত রকম অত্যাচার-শোষণ থেকে সর্বদা রক্ষা করবে, শ্যামাঙ্গও যবনধর্ম গ্রহণে আগ্রহী, একটা সদিচ্ছা তার ভেতর বহুদিন থেকে বাসা বেঁধে থাকলেও যখন যবনসৈন্যরা যুদ্ধ করতে আসে, তখন সেন রাজার সৈন্যসামন্তবর্গও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এর মধ্যে পড়ে শ্যামাঙ্গ, যদিও প্রচার পায় যবনসৈন্যদের হাতে শ্যামাঙ্গ নিহত হয়। এখানে একটা ধোঁয়াশা উপলব্ধি মাথা তুলে দাঁড়ায়। উপন্যাসের কাহিনী এখানে কেমন তালগোল পাকিয়ে গেছে, একটা দ্বিধাবোধ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, তারপরও চলমানভাবে কাহিনী এগিয়ে গেছে কোথাও বাঁধা না পেয়ে। ইতিহাসের সঙ্গে বাস্তবতা মিলেমিশে চমৎকার দধি হয়েছে বলতেই হয়। শওকত আলী গল্পের যাদুকর, তার হাতে ইতিহাসধর্মী গল্পও প্রাণ ফিরে পেয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকে, গল্পের ভাষায় সেকেলে একটা আবহা বর্তমান থাকলেও কাহিনীর গভীরে যাওয়ার বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না, হয়তো তা শুধুমাত্র শওকত আলীর রচনা বলেই। প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাস সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘শ্রেণীশোষণ’ ‘ধর্মশোষণ’, সামগ্রিক শাসনপীড়িত সময়খন্ডে দাঁড়িয়ে শওকত আলী বাঙালী জাতির ইতিহাসের প্রদোষ লগ্নকে উপন্যাসের উপজীব্য করেছেন। শ্যামাঙ্গ মৃৎশিল্পে লীলাবতীর প্রতিরূপ স্থাপনে তাৎপর হয়েছিল, সেই পুরনো মৃৎশিল্পে হয়তো হতভাগ্য মৃৎশিল্পীর মূর্ত ভালবাসার নিদর্শন পাওয়া যায়। কিন্তু সামন্তবাদীরা তার কানাকড়ি মূল্য দেয়নি, এভাবে তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী শোষণনীতি বহাল রেখেছে, মানুষকে শুধুমাত্র নিপীড়ন-নির্যাতনই করেনি, মনস্তাত্বিকভাবে তাদের হেয় প্রতিপন্ন করেছে, ধর্মের নামে অধর্মের কাজকে সর্বপর্যায়ে উর্ধে রেখে নিজেদের হুকুমজারি করছে, নিম্নশ্রেণীর মানুষদের এভাবে অত্যাচার করলেও তার কোন সমাধান দেশের শাসক দিতে পারেনি, অথচ দেশের শাসক বা রাজা বহাল ছিল, তারা এতখানিই সামন্ত-মহাসামন্তদের ওপর নির্ভরশীল ছিল যে এদিকে দৃষ্টি দেয়ার কোন প্রয়োজন মনে করেনি। ফলে সমগ্র দেশ একটা মহা অবনতির দিকে ধাবিত হতে থাকে। অন্তঃসারশূন্য একটা জাতিতে পরিণত হয় সেন রাজ বংশ। এই সময়টা ছিল বিভীষিকাময় যুগ, উপন্যাসে বারংবার শওকত আলী সেযুগের সমাজচিত্র-সমাজমনস্থতার ছবি তুলে ধরেছেন, এবং সেসময় বিদেশী যবনজাতি