ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

’৭১-এ পটুয়াখালীর গণহত্যা

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৭ এপ্রিল ২০১৮

’৭১-এ পটুয়াখালীর গণহত্যা

একাত্তরের ২৬ এপ্রিল। পটুয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। এই অঞ্চলের মানুষের কাছে গভীর শোকাবহ দিন, স্বজন হারানোর দিন। একাত্তরের এই দিনে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পটুয়াখালী জেলা শহর দখল করে। শহর দখল করার আগে পাকিসেনারা সকাল থেকে বেছে বেছে জনবহুল এলাকায় বিমানের মাধ্যমে অবিরাম সেলিং ও বোমা বর্ষণ করে। এতে অসংখ্য মানুষ শহীদ হন। পটুয়াখালী শহরের তিনদিকেই লোহালিয়া নদী বেষ্টন করে আছে। শহরের হাজার হাজার মানুষ সেলিং ও বোমার হাত থেকে রক্ষা পেতে নদীতে ঝাঁপ দেয়। কারণ, নদী সাঁতরে ওপারের গ্রামগুলোতে পৌঁছালে মিলবে নিরাপদ আশ্রয়। এ আশাতেই নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোররা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল। কিন্তু, পাকিসেনারা বিমান থেকে নদীতে ঝাঁপ দেয়া নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরদের ওপর অবিরাম গুলি বর্ষণ করে। এতে পুরো লোহালিয়া নদী রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। দূরের গ্রামগুলো থেকে বহু মানুষ দৌড়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়া মানুষদের উদ্ধার করতে ছুটে এসেছিল। কিন্তু তারাও বোমা ও সেলিং থেকে রক্ষা পায়নি। শহরের কেবলমাত্র দক্ষিণ দিকে রয়েছে উন্মুক্ত খোলাপথ। যে পথ দিয়ে ধানক্ষেত মাড়িয়ে দূরের গ্রামগুলোতে পৌঁছানো যায়। বহু মানুষ এ পথ দিয়ে দৌড়ে পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু ২ নম্বর পুলের কাছে বোমা বর্ষণের ফলে পলায়নরত বহু মানুষ শহীদ হন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার বিমান অভিযানে শহরের অসংখ্য মানুষ শহীদ হয়েছিল। একমাত্র যারা একেবারেই নিরূপায় ছিলেন তারাই কেবল সেদিন শহরের বাসাবাড়ি কিংবা অফিস আদালতে লুকিয়ে জীবন বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিকালে হেলিকপ্টার থেকে ছত্রীসেনা নামার পরে তাদের অধিকাংশ জীবন বাঁচাতে পারেননি। একাত্তরের ২৬ এপ্রিলের আগে দেশের সব জেলা পাকিবাহিনী দখল করে নিয়েছিল। কেবলমাত্র মুক্ত ছিল দক্ষিণের সাগরপারের জেলা পটুয়াখালী। সাত মার্চ থেকে শুরু করে ২৬ এপ্রিল সকাল পর্যন্ত পটুয়াখালী ছিল মুক্তিবাহিনীর দখলে। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় পুলিশের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছিল। মুক্তিবাহিনীর প্রধান প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল শহরের মহিলা কলেজে। দালালরা গোপনে পাকিসেনাদের কাছে পটুয়াখালী শহরে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার সমাবেশ ও প্রশিক্ষণের খবর পৌঁছে দেয়। পাকিসেনাদের আরও খবর পৌছে যে, সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা নদীঘেরা পটুয়াখালীতে সংঘবদ্ধ হচ্ছে। এসব খবরের ভিত্তিতে বেলা এগারোটার দিকে আকস্মিকভাবে পাকিসেনারা পটুয়াখালী শহরের ওপর বিমান থেকে সেলিং ও বোমাবর্ষণ শুরু করে। একনাগারে তিন ঘণ্টা ধরে চলে সেলিং ও বোমাবর্ষণ। সেলিং ও বোমাবর্ষণে চারটি স্যাবর জেট বিমান ব্যবহার করা হয়। বিমান থেকে রকেট হামলা ও মেশিনগানের গুলিও বর্ষণ হয়। বিমানের বোমাবর্ষণ বন্ধ হতেই শুরু হয় আরেক নারকীয় তা-ব। পাকিবাহিনীর কর্নেল আতিক মালিক, মেজর ইয়াহিয়া, মেজর তারেক মুহম্মদ, ক্যাপ্টেন হাবিব শাহ, ক্যাপ্টেন আহসান প্রমুখের নেতৃত্বে চারটি হেলিকপ্টার ভর্তি ছত্রীসেনা পটুয়াখালী শহরের ওপর চক্কর দেয়। এর দুটি হেলিকপ্টার অবতরণ করে সরকারী কলেজ গ্রাউন্ডে এবং অপর দুটি অবতরণ করে শহরের পশ্চিম কালিকাপুর মাতবর বাড়ির পাশে। হেলিকপ্টার থেকে নেমেই ছত্রীসেনারা