ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে তছনছ জেসমিন সুমাদের ॥ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৫ এপ্রিল ২০১৮

জীবনের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে তছনছ জেসমিন সুমাদের ॥ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল আমার সব স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। সেদিনের পর থেকে আজও শারীরিক প্রতিবন্ধিতা ও মানসিক কষ্ট নিয়ে দিন পার করছি। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার আশায় মাত্র ১৫ বছর বয়সেই সংসারের হাল ধরতে ২০০৯ সালে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মাত্র ৪ বছরের মাথায় আমি মরতে মরতে বেঁচে গেছি। কিন্তু শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে বেঁচে আছি।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে জনকণ্ঠকে কথাগুলো বলছিলেন যশোরের মেয়ে জেসমিন। বাবা-মায়ের বড় সন্তান জেসমিন ছোট তিন ভাই ও মা-বাবার খাবার যোগাতে গার্মেন্টস শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন রানা প্লাজায়। জেসমিন জানান, ‘তিনি একজন সুইং অপারেটর ছিলেন। ঘটনার দিন তিনি সাত তলায় ছিলেন। সেদিন যখন সবাই নিজের প্রাণ রক্ষার্থে ছোটাছুটি শুরু করেছিলেন ঠিক তখনই অন্ধকারে নিজ সেলাই মেশিন থেকে মাত্র দু’কদম পা রাখতেই মোবাইলের আলোয় পাশের জনের রক্তাক্ত দেহ দেখতে পেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন জেসমিন। এরপর আর তার কিছু মনে নেই! জ্ঞান ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করেন সাভার গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের বিছানায়। এরপর তিনি জানতে পারেন রানা প্লাজা ধসের ২ ঘণ্টা পর তাকে উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে জেসমিন যশোরের ঝিকরগাছায় নিজ বাবার বাড়িতে থাকেন। রানা প্লাজা ধসের পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলেও সেই দুঃসহ চিত্র ও যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। আজও প্রতি রাতে স্বপ্নে দেখেন সেদিনকার ভয়াল চিত্র এবং আচমকা তার ঘুম ভাঙে। বর্তমানে জেসমিনের শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঘটনার পর আমার মেরুদ-ের হাড় ভেঙে যায়। সেইসঙ্গে ডান পা ভেঙে যায় ও হাতে ব্যথা পাই। এরপর সাভারের গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে টানা তিন মাস ভর্তি ছিলাম। তারপর নিজ বাড়িতে ফিরে আসি। এখনও চিকিৎসা চলছে। স্ট্রেচারে ভর দিয়ে কোনমতে হাঁটতে পারি। তবে কোমর ও পিঠের ব্যথায় বসতে খুবই কষ্ট হয়। আমি এখন শারীরিকভাবে অক্ষম। ঘটনার পর ৫০ হাজার টাকা ও একটি দোকান পেয়েছিলেন জেসমিন। তার বাবার সঙ্গে সেই মুদিখানার দোকান চালিয়েই সংসার চলছে তাদের ছয় জনের পরিবারের।’ ‘অবিস্মরণীয়, অমার্জনীয় : রানা প্লাজা’ শীর্ষক অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের গবেষণা বলছে, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে সেখানে থাকা পাঁচটি তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকসহ ১ হাজার ১০০ জনের বেশি প্রাণ হারান। ধ্বংসস্তূপের নিচের পড়ে গুরুতরভাবে আহত ও পঙ্গু হওয়ার পাশাপাশি নিখোঁজ হন অনেকেই। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০১৩ সালের ওই দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ পরে কাজে ফেরেন। ২ দশমিক ৫ শতাংশ বেকার থেকে যান। পরের বছর ২৬ দশমিক ৩ শতাংশ কাজে ফিরতে পারেন। ২০১৫ সালে কাজে ফেরা শ্রমিকদের হার দাঁড়ায় ৪৪ শতাংশ। এর দুই বছর পর ২০১৭ সালে এই হার হয় ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ। বর্তমানে ৪২ দশমিক ২ শতাংশ শ্রমিক বেকার রয়েছেন। সেইসঙ্গে ওই দুর্ঘটনার পর শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও পোশাক খাতের উন্নয়নে সরকার, মালিক ও ক্রেতারা যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে অভিযোগ শ্রমিক নেতাদের। যদিও পাশাপাশি তারা এও বলছেন, বেশিরভাগ ভুক্তভোগী শ্রমিক কোনভাবেই নিরাপদ বোধ করছেন না। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির শিকার আরেক নারী সুমা বেগম। ফ্যান্টম হেল্পার হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেন সেখানে। মাত্র চার মাসের মাথায় গর্ভবতী অবস্থায় সেই দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। তখন তিনি দুই মাসের গর্ভবতী ছিলেন। ঘটনার পর মাথায়, বুকে ও কোমরে আঘাত পান সুমা। সেইসঙ্গে নিজের অনাগত সন্তানকেও হারান তিনি। সুমা জনকণ্ঠকে জানান, এ দুর্ঘটনার পর আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। মরার মতো করেই বেঁচে আছি। কোন কাজ করতে পারি না। আমি আমার অনাগত সন্তানকে হারিয়েছি। এরপর আবার একটি ছেলে সন্তান হয়েছে। তার বয়স দুই বছর। তবে আমার শারীরিক অবস্থা মাঝে মাঝে এত খারাপ হয়ে যায় যে নিজের সন্তানকেও দেখাশুনা করতে পারি না। মাথার মধ্যে সব সময় সেদিনের ঘটনাটা ঘুরপাক খায়। চোখের সামনে হাজার হাজার মানুষে আর্তনাদ দেখতে পাই। আর তখনই আমার মাথার মধ্যে যন্ত্রণা শুরু হয়। এ ঘটনার পর সাহায্য হিসেবে যে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম তা দিয়েই এই পাঁচ বছর চিকিৎসা চালিয়েছি। আমার স্বামী একজন দর্জি। তার রোজগারেই সংসার চলছে। তবে চিকিৎসার জন্য এখন আর কোন অর্থ নেই। যদি আরও কিছু আর্থিক সাহায্য পেতাম তবে স্বামীর পাশাপাশি নিজেদের একটি টেইলার্সের দোকান দিয়ে ব্যবসা করতে পরতাম। এ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির এ গবেষণা প্রসঙ্গে বলেন, ‘পাঁচ বছর পরও এত বিশাল সংখ্যক শ্রমিকদের এ অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। আহত ও নিহত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনের থেকে কম সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি, যা দেয়া হয়েছে তা আর্থিক সহযোগিতা।’ এ্যাকশন এইড গবেষণার সঙ্গে যুক্ত এ্যাকশন এইড বাংলাদেশের ম্যানেজার নুজহাত জেবিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ফলোআপের সময় কাজে যুক্ত না হতে পারার কারণ হিসেবে শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কথাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বলেছেন। এছাড়া সামাজিক সহায়তার অভাবের কথাও এসেছে। আমরা নিবিড়ভাবে কথা বলতে গিয়ে জেনেছি, শ্রমিকরা কাজ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কারখানায় গিয়ে কয়েকদিন পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন দুই-তিন দিন ছুটি নিতে হয়। এভাবে প্রতি মাসে ৫/৬ কর্মদিবসে ছুটি কাটালে অসন্তুষ্ট হন মালিকপক্ষ।’ নিয়মিত ফলোআপ না রাখা শ্রমিকদের পুনর্বাসনকে ব্যাহত করেছে উল্লেখ করে নুজহাত জেবিন বলেন, ‘তাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে ধারাবাহিকতা ছিল না। যারা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তারা পরে গিয়ে জানতেই চাননি যে ওই প্রশিক্ষণ তারা কাজে লাগাতে পারছে কিনা।’
×