ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লন্ডনে হিন্দু ধর্মকে জড়িয়ে বিএনপির কুৎসিত স্লোগান

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৬ এপ্রিল ২০১৮

লন্ডনে হিন্দু ধর্মকে জড়িয়ে বিএনপির কুৎসিত স্লোগান

বিভাষ বাড়ৈ ॥ লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রতিবাদে আয়োজিত কর্মসূচীতে বিএনপির নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক তৎপরতা নিয়ে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। কর্মসূচীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হিন্দু ধর্মকে জড়িয়ে আপত্তিকর স্লোগান দেয়ায় প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। বিএনপির নেতাকর্মীদের ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম, শেখ হাসিনার বাপের নাম’ বলে দেয়া স্লোগানের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে অবিলম্বে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতিকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি উঠেছে। দাবি উঠেছে কঠোর আইনী ব্যবস্থা নেয়ার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাজ্য সফরের সময় যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতাকর্মীরা ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম, শেখ হাসিনার বাপের নাম’ বলে স্লোগান দেন। কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে গত ১৬ থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে অবস্থান করেন প্রধানমন্ত্রী। তার এই সফরকে ঘিরে প্রতিবাদমুখর ছিল বিএনপি। বেশকিছু কর্মসূচির ছবি এবং ভিডিও ছড়িয়েছে ফেসবুকে। যার একটি ভিডিওতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হিন্দু দেবতার নাম জড়িয়ে স্লোগান দিতে দেখা যায় যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেকের নেতৃত্বে সেখানকার নেতাকর্মীদেরকে। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার দাবির ব্যানার নিয়ে দাঁড়ানো ওই সমাবেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক স্লোগান দেয়ার পর যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি মালেক সেখানে একজন গণমাধ্যমকর্মীকে সাক্ষাৎকারও দেন। সেই ছবিও আছে গণমাধ্যমে। ভিডিওটিতে দেখা যায় বিএনপির নেতাকর্মীরা তুমুল উৎসাহের সঙ্গে স্লোগান দিচ্ছে ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম! শেখ হাসিনার বাপের নাম...!!!’। এ ঘটনায় হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ এনে প্রতিবাদ শুরু করে ক্যাম্পেন ফর দ্য প্রটেকশন অব রিলিজিয়াস মাইনরিটিজ ইন বাংলাদেশের (সিপিআরএমবি)। প্রতিবাদ জানাচ্ছে সেক্যুলার বাংলাদেশ মুভমেন্টের যুক্তরাজ্য শাখা। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেককে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সিপিআরএমবি। লন্ডনে সংবাদ সম্মেলন করে ক্যাম্পেন ফর দ্য প্রটেকশন অব রিলিজিয়াস মাইনরিটিজ ইন বাংলাদেশের (সিপিআরএমবি) সভাপতি পুষ্পিতা গুপ্ত ও সম্পাদক অজিত সাহা এই আহ্বান জানান। বিতর্কিত এ কর্মসূচীর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক ইতোমধ্যেই এ ম্লোগান দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তার দাবি, তিনি ও তার দল হিন্দু ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারা এর মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতি আঘাত করেননি। তিনি বলেন, এটি রাজনৈতিক স্লোগান। আমরা আওয়ামী লীগকে টার্গেট করেই স্লোগান দিয়েছি। সেক্যুলার বাংলাদেশ মুভমেন্ট ইউকের মুখপাত্র পুষ্পিতা গুপ্ত ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর জনসভার বাইরে বিএনপির বিক্ষোভের একটি ভিডিও তাদের কাছে রয়েছে। এতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা ম্লোগান শুনে তারা বিস্মিত হয়ে গেছেন। লন্ডনের ব্যস্ততম এলাকা ওয়েস্ট এন্ডে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ বলে সবসময়ই হিন্দু ধর্মাবলম্বী শ্বেতাঙ্গদের কীর্তন গেয়ে চলাফেরা করতে দেখা যায়। এদের কেউ বিষয়টি বুঝতে পারলে এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলে বিষয়টি অন্যভাবে মোড় নিতে পারতো। সংগঠনটির নেতাকর্মীরা বলেছেন, বিএনপি নেতারা ক্ষমা না চাইলে তারা যুক্তরাজ্যে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ করবেন। ভিডিও চিত্র থাকলেও বিএনপির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোন বক্তব্য দেয়া হয়নি। যদিও দলের কোন কোন নেতা গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন, এসব স্লোগান তাদের নেতাকর্মীরা দিতে পারেন না, তাদের ওপর দায় দেয়া হচ্ছে। এদিকে সাম্প্রতিক ইতিহাসে বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলের দেশের বা বিদেশে এ ধরনের বক্তব্য নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইছে প্রদিবাদের ঝড়। