ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চাকরিতে অযোগ্য নয় কেন?

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৭ এপ্রিল ২০১৮

চাকরিতে অযোগ্য নয় কেন?

কী অপরাধ করেছিল বাঙালী জাতি পাকিস্তানী যুগে? চেয়েছিল জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনে, স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। পাকিস্তানী সামরিক ও সামন্ত শাসকরা ছিল পুরোপুরি বাঙালী বিদ্বেষী। বাঙালীকে শাসন-শোষণ নির্যাতনই ছিল তাদের আদর্শ ও লক্ষ্য। অথচ বাঙালীদের আন্দোলনেরই ফসল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র। আর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্বেই দেশভাগ হয়েছে। কিন্তু বাঙালীদের শোষণ-নির্যাতন করা বন্ধ হয়নি, বরং বেড়েছে। ফুঁসে উঠেছিল বাঙালী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আন্দোলন, সংগ্রাম এবং নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ের পথে এগিয়েছিল বাঙালী। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হানাদার হয়ে বাঙালী নিধনে নেমেছিল। আর এ কাজে তাদের সহযোগিতা করেছিল এ দেশেরই কিছু কুলাঙ্গার। শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, আল শাসক, মুজাহিদ বাহিনী নামে বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তোলা হয় বাঙালী নিধনে। গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণসহ এমন কোন মানবতাবিরোধী অপরাধ নেই যা তারা সে সময় করেনি। তাদের অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে এক কোটিরও বেশি মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। আর যারা ছিলেন দেশে তারা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনেছেন। ঘাতকরা যখন খুশি এসে ধরে নিয়ে যেত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। ঘরবাড়ি লুট তো স্বাভাবিক ছিল রাজাকারদের কাছে। বর্বরতা, নৃশংসতা, নির্মমতা জাতীয় সব ঘৃণিত কর্মকা-কেও তারা হার মানিয়েছিল। সেই সব ঘাতক আবার ফিরে আসে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর। শুরু হয় সেই নরপিশাচদের তোষণ-পোষণ। ঘৃণিত অপরাধীদের বসানো হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের মদদ দেয়া হয়। প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে করা হয় শক্তিশালী। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ও তাদের নানাভাবে পুরস্কৃত করা হয়। মন্ত্রী বানিয়ে রক্তমাখা পতাকা ব্যবহার করতে দেয়া হয় যুদ্ধাপরাধীদের ‘দেশ সেবায় বিশেষ অবদান’-এর স্বীকৃতিস্বরূপ। জামায়াতে ইসলামী দলগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। ইসলামী ছাত্রসংঘ (যা পরে শিবির) আল বদর বাহিনী গঠন করে গণহত্যা চালায়। শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নিয়ে হত্যা করে। অথচ যারা জীবনপণ করে দেশমাতৃকার জন্য লড়াই করেছেন তাদের বীরত্বের বিনিময়ে এসেছে স্বাধীনতা। হানাদারদের সহযোগীরা অনেকে স্বাধীনতার পর পালিয়ে যায়। অনেকে কারাগারে আটক ছিল এবং বিচারে শাস্তি হয়েছে। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক জান্তাশাসক জিয়া ক্ষমতা দখলের পরপরই সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তি দেয়। বাতিল করে দালাল আইন। দেশকে পাকিস্তানী ধারায় নিয়ে যায়। তখন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেয়াও ছিল কঠিন। মুক্তিযোদ্ধাদের পদে পদে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী এবং দালালদের উত্তরসূরিরা এই পাকিস্তানী মানসিকতায় ও মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার বিরোধিতায় বেড়ে উঠেছে। রাজাকার, আল বদরদের দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা চালু করেছিলেন অন্যান্য কোটার সঙ্গে। তাদের আত্মত্যাগ এবং সাহসিকতার নিদর্শনস্বরূপ এই ব্যবস্থা চালু দেশবাসী প্রশংসনীয় হিসেবেই মূল্যায়ন করেছে। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সামরিক জান্তা শাসক ও তাদের উত্তরসূরিরা অবহেলা করে। পরবর্তীকালে ২০০১ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আবারও ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ২৯ বছর পরও কোটায় কোন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের চাকরি হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরবর্তী ২৯ বছর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিষ্পেষিত হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা অনেক করুণ ও কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করেছে। সেসব বাকি ইতিহাস। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে এখনও অবধি রাজাকার, আল বদর, যুদ্ধাপরাধী, দালালদের সন্তানরা অর্থবিত্তে বলীয়ান যেমন হয়েছে, তেমনি চাকরি ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে। পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন সেক্টরে তারা তাদের সন্তানদের প্রবেশ ঘটিয়েছে, এমনকি সেনাবাহিনীতেও। প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রবলাধিক্য এখনও পরিলক্ষিত হয়। সরকারী চাকরিতে তাদের অযোগ্য ঘোষণার সময় হয়েছে। এই দাবিও তুলেছেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। স্বাধীনতাবিরোধীদের চাকরি থেকে বহিষ্কার এখন সময়ের দাবি। তাকে উপেক্ষা করা যায় না।
×