ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিদিনই মিয়ানমার থেকে আসছে লাখ লাখ ইয়াবা

ইয়াবা পাচারে জড়িত রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৬ এপ্রিল ২০১৮

ইয়াবা পাচারে জড়িত রোহিঙ্গারা

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা দেশের জন্য একদিকে আপদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তার ওপরে মহাবিপদ হয়ে এসেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একশ্রেণীর সদস্য মিয়ানমার থেকে প্রতিনিয়ত লাখ লাখ পিস মরণনেশা মাদক ইয়াবার চালান নিয়ে আসার সঙ্গে জড়িত হওয়া। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কোনভাবেই ইয়াবার চালান রোধ করতে পারছে না। কক্সবাজারের পুরো অঞ্চলই একটি ইয়াবা জোনে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারে ৩৯টি ইয়াবা উৎপাদন কারখানা থেকে চোরাচালান চক্রের সদস্যরা ইয়াবা বাংলাদেশে প্রেরণ করছে। আর রোহিঙ্গারা এর ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মূল গডফাদারদের মধ্যে কেউ আছে এপারে, কেউ আছে ওপারে। এপারের গডফাদারদের তালিকা বহু আগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করেছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদের ধরার সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। টেকনাফের বিভিন্ন স্থান দিয়ে প্রতিনিয়ত ইয়াবার চালান কেবলই আসছে। কখনও স্থলপথে, কখনও সমুদ্র পথে, কখনও অন্য পথে ইয়াবার চালান চট্টগ্রাম হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে। সর্বনাশা এ মাদক ব্যবসা কোনমতেই রোধ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের পক্ষে মিয়ানমার সরকারকে ইতোপূর্বে এসব ইয়াবা উৎপাদন কারখানার কথা এবং ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হলেও মিয়ানমার সরকার অদ্যাবধি এ নিয়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অভিযোগ রয়েছে, মিয়ানমারের বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত বড় বড় সেনা কর্মকর্তারা এসব ইয়াবা কারখানার মালিকানায় জড়িত। এদিকে, আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা মাদকের পাশাপাশি অস্ত্র, নারী পাচারের সঙ্গেও ক্রমাগতভাবে জড়িয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে সমুদ্র পথে টেকনাফ উপকূল থেকে শর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা নরনারীর একটি দল মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দিয়েছে। এরপরে রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের আরেকটি দল পৌঁছে গেছে ইন্দোনেশিয়ায়। মানব পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্যরা আগামীতে সমুদ্র পথে আরও রোহিঙ্গা পাচারে তৎপরতায় রয়েছে। টেকনাফ ও উখিয়ার বিশাল ১২টি আশ্রয় শিবির ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা রোহিঙ্গা নেতারা (পুরনো রোহিঙ্গা) শরণার্থী শিবিরে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে। তারা যেভাবে হোক প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বানচাল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। মিয়ানমার সীমান্তের কাছে টেকনাফ উখিয়ায় বসবাস করছে অসাধু ওই চক্রটি (পুরনো রোহিঙ্গা)। তাদের বাংলাদেশে স্থায়ী বসবাস নতুবা বিভিন্ন দেশে আশ্রয় দেয়ার আশ্বাস দিচ্ছে বলে জানা গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ পাইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা হচ্ছে ২৭১ কিলোমিটার। তন্মধ্যে ৪৫ কিলোমিটার নদীপথ। ওই সীমান্ত এলাকার ফাঁকফোকর দিয়ে রোহিঙ্গারা নিয়ে আসছে মাদক ইয়াবার চালান। অনুপ্রবেশ করার সময় সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে বহু আগ্নেয়াস্ত্র। যেসব রোহিঙ্গার কাছে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে, তা ভালভাবে জানে পুরনো রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ওই রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইতোপূর্বে তারা সাক্ষাতে নতুবা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেছে। তবে এখন তাদের যোগাযোগের ধরন পাল্টে গেছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন মোবাইল ট্র্যাকিং করছে সন্দেহে রোহিঙ্গা জঙ্গীরা সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইমেইলে যোগাযোগ করে চলেছে বলে জানা গেছে। অস্ত্র-গুলিসহ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটক ॥ টেকনাফ মডেল থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও গুলিসহ জায়েদ আলম নামে এক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করেছে। মঙ্গলবার ভোর ৫টায় টেকনাফের নয়া পাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পুলিশ এ অভিযান চালায়। ধৃত সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা উলা মিয়ার পুত্র। টেকনাফ থানার ওসি রনজিত কুমার বড়ুয়া জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদে ডাকাত জায়েদ আলম ডাকাতি করার উদ্দেশে সে ওই অস্ত্র ও গুলি সেখানে লুকিয়ে রেখেছিল বলে স্বীকার করেছে। ধৃত জায়েদের বিরুদ্ধে অস্ত্র এবং ডাকাতি প্রস্তুতি মামলাসহ একাধিক মামলা বিচারাধীন। সে টেকনাফ এলাকায় রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার হিসেবে পরিচিত।পুলিশ জানায়, রোহিঙ্গা ডাকাত আটকের পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে নয়াপড়া শরণার্থী ক্যাম্পের পাশে ইবিসি ব্রিক ফিল্ডে অস্ত্র গুলি রেখেছে মর্মে স্বীকারোক্তি দেয়। ওই ব্রিক ফিল্ডের উত্তর পশ্চিম কোণে ইটের নিচ থেকে জায়েদ আলমের দেখানো ও বের করে দেয়া ২ রাউন্ড গুলি ভর্তি ২টি সচল এলজি উদ্ধার করেছে পুলিশ। অপরদিকে, মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটে স্থানীয় রাখাইনদের মতোই রোহিঙ্গাদের সমান নাগরিক অধিকার এবং শিক্ষা ও কাজের রাষ্ট্রীয় সুযোগ প্রাপ্তির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে বৌদ্ধপ্রধান স্থানীয় আরাকান আর্মি (এএ)। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের পাসপোর্ট প্রদানেরও দাবি জানিয়েছে এ-এ প্রধান স্বঘোষিত মেজর জেনারেল তুন মায়াট নাইঙ। উল্লেখ্য, আরাকান আর্মি বা এ-এ হলো এ মুহূর্তে রাখাইন (আরাকান) স্টেটের সবচেয়ে আলোচিত গেরিলা দল। দেশটিতে যে সব সক্রিয় গেরিলা দলের সঙ্গে সরকারী বাহিনীর যুদ্ধবিরতি চুক্তি নেই তার একটি হলো ‘এ-এ’। এ মুহূর্তে চীন ও কাচীন অঞ্চলে ‘এ-এ’র সঙ্গে সরকারী বাহিনীর সংঘাতও চলমান। এ-এ হলো ইউনাইটেড আরাকান লীগের সশস্ত্র শাখা। গত ১১ এপ্রিল মিয়ানমারের ‘দি ইরাবতী’তে এক সাক্ষাতকারে জেনারেল নাইঙ ইউনিয়ন সরকারের সঙ্গে তার দলের যুদ্ধবিরতি আলোচনা, রাখাইনের পরিস্থিতির পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু অভিমত তুলে ধরেন, যা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী সহিংস পরিস্থিতির শিকার আরাকান অঞ্চলে রাজনৈতিক-সামরিক সমীকরণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।সাক্ষাতকারে জেনারেল নাইঙ রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে দেশে-বিদেশে উল্লিখিত ‘আরসা’র সঙ্গে তার দল ‘এ-এ’ এর যোগসূত্রের অভিযোগ নাকচ করে দেন এবং আরসাকে একটা ‘জিহাদপন্থী’ সংগঠন হিসেবেই অভিহিত করেন। তিনি এও জানান, গণচীন আরসা’র সঙ্গে এ-এ’র যোগাযোগ সম্পর্কে শেষোক্ত সংগঠনকে সতর্ক করে দিয়েছে। এ-এ’র জেনারেলের সূত্রে এও জানা গেছে, চীন আরাকান অঞ্চলে আরসা ও এ-এ’র সংহতিমূলক সম্পর্কের ব্যাপারে খুব উদ্বিগ্ন। কারণ তার ‘সামুদ্রিক সিল্করুট’-এ রাখাইনের কাইয়াকপু গভীর সমুদ্রবন্দর গুরুত্বপূর্ণ এক অংশীদার। পাশাপাশি, এই অঞ্চলে চীনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। রাখাইন বা আরাকান থেকে মিয়ানমারের মূল ভূখ-ের ওপর দিয়ে চীন প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি পাইপলাইন বসিয়েছে মেইনল্যান্ড চায়না পর্যন্ত।
×