ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কোন লক্ষণ নেই মিয়ানমারের

প্রকাশিত: ০৫:০০, ২৭ এপ্রিল ২০১৮

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কোন লক্ষণ নেই মিয়ানমারের

তৌহিদুর রহমান ॥ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নস্যাত করতে বাংলাদেশকে নানাভাবে দোষারোপের চেষ্টা করছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশের গড়িমসি রয়েছে বলে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে তারা। মিয়ানমার প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ থেকে ফেরত গিয়ে সেখানে বিদেশী কূটনীতিকদের নানা ভুল বার্তাও দিয়ে চলেছে। সে কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের আন্তরিকতা নিয়ে নতুন প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উইন মিয়াত আইয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গত ১০-১২ এপ্রিল বাংলাদেশ সফর করে। সে সময় প্রতিনিধি দলের সদস্যরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। একই সঙ্গে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ‘এখানে আসা নাগরিকদের দ্রুত ফিরিয়ে নেয়া হবে। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি’। তবে প্রতিনিধি দল মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে সেখানের বিদেশী কূটনীতিকদের সামনে যে বক্তব্য দিয়েছে, তা নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে উল্টো বক্তব্য দিয়েছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নস্যাত করতে মিয়ানমার শুরু থেকেই নানা অপকৌশল নিয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভুল বার্তা দিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ আন্তরিক নয় বলে দীর্ঘদিন ধরে এমন অভিযোগ করে আসছে মিয়ানমার। এর আগেও মিয়ানমার অভিযোগ করেছে, ত্রাণ সহায়তা পাওয়ার জন্যই বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সঙ্কট জিইয়ে রাখতে চায়। তবে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতায় মিয়ানমারের এসব অভিযোগ ধোপে টেকেনি। মিয়ানমার এর আগে একাধিকবার রোহিঙ্গা সঙ্কটের দায়ভার নানাভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপাতে চাইলেও সেটা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের পক্ষে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমর্থন থাকায় তারা সুবিধা করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয় মিয়ানমার। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তির পরে এই সঙ্কট থেকে উত্তরণ সহজ হবে বলে মনে করেছিল বাংলাদেশ। তবে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে যেভাবে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের দায় বাংলাদেশের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে, সেটা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো তালিকাকে ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ বলে অভিযোগ করেছে। একইভাবে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী ফরম পূরণ করে পাঠানো হয়নি বলে মিয়ানমারের অভিযোগ। এছাড়া অনেক রোহিঙ্গার মাঝে এখনও ফরম বিতরণ হয়নি বলে অভিযোগ করেছে মিয়ানমার। তবে মিয়ানমার এসব অভিযোগ করলেও দেশটির কাছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনেক আগেই ৮ হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গা নাগরিকের তালিকা দেয়া হয়েছে। খুব ভাল করে যাচাই-বাছাই করেই এই তালিকা তাদের কাছে দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে ওই তালিকা থেকে যাচাই-বাছাই করে মাত্র ৭৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে মিয়ানমার। মিয়ানমার অভিযোগ করেছে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল কক্সবাজার সফরকালে রোহিঙ্গাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে রোহিঙ্গারা প্রতিনিধি দলের সদস্যদের জানিয়েছেন, প্রত্যাবাসন চুক্তির বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। এমনকি অনেককেই প্রত্যাবাসন ফরমও দেয়া হয়নি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার বিষয়ে তাদের ইতোমধ্যেই ভালভাবেই অবহিত করা হয়েছে। প্রত্যাবাসন ফরমের বিষয়েও তারা অবহিত। মিয়ানমার যে অভিযোগ করেছে সেটা ভিত্তিহীন বলে মনে করছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ থেকে ফিরে গিয়ে সেখানকার বিদেশী কূটনীতিকদের জানিয়েছে রোহিঙ্গাদের দ্রুত সম্ভব ফিরিয়ে নিতে চায় মিয়ানমার। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়েছে, সেটাও তারা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চায়। তবে মিয়ানমার সেখানের বিদেশী কূটনীতিকদের এসব বললেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে তাদের কোন উদ্যোগ বা তৎপরতা নেই। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সফরকালে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল বর্ষা মৌসুমের আগেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় তারা। কেননা বর্ষা শুরু হলে রোহিঙ্গাদের জন্য শরণার্থী ক্যাম্পে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়বে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢলে নানা ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরাও বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছে। তবে বর্ষা মৌসুম এসে পড়লেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কোন লক্ষণ নেই মিয়ানমারের। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এক হাজার ৬৭৩ রোহিঙ্গা পরিবারের আট হাজার ৩২ জনের তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করেছে। শীঘ্রই আরও প্রায় ১০ হাজার জনের তালিকা দেবে। যদিও প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এখনও কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। উল্লেখ্য, রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত সাড়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারে নিপীড়নের মুখে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা। সেনাবাহিনী অভিযান এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে শরণার্থীদের ফেরত নিতে সম্মত হয় মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের ঘরে ফেরার পথ তৈরি করতে গত ২৩ নবেম্বর নেপিতোয় দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে সেই চুক্তি বাস্তবায়নে মিয়ানমার গড়িমসি করে আসছে।
×