ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রিপভিত্তিক দৈনিক চুক্তি অশুভ প্রতিযোগিতায় চালককে উৎসাহিত করে ;###;প্রভাবশালীদের চাপে শাস্তি হয় না- তদ্বিরেই মুশকিল আসান! ;###;এজন্য কাউকে তোয়াক্কা করে না চালক

বেপরোয়া চালক ॥ বাসেই ঘটছে ৯০ ভাগ দুর্ঘটনা

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৬ এপ্রিল ২০১৮

বেপরোয়া চালক ॥ বাসেই ঘটছে ৯০ ভাগ দুর্ঘটনা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সরকারী তিতুমীর কলেজের স্নাতকের ছাত্র রাজীব গত ৩ এপ্রিল রাজধানীতে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের বাসের রেষারেষিতে হাত হারায়! দুই বাসের চাপায় তার ডান হাত কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দুর্ঘটনায় রাজীবের মাথার সামনে-পেছনের হাড় ভেঙ্গে যাওয়া ছাড়াও মস্তিষ্কের সামনের দিকে আঘাত লাগে। এই ঘটনায় সমালোচনার ঝড় ওঠে সারাদেশে। তার আরোগ্য কামনায় প্রার্থনার শেষ ছিল না। উন্নত চিকিৎসা হয়েছে। অবশেষে সব চেষ্টা ব্যর্থ করে না ফেরার দেশে চলে যায় রাজীব। এর মধ্য দিয়ে একটি সম্ভাবনাময় জীবনের অনাকাক্সিক্ষত সমাপ্তি ঘটে। ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনে নিউভিশন পরিবহনের একটি বেপরোয়া বাস বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রুনী আক্তারের ওপর উঠে যায়। এতে তার ডান পা থেঁতলে যায়। গুরুতর আহত এই শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারবেন কিনা এ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। তারপর বনানীতে রোজিনা আক্তারকে চাপা দেয় বেপরোয়া বাস চালক। তার এক পা ইতোমধ্যে কেটে ফেলতে হয়েছে। তবুও শঙ্কামুক্ত নন তিনি। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তার। সর্বশেষ সোমবার রাজধানীতে দুই জনের প্রাণ গেল বাস দুর্ঘটনায়। রাজধানীতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অন্তত শতাধিক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে ৯০ ভাগের জন্য দায়ী বাসচালক। অর্থাৎ বেপরোয়া এখন ঢাকার বাস চালকরা! সাবধান। যে কোন সময় মূল্যবান জীবন কেড়ে নিতে পারে চালক। ফুটপাথ ধরে হাঁটলেও রেহাই নেই। রাস্তা পারাপার তো সর্বক্ষণিক ঝুঁকি। আইল্যান্ডের উপরেও দিব্যি বাস উঠে যাচ্ছে। তাহলে নিরাপদ কোথায়? এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্রিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণাতেও উঠে এসেছে ৯০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে চালকদের অতিমাত্রার গতি ও বেপরোয়া মনোভাবই দায়ী। ১৯৯৮ সাল থেকে দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কথা হলো বাস চালকরা এত বেপরোয়া কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে কথা হয় যাত্রী নিরাপত্তায় কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের নেতা, বিআরটিএ, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাসহ ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে। মূলত সড়কের বাস্তব চিত্র প্রতিদিন তারাই প্রত্যক্ষ করে থাকেন। অনুসন্ধানে সড়ক দুর্ঘটনার বেশ কয়েকটি কারণ বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে, যানজট, চুক্তি অথবা দৈনিক ভিত্তিতে বাস চালানো, যাত্রী তোলার অশুভ প্রতিযোগিতা, আইন অমান্য করার প্রবণতা ও প্রয়োজনীয় নজরদারিসহ কঠোর শাস্তি না হওয়া। মূলত এসব কারণেই চালকরা কাউকে তোয়াক্কা করে না। চোখের সামনেই বেপরোয়া গাড়ি চালানোর দৃশ্য প্রতিদিনের। অন্তত ২০ কোম্পানির বাস চালকদের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলছেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্রতিটি পরিবহন কোম্পানির মধ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মালিকানা আছে। সড়ক দুর্ঘটনা, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, বেপরোয়া গাড়ি চালানোসহ অপরাধ যে রকমেরই হোক না কেন, সমস্যা হয় না। তদবির করলেই মুশকিল আসান। অর্থাৎ ছাড়া পাওয়া