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের স্লোগানের ব্যবহার সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদের সরাসরি লংঘন। আর ঘটনাটি দেশের বাইরে হলেও যেহেতু ওই দেশের বিএনপি এই কাজ করেছে, তার দায় দলের কেন্দ্রকেই নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন, সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১. সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, ২. রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দান, ৩. রাজনৈতিক উদ্দেশে ধর্মের অপব্যবহার এবং ৪. বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হবে। অর্থাৎ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের এক এবং তিন উপ-অনুচ্ছেদের লংঘন হয়েছে। এদিকে দেশে ও বিদেশে এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সাধার সম্পাদক এ্যডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। তিনি জনকণ্ঠকে বলেছেন, যে কাজটা হয়েছে তার বিরুদ্ধে আমাদের দেশেও বিশেষ ক্ষমতা আইন আছে। ব্রিটেনেও এ ধরনের কর্মকা-ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আইন আছে। সে অনুসারে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে রানা দাশগুপ্ত বলেন, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকারের এ বিষয়ে কোন ছাড় দেয়া ঠিক হবে না বলে আমি মনে করি। তিনি আরও বলছিলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় জামায়াত ও তাদের মতাদর্শেল উগ্রবাদী দলগুলো স্লোগান তুলেছিল, ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম, শেষ মুজিবের অপর নাম’। ১৯৯১ সালে নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ওই শক্তিই স্লোগান তোলে, ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম, শেষ হাসিনার অপর নাম’। তারা আরও বলেছিল, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশ ভারত হয়ে যাবে।’ এরা সেই পাকিস্তানী প্রেতাত্মা যারা চায় না বাংলাদেশ সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হোক। রানা দাশগুপ্ত আরও বলেন, আমি মনে করি সেই একই উগ্রবাদী ভাবধারা ছড়িয়ে ওরা নির্বাচনে আসার ক্ষেত্র তৈরি করছে উগ্রবাদী পথেই। ক্ষমতাসীনদের এ বিষয়ে কোন ছাড় দেয়া কোনভাবেই উচিৎ হবে না। বিএনপির কাছে ব্যাখ্যা দাবি করা উচিত বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলি ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। বিশিষ্ট এ আইনজীবী বলছিলেন, লন্ডনে যে সাম্প্রদায়িক স্লোগান দেয়া হয়েছে, আমাদের সংবিধান অনুযায়ী এই দল থাকতে পারে না। যারা সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কানি দেয় তাদের এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার দেয়নি আমাদের সংবিধানে। বিএনপি আন্ডারগ্রাউন্ড সন্ত্রাসী দলের মতো করছে। যারা এই ধরনের কর্মকা- করেছে, বিএনপি বলছে তারা আমাদের নয়। তাহলে আপনারা প্রতিবাদ করছেন না কেন? প্রতিবাদ না করে এটাকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন করছে। তুরিন আফরোজ আরও বলেন, আসলে এরা বিদেশের মাটিতে বিএনপির ক্ষতি করছে। এটা একটা বাজে প্র্যাকটিস, এতে বিএনপিরই ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় যুক্তরাজ্য সরকারেরও সমালোচনা করেন তুরিন আফরোজ। বলেন, গণতন্ত্রের পুণ্যভূমিতে (যুক্তরাজ্য) বারবার এ ধরনের কর্মকা- দেখছি। সেখানে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার চর্চা হয়েছে, আমাদের মিশনে আক্রমণ করা হচ্ছে, এতে ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন হচ্ছে। তারা এই ধরনের কর্মকা-কে আশ্রয় প্রচ্ছয় দিচ্ছে। এমনকি মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিকেও তারা আশ্রয় দিচ্ছে। কবির চৌধুরী তন্ময় ফেসবুকে বিএনপির ওই স্লোগানের ভিডিও শেয়ার দিয়ে লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকালে লন্ডন বিএনপির সমাবেশের ছোট্ট এই ভিডিওটিতে অনেক বড় বার্তা পাবেন। ভিডিওটি ফেসবুকে তুলে ধরার ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ইনবক্সে ভাই-বোন, বন্ধুদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত আপনাদের কাছে প্রশ্ন, বিএনপির চেয়ে আর কতবড় মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক দল বাংলাদেশে আছে...? অঞ্জয় দেব চৌধুরী নামে আরও একজন ভিডিওটি শেয়ার দিয়ে লিখেছেন, তলে তলে সাম্প্রদায়িকতা পোষা বিএনপি প্রকাশ্যে এতো নির্লজ্জভাবে তার সাম্প্রদায়িকরূপের প্রকাশ ঘটিয়েছে যে এরা বাংলাদেশের একটা বড় রাজনৈতিক দল ভাবতেও ঘেন্না হচ্ছে। রাজীব চৌধুরী লন্ডন থেকে তার সেলফোনে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশে কোন দলের এই ধরনের সাম্প্রদায়িক স্লোগান দেখা যায়নি। বিএনপি যে জামায়াতের ‘বি’ টিম তার দৃষ্টান্ত তারা বিদেশেও দেখাল। প্রবাসী এ মুক্তিযোদ্ধা অবিলম্বে বিএনপির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
×