ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের অবস্থান খুবই দুর্বল -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২৬ এপ্রিল ২০১৮

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের অবস্থান খুবই দুর্বল -স্বদেশ রায়

ডিজিটাল বাংলাদেশের স্রষ্টা শেখ হাসিনা। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাহার বিবেচনায় বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্তৃতি অনেক বেশি। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে প্রায় দশ কোটি মানুষ। এর বড় অংশ ব্যবহার করে ফেসবুক। পৃথিবীর ৭ বিলিয়ন মানুষের ভেতর ২.২ বিলিয়ন মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। সেখানে বাংলাদেশের ১৬ কোটির দশ কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছে। এতেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার কী হারে বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুধু যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ বেড়েছে তা নয়, অনেকটা বিকল্প প্রচার মাধ্যমও হয়ে উঠছে দিনে দিনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিকল্প প্রচার মাধ্যম হয়ে ওঠার যেমন সুবিধা আছে, তেমনি অসুবিধাও আছে। সুবিধা হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যত দ্রুত নিউজ ব্রেক করতে পারে, তত দ্রুত মিডিয়া করতে পারে না। গত কয়েক বছরে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে আয়নেল কুর্দি থেকে শুরু করে আমেরিকার স্কুলে গুলি চালানো সবক্ষেত্রে বিবিসির আগে নিউজ ব্রেক করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এ ছাড়া আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ইন্ডিয়ার গত লোকসভা ও সাম্প্রতিক কয়েকটি রাজ্যের বিধান সভা নির্বাচন, ব্রেক্সিট প্রভৃতি নির্বাচনে দেখা গেছে কনভেনশনাল মিডিয়ার থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়েছে বেশি। অন্যদিকে আরব স্প্রিং, দিল্লীতে ধর্ষণের বিরুদ্ধে মোমবাতি, বাংলাদেশের গণজাগরণ মঞ্চ প্রভৃতিও ঘটেছে এই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। এর থেকে একটি সিদ্ধান্তে আসা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের মনোজগত ও কাজের প্যাটার্ন বদলে দিয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে যেমন ব্যক্তি জীবনে, তেমনি নির্বাচন থেকে শুরু করে যে কোন আন্দোলনে। মানুষ প্রযুক্তি সৃষ্টি করেছে, আবার সেই প্রযুক্তিই মানুষকে সভ্যতা ও মানুষের আচরণের এক নতুন অধ্যায়ে নিয়ে গেছে। মানুষের এই প্রযুক্তি তৈরির শুরু থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রযুক্তি যেমন কল্যাণে ব্যবহার হচ্ছে, তেমনি খারাপ কাজেও ব্যবহার হচ্ছে। সূচালো শক্ত কোন পাথর বা ধাতু ঘষে অস্ত্র তৈরি করেছিল মানুষ নিজের খাবার জোগাড় করতে পশুপাখি শিকারের জন্য। অথচ দেখা গেল এক পর্যায়ে মানুষ সেসব অস্ত্র নিজেদের ভেতর সংঘর্ষে ব্যবহার করছে। সভ্যতার তিন লাখ বছর আর আধুনিক সভ্যতার কম-বেশি সত্তর হাজার বছরের ইতিহাসে যদি চোখ রাখা হয়, দেখা যাবে প্রতিটি স্তরে মানুষের তৈরি প্রযুক্তি কল্যাণ ও ধ্বংসে প্রায় সমানভাবে ব্যবহার হচ্ছে। তাই তথ্যপ্রযুক্তির এই প্রসার ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসার অবশ্যই ভাল ও মন্দ দুই দিকেই ব্যবহার হবে। গত কয়েক বছরে আমরা সারা পৃথিবীতে ইসলামিক মৌলবাদীদের দিকে লক্ষ্য রাখলে দেখতে পাচ্ছি, তারা সব সময়ই এই তথ্যপ্রযুক্তিকে খারাপ কাজে ব্যবহার করেছে। মানুষ হত্যা, নারীকে ধর্মের নামে তাদের যুদ্ধে আহ্বান করে এক ধরনের যৌনদাসীতে পরিণত করছে। সে সব মেয়ের দুর্বিষহ জীবনের কথা আমরা এখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও বইয়ের মাধ্যমে পাচ্ছি। বাংলাদেশেও এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মৌলবাদীরা অনেক বেশি শক্তিশালী। সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ সব মৌলবাদীরা যে কাজ করেছিল, তার বিপরীতে সরকার কিন্তু কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। সরকার যদি মনে করে তারা শুধুমাত্র আইনী প্রক্রিয়ায় এদের মোকাবেলা করবে, তাহলে সরকারের চিন্তাধারা এখনও অনেক পেছনে পড়ে আছে। বাস্তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে সরকারের চিন্তা ধারা যে এখনও অনেক পিছে পড়ে আছে, তার বড় প্রমাণ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলন। শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল এই আন্দোলনটি করল। শুধু আন্দোলনই করল না, ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার ও হাজার হাজার শহীদের রক্তে ভেজা পবিত্র ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে এখন সদর্পে ঘুরছে চার শিবির নেতা। যারা ইসলামী ছাত্রশিবিরের বাঁশের কেল্লার মেম্বার। আর তাদের পক্ষ হয়ে এখন গায়ে কাপড় জড়ানো তথাকথিত বামপন্থীরাও কথা বলছে। এখনও তথ্যপ্রযুক্তির যাবতীয় যোগাযোগ মাধ্যমে এই মৌলবাদীরা তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। তাদের এই আধিপত্যের জোরে, তাদের অপপ্রচারের জোরে অনেকেরই মনোবল ভেঙ্গে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সমাজে