যায়। তাই আইনের প্রতি চালকদের শ্রদ্ধাবোধ বা ভয় দিন দিন কমছে। ফলে বেপরোয়া মানসিকতা বাড়ছে দিন দিন। এর পাশাপাশি যানজট, চুক্তিতে গাড়ি চালানো, যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানামা করানোসহ বিভিন্ন বিষয় তো রয়েছেই। তবে কোন কোন চালকের মত, বেপরোয়া মানসিকতার নেপথ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাদকাসক্তি ও লাইসেন্সবিহীন চালকের প্রবণতা বাড়ার বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে ২৪৬ বাস কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ৪২ কোম্পানির বাসে চালক, সহকারী ও কন্ডাক্টরদের বেতন দেয়া হয় দৈনিক ট্রিপ ভিত্তিতে। এতে বেশি ট্রিপ দিয়ে বেশি আয় করতে চালকরা নিয়ম না মেনে যেখানে সেখানে যাত্রী উঠান-নামান। ঢাকা মহানগরীতে ২০০ বাস থামার স্থান আছে। তবে এসব স্থানে বাস না থামিয়ে পুরো রুটের স্থানে স্থানে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হয়। আবার ভাড়া হিসেবেও বাস দেয়া হচ্ছে। যেমন চার হাজার টাকায় বাস ভাড়া দেয়া হয় এক দিনের জন্য। মালিকদের ভাড়া দিয়ে গাড়ির খরচ বহন করতে হয় স্টাফদের। এরপর আয়ের অংশ চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপার পেয়ে থাকেন। এই কারণে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতা চলে সব সময়। অর্থাৎ আয়ের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাস চালানোর কারণে দুর্ঘটনার মাত্রা বাড়ছে। বাড়ছে বেপরোয়া গতিও। যাত্রীরা বলছেন, চালকরা বাস বোঝাই করার নেশায় রাস্তায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে। স্টপেজে আসার আগেই পথে পথে যাত্রী তুলে বোঝাই করে ফেলে। চালকদের এমন আচরণে রাস্তায় বের হয়ে নিরাপদে বাসায় ফেরাটাই এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইন অনুযায়ী, মোটরযান শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেয়া এবং দিনে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টার বেশি কাজ না করানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও ৩৪ বছর ধরে তা মানছেন না পরিবহন মালিকরা। মাসিক বেতন না থাকায় এসব চালক রোজগারের জন্য দিনে আট ঘণ্টার বদলে ১৪ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত গাড়ি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। গাড়িচালক এবং সহকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগ ঘুমান গাড়ির আসনে। রাতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারেন না। ভোর পাঁচটার মধ্যে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হতে হয়। আবার রাতে ঘুমাতে যেতে যেতে রাত একটা পার হয়ে যায়। জানা গেছে, দূরপাল্লার হাতে গোনা কয়েকটি বাস কোম্পানি মাসিক ভিত্তিতে চালকদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। বেসরকারী হিসাবে, ৯৫ শতাংশ মালিকই নিয়োগপত্র দিচ্ছেন না, এমনকি খোরাকিও না। চালকদের উল্টো ট্রিপনির্ভর করে তুলছেন গাড়ি চালনায়। এতে কম সময়ে বেশি ট্রিপ দিতে তারা বেশি গতিতে ও ওভারটেক করে গাড়ি চালাচ্ছেন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ট্রিপভিত্তিক মজুরিতে গাড়ি চালালে মালিকের মুনাফা বাড়ে। অন্যদিকে চালক যদি মালিকের মন জয় করতে না পারে তাহলে পরের দিন তাদের চাকরি থাকে না। যেহেতু অধিকাংশ চালকের পরিবহনে স্থায়ী চাকরি নেই। সেহেতু মালিক যেভাবে চাইবে সেভাবে চালাতে বাধ্য থাকেন চালকরা। সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্লাহ বলেন, আমরা চালকদের নিয়োগপত্র দিতে রাজি আছি। তবে বাস্তবতা হলো, নিয়োগপত্রের পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। কারণ আমাদের যেখানে চালক স্বল্পতা আছে, সেখানে নিয়োগপত্র দিলে চালক পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে এক্ষেত্রে সময় ব্যবস্থাপনার একটা বিষয় আছে। রাজধানীতে ৫০ শতাংশ রোডে চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চলে। চালকরাই বেশি মুনাফার