তার সুযোগ নিয়েছে যেমন বলা যায়, আবার বলা চলে, বিক্রমশালী যোদ্ধা যবনজাতিকে এদেশীয় অন্ত্যজ অর্থাৎ নিম্নবিত্ত বা নিম্নবর্ণরা সাদরে ডেকে এনে গ্রহণ করেছে তাদের নিজের স্বার্থে, কারণ তুর্কীরা বরাবরই ধনে-মানে যেমন উন্নত তেমনি বুদ্ধিতে যথেষ্ট চৌকষ বলা অপেক্ষা রাখে না। যদিও অনেক পূর্বেই ব্যবসা-বাণিজ্যের বদৌলতে এদেশে যবনদের আগমন ঘটে, এবং তারা এদেশীয় অন্ত্যজ শ্রেণীর পাশাপাশি থেকে তাদের ভেতরের অনেকখানিক জায়গা দখল করে নেয়, বিশ্বাস স্থাপনের একটা সুযোগ পাওয়ার ফলে ভালবাসাও জুটে যায়, যার ফলে অন্ত্যজ শ্রেণী সর্বসময় যবনদের আগমন কামনা করেছে, যবনদের স্বাগত জানাতে মরিয়া হয়েছে, যুদ্ধে তুর্কী যবনদের বিজয় হয়, রাজার যেমন ঠিক তেমনি সামন্ত-মহাসামন্তরা এতটাই বাসন-বিলাসিতায় ডুবে ছিল যে তুর্কীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার সমস্ত ইচ্ছেই হারিয়ে ফেলে, বাংলার আকাশে সেনরাজ বংশের পতনের পতাকা চিরকালের জন্য বিবর্ণ তামাটে হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে, ব্রাহ্মণ সেন রাজা রাজধানী ছেড়ে পূর্ববঙ্গে পলায়ণ করেন। বাংলায় ফিরে আসে শান্তি, শান্তির উদিত সূর্য। কাহিনীর ভেতর যে চমৎকারিত্ব পরিলক্ষিত তাতে উপন্যাসটি একটা মাত্রায় পৌঁছে গেছে বলতেই হয়, উপন্যাসের বিষয়বস্তু যদিও ইতিহাস আশ্রিত তারপরও চমক হচ্ছে আঙ্গিকগত নিরীক্ষার অন্যতম উৎসাহী শওকত আলী, সাহিত্যকে যেভাবে স্বাধীন-প্রাজ্ঞ শিল্পরূপে পরিপূর্ণ ও স্বকীয় বিশিষ্টতায় উজ্জ্বল করেছেন তিনি, জীবনের সঙ্গে সাহিত্যের প্রয়োজনে কখনও আপোস করেননি হয়তো এজন্যই, একজন সফল বা শক্তিশালী সাহিত্যিকই পারে সে সংগ্রামে বিজয়ী হতে, যার ভেতর দিয়ে মানবিক মূল্যবোধ ও শাশ্বত অনুভূতির উন্মেষ ঘটে, তখন তিনি সত্যিকার জীবন ও মানবতার বলিষ্ঠ রূপকার হয়ে নিজেকে তুলে ধরেন। জীবন দর্শনের গভীরতায় নয়, চরিত্র-চিত্রণ-ভাষা বর্ণনা বা বিশ্লেষণে তিনি শিল্পকুশলী এক নান্দনিক কথাশিল্পী, সমাজচেতনা ও মানবিক চেতনা এই দুয়ের সম্মিলিত প্রকাশ তার সৃষ্টিকর্মের সবচেয়ে পরিস্ফুট বৈশিষ্ট্য। তার সামাজিক উপন্যাস বা গল্পেও সহজাত জীবনের চিত্রার্পণ-মধ্যবিত্তের আত্মহুতি-অর্ন্তযন্ত্রণা-মনোবিকোলন সমস্যা কিংবা মিথ বা ঐতিহৃ চেতনা-শ্রেণীদ্বন্দ্ব-প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির দাপট ইত্যাদির চেতনাগত আখ্যান নিরূপণে শওকত আলী এক স্বতন্ত্র আঙ্গিকের জন্ম দিয়েছেন।
×