এও দেখছি যে, তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেকেই তাদের ভাষায় কথা বলছে। এখন স্বাভাবিকই প্রশ্ন আসে, সরকারের এই সাড়ে নয় বছরে এসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বাধীনতার সপক্ষের অবস্থান এত দুর্বল কেন? সরকারের দল আছে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্র আছে। সব কিছুর মাধ্যমে সরকার খোঁজ নিতে পারবে কেন তাদের অবস্থান এত দুর্বল আর মৌলবাদীদের অবস্থান এত শক্ত? একজন সাংবাদিক হিসেবে গত কয়েকদিনে যা খোঁজখবর নিয়েছি তাতে দেখতে পাই, মৌলবাদীরা যে যথেচ্ছ মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে- সেগুলো মনিটর ও তাদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব যাদের, তারা সে কাজটি সঠিক করছেন না। কেন করছেন না সেটা বলা সম্ভব নয়। তবে এক ধরনের অযোগ্যতার ছাপও তাদের কাজের ভেতর আছে। তার প্রমাণও কয়েকটি কাজে পেয়েছি। তা ছাড়া তারা কাজ করছেন আমলাতান্ত্রিক গতিতে, অন্যদিকে মৌলবাদীরা কাজ করছে তথ্যপ্রযুক্তির গতিতে। আমলাতন্ত্রের গতি বড়জোর হাতির গতি, অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তির গতি আলোর গতি। তাই এখানে তাদের পাল্লা দেয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। এখন প্রশ্ন আসে, সরকারের পক্ষে না হোক স্বাধীনতার সপক্ষে কেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শক্তিশালী নয়? কেন যখন মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী কোটা নিয়ে একের পর এক গুজব ছড়িয়ে আন্দোলন করল, তখন স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির সেই সম্মিলিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শক্তি দেখা গেল না? এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে যতদূর যা জানতে পারি- যেমন শাহবাগকেন্দ্রিক অনেকগুলো গ্রুপের ভেতর একটি গ্রুপ গড়ে উঠেছিল সিপি গ্যাং। এরা মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে বেশ একটিভ ছিল। মৌলবাদীদের যে কোন অপপ্রচারের এরা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিত। এই গ্যাংটি এখন ইনএকটিভ। যতটা জানতে পারলাম ছাত্রলীগের কোন্দলই এই গ্রুপটির ইনএকটিভ হয়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ। সিপি গ্যাংয়ের মতো শাহবাগ বসন্তের ছেলেমেয়েরা আরও অনেক গ্রুপ গড়ে তুলেছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এগুলোও সিপি গ্যাংয়ের মতো ইনএকটিভ হয়ে গেছে। গ্রুপগুলোর ইনএকটিভ হয়ে যাওয়ার বড় একটি কারণ, ব্লগার বলে ধর্মবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ওপর আক্রমণ করা। তাদের জীবনের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে যাওয়া। মৌলবাদীরা তাদের অনেকের ওপরই সশস্ত্র আক্রমণ করেছে। তাদের কেউ কেউ নিহত ও আহত হয়েছে। কারও পরিবার পড়েছে নানা হুমকির মুখে। কারও কারও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি হারাতে হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের সংগঠন ও সরকার এদের কোন খেঁাঁজখবর নেয়নি। যে সব পরিবার হুমকির মুখে পড়েছে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়নি সরকার। যারা চাকরি হারিয়েছে, তাদের পাশেও কেউ দাঁড়ায়নি। বরং সরকারী দলের কোন কোন নেতা ও মন্ত্রীর ভাষা এবং মৌলবাদীদের ভাষা এদের ক্ষেত্রে এক হয়ে গেছে অনেক সময়। যার ফলে এখন বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে, মৌলবাদীরা যেমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংঘবদ্ধ, স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির তরুণ-তরুণীরা ওই ভাবে সংঘবদ্ধ নয়। বরং তারা ইনএকটিভ ও হতাশ। বর্তমানের তথ্যপ্রযুক্তির যুুগে এই অবস্থা যে সরকারের জন্য কত বড় হুমকির, তা সরকার এখনও উপলব্ধি করতে পারছে না। কারণ, এরা যেমন গুজব ছড়িয়ে যে কোন ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে দেশকে, তেমনি প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে আরও অনেক ভয়াবহ কাজ করতে পারে। বর্তমান পৃথিবীতে এই সাইবার যোদ্ধাদের ক্ষমতাকে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারী এই মৌলবাদী চক্র সরকারের অনেকগুলো ওয়েবসাইট হ্যাক করলÑ এই হ্যাক একটি ডিজিটাল দেশে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে সেটা সরকার ভেবে দেখতে পারে। যারা হ্যাক করল তাদের বিরুদ্ধে সরকার এখনও কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। অথচ স্বাধীনতার পক্ষের যদি সাইবার যোদ্ধা থাকত, তাহলে তারা সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা ওদের এ্যাকাউন্টগুলোকে আক্রমণ করে চিহ্নিত ও বন্ধ করতে পারত। সরকারের মনে রাখা উচিত বিএনপি এখন আর তাদের জন্য কোন হুমকি নয়। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি এখন একটি অস্তগামী সূর্য। তাদের জন্য হুমকি এই মৌলবাদীরা। আর মধ্যপ্রাচ্যের মৌলবাদীদের মতো এই মৌলবাদীরাও হাতে তুলে নিয়েছে সাইবার অস্ত্র। তাই এখনই এদের রুখে দেয়ার জন্য যদি স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির সাইবার যোদ্ধা না গড়ে তোলা হয়, তাহলে সরকার একের পর এক বিপর্যয়ে পড়বে। [email protected]
×