আশায় চুক্তিতে নেন। অন্যদিকে রাজধানীর সব রাস্তায় কাউন্টার, টিকেট পদ্ধতির পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় মালিকরা একটা নির্দিষ্ট হিসেব ধরে চুক্তিতে চালকদের গাড়ি দেন। তিনি আরও বলেন, বেশি মুনাফার আশায় অদক্ষ চালকরা পাল্লাপাল্লি করে। আমরা পরিবহন মালিকদের সঙ্গে মিটিং করে বলেছি, যেসব চালক এ ধরনের কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে যদি কোন গাড়ি বারবার দুর্ঘটনা ঘটায় তাহলে ওই কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রভাবশালীরা পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। মোবাইল কোর্ট, কিংবা আইন অমান্য করায় গাড়ি ধরার সঙ্গে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দফতর থেকে টেলিফোন আসে। অনেক সময় চালকরাই বড় কর্তাদের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতে বাধ্য করেন। থানায় গাড়ি নেয়া হলে দ্রুত ছেড়ে দিতে হয়। মামলা হয় ঢিলেঢালা। ফলে অপরাধের তেমন একটা বিচার হয় না। তাছাড়া বিদ্যমান ট্রাফিক আইনে কঠোর শাস্তিরও বিধান নেই। বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা বলেন, আমরাও চাই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। এজন্য বিআরটিএ ও পুলিশ প্রশাসনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চুক্তিতে বাস ভাড়া দেয়ার প্রবণতা পরিবহন সেক্টরে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। মালিকরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় এ কাজটি করছেন। ফলে দুর্ঘটনা বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। সকলে মিলে পরিবহন সেক্টর নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে বলেও মত দেন প্রবীণ এই শ্রমিক নেতা। বাসে দুর্ঘটনার প্রবণতা বেশি ॥ পুলিশের হিসাব অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনার ৩১ দশমিক ৮৭ ভাগই ঘটছে বাসে, ২৯ দশমিক ৬৮ ভাগ ট্রাকে। বাকি প্রায় ৩৮ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে প্রাইভেটকার, জিপ, ট্যাক্সি ও মোটরসাইকেলে। গত বছরের শেষ তিন মাসে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে পুলিশ সদর দফতর এ তথ্য পেয়েছে। অবশ্য বেসরকারী সংস্থা বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির দেয়া তথ্যানুযায়ী ২০১৭ সালে সারাদেশে মোট চার হাজার ৯৭৯ সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৩৯৭ জন প্রাণ হারান। ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হন। আগের বছর ২০১৬ সালে চার হাজার ৩১২টি দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ছয় হাজার ৫৫। ওই বছর আহত হয় ১৫ হাজার ৯১৪। সে অনুযায়ী ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে ১৫ দশমিক ৫ ভাগ, নিহতের সংখ্যা বেড়েছে ২২ দশমিক ২ ভাগ এবং আহত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে ১ দশমিক ৮ শতাংশ। পুলিশ সদর দফতর প্রতি তিন মাস পর সারাদেশে ঘটে যাওয়া নানা অপরাধ ও মামলার তথ্য বিশ্নেষণ করে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনার মামলা সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ওই তিন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় সারাদেশে ৪৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে গুরুতর আহত হয়েছে ৪৩৬। এর মধ্যে ঢাকা রেঞ্জের বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটে বেশি। ওই তিন মাসে বাসে দুর্ঘটনা ঘটে ১৬০, ট্রাকে ১৪৯, প্রাইভেটকার বা জিপে ৭৯, ট্যাক্সিতে ৪৮ এবং মোটরসাইকেলে ৬৬। যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসেবে, গত বছর এক হাজার ২৪৯ বাস, এক হাজার ৬৩৫ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান, ২৭৬ হিউম্যান হলার, ২৬২ প্রাইটেকার, জিপ, মাইক্রোবাস, এক হাজার ৭৪ অটোরিক্সা, এক হাজার ৪৭৫ মোটরসাইকেল, ৩২২ ব্যাটারিচালিত রিক্সা এবং ৮২৪ নছিমন-করিমন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
×