অবিরাম গুলিবর্ষণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। প্রথমেই মাতবর বাড়ির ১৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনীর সহযোগী আনসার বাহিনীর একটি গ্রুপ সরকারী কর্মচারীদের সি-টাইপ কলোনির পাশে অবস্থান নিয়ে পাকিসেনাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। পাকিবাহিনী চারদিক থেকে আনসারদের ঘিরে ফেলে। এখানে আনসারদের প্লাটুন কমান্ডার সৈয়দ আনোয়ার হোসেনসহ ৬ জন আনসার সদস্য শহীদ হন। এরপরই পলায়নরত মানুষদের ছত্রীসেনারা পাখির মতো গুলি করার হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। প্রায় একই সময়ে পটুয়াখালী লঞ্চ টারমিনাল পন্টুনে এসে নোঙ্গর করে চারটি গানবোট। এগুলো থেকেও পাকিসেনারা নেমে নিরীহ মানুষদের হত্যার কিলিং মিশনে অংশ নেয়। সড়ক পথেও বরিশাল থেকে পাকিসেনারা পটুয়াখালীর দিকে এগিয়ে আসে এবং শহর দখল করে। অর্থাৎ ত্রিমুখী আক্রমণের মাধ্যমে পাকিসেনারা সেদিন পটুয়াখালী জেলা শহর দখল করে নিয়েছিল। এদিন শহরের বাসার খাটের তলায় লুকিয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা স্বাধীনতা সংগ্রামী কমরেড হীরালাল দাশগুপ্ত জীবন বাঁচাতে চেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আশি বছরের বৃদ্ধ এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী। পাকিসেনারা তাঁকে খাটের তলা থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। একই সময়ে ব্যবসায়ী মুন্সি এমদাদ আলী, প্রখ্যাত ছাত্রনেতা মোঃ শাহআলম, ব্যবসায়ী শংকর দুয়ারি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ও ক্যাশিয়ারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার অপরাধে সেদিন পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক আবদুল আউয়ালকেও পাকিসেনারা গুলি করেছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেলেও মারাত্মকভাবে আহত হন। ধারণা করা হয়, কেবলমাত্র এই একদিনেই পটুয়াখালী জেলা শহরে কয়েক হাজার মানুষ শহীদ হন। এটি ছিল পটুয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধে হায়েনারূপী পাকিসেনাদের বৃহত্তম গণহত্যা। ২৬ এপ্রিল পাকিসেনাদের পটুয়াখালী দখল এবং পাখির মতো নিরীহ মানুষদের গুলি করে হত্যায় জেলা শহরে বসবাসরত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী বিহারীদেরও ন্যাক্কারজনক ভূমিকা ছিল। ৪৭ সালে দেশ ভাগের পর অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারত থেকে আগত বহু বিহারী পটুয়াখালী জেলা শহরে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কাজে রত ছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে স্থানীয় বাঙালীদের বিরোধিতা করেছে এ সমস্ত বিহারী। তারা সর্বদাই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক শোষকদের সমর্থন দিয়ে আসছিল। তারা বাংলাদেশে বাস করেও মনে প্রাণে ছিল বাঙালী বিদ্বেষী এবং পশ্চিমাদের সমর্থক। যে কারণে একাত্তরের ৭ মার্চের পরে পটুয়াখালী শহরে বসবাসরত বিহারীরা প্রতিবাদী বাঙালী ছাত্র-যুবকদের তীব্র রোষের মুখে পড়ে। গণরোষের মুখ থেকে বিহারীদের রক্ষা করতে এ সময় স্থানীয় প্রবীণ নেতারা এগিয়ে আসেন। তৎকালীন প্রশাসনের সহায়তায় রাজনৈতিক নেতারা বিহারীদের নিরাপত্তা হেফাজতে অর্থাৎ পটুয়াখালী জেলখানায় নিয়ে আটকে রাখে। নিরাপত্তা হেফাজতে আটক শীর্ষস্থানীয় বিহারীর সংখ্যা ছিল ৪০ থেকে ৫০ জন। কিন্তু, ২৬ এপ্রিল পাকিসেনারা পটুয়াখালী দখলে অভিযান শুরু করলে জেলখানায় দায়িত্বরত নিরাপত্তা রক্ষীরা প্রাণ বাঁচাতে ছুটে পালায়। এ সুযোগে বিহারীরা জেলখানার দরজা ভেঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসে। তারা জেলখানার বাইরে এসে পাকিস্তানী পতাকা নিয়ে ‘পাকিস্তান-জিন্দাবাদ’ স্লোগান তুলে পাকিসেনাদের স্বাগত জানায়। বিশেষ করে দুপুরের পরে ছত্রীসেনা মাঠে নামলে