ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেহাই নেই তারেকের ॥ কোন কৌশলই সফল হবে না

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ২৭ এপ্রিল ২০১৮

রেহাই নেই তারেকের ॥ কোন কৌশলই সফল হবে না

বিভাষ বাড়ৈ ॥ আদালতে দন্ডি আসামি হয়ে লন্ডনে বসে বাংলাদেশ পাসপোর্ট এমনকি নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করে সুযোগ নিতে চাইলেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। তারেক রহমানের আপাতত বাংলাদেশের পাসপোর্ট পাওয়ার যেমন কোন সুযোগ নেই তেমনি যদি নাগরিকত্বও বর্জন করেন তবুও তাকে দেশে ফেরাতে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। সরকার এমনকি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, রাজনৈতিক আশ্রয়ই কেবল নয় ব্রিটিশ নাগরিক হলেও বাংলাদেশী নাগরিক থাকা অবস্থাতেই তিনি অপরাধ করেছেন এবং সেই অপরাধের বিচার শেষে রায়ও হয়ে গেছে। ফলে যে বিচার থেকে রক্ষা পেতে তিনি এ কৌশল নিয়েছেন তা সফল হচ্ছে না। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, তারেক রহমান যদি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জনও করে থাকেন, তবুও তাকে দেশে ফেরাতে ‘নাগরিকত্ব বর্জন’ কোন বাধা হবে না। ব্রিটিশ নাগরিক হলেও বাংলাদেশী নাগরিক থাকা অবস্থাতেই তিনি অপরাধ করেছেন এবং সেই অপরাধের বিচার শেষে রায় হয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না থাকলেও তারেক রহমানকে দেশে ফেরাতে কোন প্রতিবন্ধকতা দেখছেন না আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, প্রয়োজনে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বন্দী বিনিময় চুক্তি করা হবে। এ বিষয়ে আলোচনাও চলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন অনেকটা বেকায়দায় পরেই বিএনপির পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে যে তারেক রহমান লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। এটা করতে গিয়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ফেরত দিয়েছেন প্রায় ৫ বছর আগে। এতদিন রাজনৈতিক আশ্রয়ের তথ্য দলটির পক্ষ থেকে গোপন রাখা হয়েছিল মূলত রাজনৈতিকভাবে ক্ষতির কথা চিন্তা করেই। এ কারণে ১০ বছর ধরে দলটির পক্ষ থেকে আদালতেও বলা হয়েছে তারেক রহমান লন্ডনে চিকিৎসাধীন আছেন। এবার বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন বাধ্য হয়েই বিএনপির তরফ থেকে প্রথমবারের মতো জানানো হলো, যে আরও প্রায় পাঁচ বছর আগেই তাদের শীর্ষ নেতা ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠেছে, তারেক রহমানের রাজনৈতিক আশ্রয়ের কথা বিএনপি এতদিন কেন গোপন করেছে? বিশ্লেষকরা রাজনৈতিক ক্ষতিই এ গোপনীয়তার কারন হিসেবে উল্লেখ করলেও বিএনপির পক্ষ থেকে এর পরিষ্কার কোন জবাব মিলছে না। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান বিগত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেফতার হওয়ার পর ২০০৮ সালে জামিনে মুক্ত হয়ে সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে লন্ডনে যান। এরপর থেকে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন চিকিৎসার কথা বলে। ১০ বছর ধরে চিকিৎসা করার ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন সময় এমনকি আদালতে প্রশ্ন উঠলেও বিএনপির পক্ষ থেকে সব সময়েই বলা হয়েছে, সেখানে তাদের নেতা তারেক রহমান চিকিৎসাধীন আছেন। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরবেন। এরই মধ্যে হাইকোর্ট দুই বছর আগে মুদ্রাপাচারের এক মামলায় তারেক রহমানকে পলাতক দেখিয়ে সাত বছরের কারাদন্ড দেয়। আর জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে ১০ বছরের কারাদন্ড দেয় জজ আদালত। ওই মামলাতেই পাঁচ বছরের সাজার রায়ের পর থেকে কারাগারে আছেন তারেক রহমানের মা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমানই পদাধিকার বলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে লন্ডন থেকে দল পরিচালনায় নির্দেশনা দিচ্ছেন। এমনই এক প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার লন্ডনে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দন্ডি আসামি তারেক রহমানকে যেভাবেই হোক দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কথা বলেছি। যে অপরাধী সাজাপ্রাপ্ত, সে কী করে এখানে থাকে? কাজেই তাকে তাড়াতাড়ি ফেরত দেন। এবার বিতর্কের মধ্যে দশ বছর পর প্রথমবারের মতো বিএনপি স্বীকার করেছে তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে আসলে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করেননি। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, যুক্তরাজ্যে পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন তার দলের নেতা। সারেন্ডার বা সমর্পণ করেননি। গত ২১ এপ্রিল পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম যুক্তরাজ্যে জানান, তারেক রহমান তার বাংলাদেশী পাসপোর্ট বর্জন করেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় দুই দিন পর রিজভী সংবাদ সম্মেলন করে সে তথ্য ‘নির্জলা’ মিথ্যা আখ্যা দিয়ে জমা দেয়া পাসপোর্ট প্রদর্শনের চ্যালেঞ্জ দেন। ২৩ এপ্রিল রাতে প্রতিমন্ত্রী তার বাসভবনে সাংবাদিকদের ডেকে তারেক রহমানের ফেরত দেয়া পাসপোর্টের ফটোকপি দেখান। এরপরই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বীকার করে নেন তারেক রহমান পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন। তবে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য। তিনি যুক্তরাজ্যের হোম ডিপার্টমেন্টে পলিটিক্যাল এসাইলামের জন্য তার পাসপোর্টটি জমা দিয়েছেন, সারেন্ডার করেননি। এদিকে সরকার ও বিএনপির এমন চ্যালেঞ্জ ও পাল্টা চ্যালেঞ্জের মধ্যে সামনে চলে আসে কয়েকটি প্রশ্ন। প্রশ্ন ওঠে, যদি রাজনৈতিক আশ্রয়ে সেখানে থাকেন তারেক রহমান তাহলে কি দেশে তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে? বাংলাদেশী পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে যদি রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকেন তাহলে কি বাংলাদেশের বিচারের রায় থেকে তিনি রক্ষা পেতে পারবেন? আইন অনুসারে কি তারেক রহমান রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকলেই তার সুযোগ নিতে পারবেন? এমন সব প্রশ্নের উত্তরই মিলেছে সরকার ও বিশেষজ্ঞদের কথাতেও। তারেক রহমানের আপাতত বাংলাদেশের পাসপোর্ট পাওয়ার কোন সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে ইমিগ্রেশন এ্যান্ড পাসপোর্ট অধিদফতর (ডিআইপি)। আদালতে দন্ডি হওয়ায় পাসপোর্ট আদেশ, ১৯৭৩ অনুযায়ী তিনি বাংলাদেশের পাসপোর্ট পাওয়ার সুযোগ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছে ডিআইপি। অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাসুদ রেজওয়ান অবশ্য জানিয়েছেন, পাসপোর্ট না থাকার সঙ্গে নাগরিকত্ব থাকা না-থাকার কোন সম্পর্ক নেই। তবে তারেক রহমানের হাতে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কোন পাসপোর্ট নেই। ট্র্যাভেল পাস নিয়ে দেশে ফিরতেও তার কোন বাধা নেই। তবে দন্ডি ও পলাতক আসামি হওয়ায় আপাতত নতুন কোন পাসপোর্ট তিনি পাবেন না। উনি লন্ডনে যে আছেন, পাসপোর্টবিহীন বাংলাদেশী পাসপোর্ট ছাড়া উনি অবস্থান করছেন। যদি নাগরিকত্বও না থাকে তবে কি তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না থাকলেও তারেক রহমানকে দেশে ফেরাতে কোন প্রতিবন্ধকতা দেখছেন না আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এদিকে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, তারেক রহমান যদি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জনও করে থাকেন, তবুও তাকে দেশে ফেরাতে ‘নাগরিকত্ব বর্জন’ কোন বাধা হবে না। ব্রিটিশ নাগরিক হলেও বাংলাদেশী নাগরিক থাকা অবস্থাতেই তিনি অপরাধ করেছেন এবং সেই অপরাধের বিচার শেষে রায় হয়েছে। তিনি আরও বলেন, পাসপোর্ট জমার মাধ্যমে এখন তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জন এবং ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন কিনা তা দেখার বিষয়। তারেক রহমান যদি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, সেক্ষেত্রে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার পদ্ধতির বিষয়ে শফিক আহমেদ বলেন, তিনি কিন্তু এখনও বলেননি তিনি এদেশের নাগরিকত্ব বর্জন করেছেন। তবে তিনি ব্রিটিশ নাগরিক হলেও বাংলাদেশী নাগরিক থাকা অবস্থাতেই অপরাধ করেছেন এবং সে অপরাধে বিচার হয়ে রায় হয়েছে। এখন বাংলাদেশ সরকার চাইলে বন্দী বিনিময় চুক্তি না থাকলেও সরকারের কূটনৈতিক পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারে। কেন তাকে (তারেক রহমান) দেশে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন, আর তারা (ব্রিটিশ সরকার) কেন তাকে (তারেক রহমান) ফিরিয়ে দিতে চান না, সে বিষয়েও এখন আলোচনা হবে।
×