ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাসির আলী মামুনের আলোকচিত্র প্রদর্শনী

কালোর মায়া, অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো...

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৫ এপ্রিল ২০১৮

কালোর মায়া, অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো...

মোরসালিন মিজান ॥ কার ভাল লাগে কালো? কে অন্ধকার ভালবাসে? আলো চাই সবার। শুধু আলো। নাসির আলী মামুনও তা-ই। আলোর পানে ছুটছেন। তবে খ্যাতিমান আলোকচিত্রশিল্পী কালোকে অস্বীকার করেন না। কালোর ভেতর থেকে অদ্ভুত আলোটি আবিষ্কার করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ যে বলেছিলেন, ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’; সেই আলোর সন্ধানে দীর্ঘ পথচলা তার। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ছবি তুলছেন। বহু প্রদর্শনী। একটি এখন চলছে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে। জাদুঘরেরই আয়োজন। ‘ফটোজিয়াম’ শিরোনামে গত ১০ এপ্রিল এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এর পর থেকে প্রতিদিনই কৌতূহলী চোখে নাসির আলী মামুনের ক্যামেরার কাজ দেখছেন দর্শনার্থীরা। উপভোগ করছেন। হ্যাঁ, পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি। গ্যালারির দেয়ালজুড়ে অনেকগুলো প্রিয় মুখ। বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। রাজনীতি অর্থনীতি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অগ্রগণ্য যারা, যারা দিকপাল তাদের প্রতিকৃতি ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে। মুখগুলো বারবার দেখা। এর পরও চোখ কচলে নতুন করে তাকাতে হয়। কারণ ক্যামেরার পেছনের মানুষটি নাসির আলী মামুন। পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি করতে গিয়ে ব্যক্তি, অভিব্যক্তি আর পরিপার্শ্বকে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য দান করেন তিনি। স্বতন্ত্র শিল্পভাষা তৈরি করেন। প্রদর্শনীর ছবিগুলো কালো এবং আলোর নির্মাণ। ‘কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।’ মামুন তারেই যেন ‘কৃষ্ণকলি’ রূপে তুলে ধরেন। ছবির অনেকেই আর বেঁচে নেই। সেই কবে কোন কালে গত হয়েছেন! কিন্তু ছবি হয়ে ঠিক ফিরেছেন তারা। বহু কালের দূরত্ব ঘুচিয়ে বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে সামনে এসেছেন। মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে মন কখনও বিষণœ হয়ে যায়। কখনও গর্বে বুক ভরে ওঠে। মহান ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে ফিরেছে তাদের সময়। দেখতে দেখতে দেখা হয়ে যায় মামুনের লেগে থাকা। ছোটাছুটি। কমিটমেন্ট। ক্যামেরা হাতে শুধু ছবি তোলা নয়। দীর্ঘ সাধনার ফল এই সব পোর্ট্রেট। কিছু ছবি ছবির মানুষকে নিয়মিত অনুসরণ করার ফল। ইতিহাসের সঙ্গে থাকার প্রাপ্তি। এ আলোচনায় উদাহরণ হতে পারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিগুলো। মহান নেতাকে অনুসরণ করতে গিয়ে একাত্তরের উত্তাল জনসমুদ্রে পৌঁছে গেছেন আলোকচিত্রী। জনতার মাঝ থেকেই পোর্ট্রেটের শেখ মুজিবকে খুঁজে নিয়েছেন। মাওলানা ভাসানীকে খুঁজে নিয়েছেন তার সরল জীবনযাপন থেকে। নাসির আলী মামুন শিল্পী সাহিত্যিক কবিদের সঙ্গে মিশেছেন। তাদের ঘরের মানুষটি হয়ে ছবি তুলেছেন। আর তাই কাজী মোতাহার হোসেন জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রতিকৃতির সঙ্গে তাদের একান্ত ভুবন চমৎকারভাবে ফ্রেমবন্দী হতে দেখা যায়। আহমদ শরীফ সরদার ফজলুল করিম হুমায়ুন আজাদ আহমদ সফার মতো লেখকরা নিজের মাঝেই মগ্ন অবস্থায় ধরা দেন। কবিদের ছবি ছবিতে কবিতারই ভাব। গভীরতা। গাম্ভীর্য। প্রদর্শনীর ছবিতে বিদ্রোহী কবি নজরুলের শেষ জীবন। জসীমউদ্দীন শামসুর রাহমান আল মাহমুদ আহ্সান হাবীব সৈয়দ শামসুল হক নির্মলেন্দু গুণের ছবিতে আলো আঁধারীর খেলাটা আরও বেশি স্পষ্ট। একইভাবে ধরা দেন ওপার বাংলার কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শঙ্খ ঘোষ শক্তি চট্টোপাধ্যায়রা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কামরুল হাসান এস এম সুলতানের মতো শিল্পীকে তাদের কর্মপরিবেশেই পাওয়া হয়। প্রতিটি ছবি ছবির মানুষের সৃজনশীলতা মনের ভাব ও ভাষাকে ধারণ করে। চারপাশের জগতকে বিশিষ্টার্থক করে উপস্থাপন করে। নাসির আলী মামুন দেশের মতো বিদেশেও কাজ করেছেন। সবসময় ক্যামেরা সঙ্গে ছিল। সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছেন। সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। তার ক্যামেরায় ধারণ করেছেন মাদার তেরেসা স্টিফেন হকিং বিল ক্লিনটনের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বদের। প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া উস্তাদ আমজাদ আলী খান জাবির হোসেনের মতো শিল্পীদের নিজের মতো করে উপস্থাপন করেছেন আলোকচিত্রী। এভাবে কীর্তিমানদের মুখ, তাদের একান্ত ভুবন আর সময়কে তুলে ধরার কাব্যিক প্রয়াস নেন নাসির আলী মামুন। তার সাদা কালো ছবি রংধনুর সাত রং হয়ে গ্যালারিতে ছড়িয়ে পড়ে। আগামী ৩ মে পর্যন্ত চলবে প্রদর্শনী। এ সময়ের মধ্যে ঘুরে আসুন একবার। কালোর মায়া আর অন্ধকারের উৎসারিত আলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে!
×