বিহারীরা তাদের পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। বিহারীদের এ কাজে তৎকালীন মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা সহায়তা করে। পটুয়াখালী শহরের সবকিছু নখদর্পণে থাকায় পাকিসেনারাও বিহারীদের ব্যবহার করে। বিহারীরা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও হিন্দুদের বাড়িঘর, দোকানপাট পাকিসেনাদের চিনিয়ে দেয়। সুযোগ বুঝে পাকিসেনারাও তা কাজে লাগায়। বিহারীদের সহায়তায় পাকিসেনারা খুঁজে খুঁজে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও হিন্দুদের বাড়িঘরে অভিযান চালায় এবং নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। পাকিসেনারা নির্বিচারে মানুষ হত্যার মাধ্যমে শুধু পটুয়াখালী জেলা শহর দখল নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। বিহারীদের সহায়তায় শহরের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগও করে তারা। সেই সঙ্গে পুরো পটুয়াখালী জেলা শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার জন্য মাঠে নামে। প্রথমেই পাকিসেনারা শহরের পুরানবাজারে অগ্নিসংযোগ করে। সে সময়ে পুরানবাজার ছিল পটুয়াখালী জেলা শহরের ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। জেলার প্রায় সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য পুরানবাজার থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। আর পুরানবাজারের বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন হিন্দু। যে কারণে পাকিসেনারা শুরুতেই পুরানবাজারে অগ্নিসংযোগ করে। ২৬ এপ্রিল বিকাল থেকে শুরু হয় অগ্নিসংযোগ। অনুগত বিহারীরা প্রথমে হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করে। পাকিসেনারা সে মোতাবেক একের পর এক হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পুরো সাতদিন ধরে চলে অগ্নিসংযোগ। দোকানপাট থেকে কেরোসিন ও পেট্রোল বের করে তা দিয়েই দোকানপাট ও বাসাবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হয়। পটুয়াখালী শহরের পুরানবাজারের অগ্নিসংযোগ এতটাই ভয়াবহ ও লেলিহান আকার ধারণ করেছিল যে, ২৫-৩০ মাইল দূরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকেও লোকজন সাতদিন ধরে তা প্রত্যক্ষ করেছিল। পুরানবাজারের তিন থেকে চারশ’ দোকানপাট ও বাসাবাড়ি এভাবে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়েছিল। অগ্নিসংযোগের সঙ্গে সমানে চলে লুটপাট। বিহারী ও পাকিসেনারা অগ্নিসংযোগের আগে প্রায় প্রত্যেকটি দোকানপাট ও বাসাবাড়ির মূল্যবান মালামাল লুট করেছে। এমনকি বহু বাসাবাড়ির মাটির ভিটি খুঁড়েও স্বর্ণালঙ্কারসহ দামী মালামাল লুট করেছে। ২৬ এপ্রিল থেকে শুরু করে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিসেনারা জেলার সর্বত্র নারকীয় ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ ও লুটের রাজত্বে পরিণত করেছিল। এছাড়া পটুয়াখালী-বরগুনা অঞ্চলে যে কয়েকটি টর্চার সেল পাকিস্তানী হানাদার সেনারা চরম নরকে পরিণত করেছিল, তার শীর্ষে ছিল পটুয়াখালী সার্কিট হাউস। একাত্তরের আট ডিসেম্বর পালিয়ে যাওয়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত পাকিসেনারা এ ভবনটি টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করে। সার্কিট হাউসকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহারের পাশপাশি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে কয়েক মাস প্রথমে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেজর নাদের পারভেজ ও পরের কয়েক মাস মেজর ইয়ামিনের বাসভবন ছিল। নির্যাতনের নৃশংসতার দিক থেকে মেজর নাদের পারভেজ এতটাই কুখ্যাত ছিল যে, তার নাম শুনলেই মানুষ আঁতকে উঠত। পটুয়াখালী গণহত্যার এ দিনটি মানুষ আজও স্মরণ করে আঁতকে ওঠেন। স্বজন হারানোর বেদনায় কাঁদেন। লেখক : সাংবাদিক
×