ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এলএনজির প্রথম চালান অবশেষে ভিড়েছে মাতারবাড়ি উপকূলে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৫ এপ্রিল ২০১৮

এলএনজির প্রথম চালান অবশেষে ভিড়েছে মাতারবাড়ি উপকূলে

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ অবশেষে বহুল প্রত্যাশার অবসান ঘটিয়ে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) এসে গেছে। মঙ্গলবার দুপুরে কক্সবাজারের মাতারবাড়ি উপকূলে নবনির্মিত জেটিতে ভিড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের কাতার থেকে আসা এলএনজি বোঝাই বেলজিয়ামের পতাকাবাহী জাহাজ ‘এক্সিলেন্স।’ এতে রয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ঘনমিটার তরল গ্যাস। ৭৭ হাজার ৩৪৮ টন ক্ষমতাসম্পন্ন (বিডব্লিউটি-অর্থাৎ ডেড ওয়েট টন) বিশেষায়িত এই জাহাজটিই ব্যবহৃত হবে ভাসমান টার্মিনাল হিসেবে। শিডিউল অনুযায়ী জাহাজটি এসে পৌঁছালেও গ্যাস সরবরাহ কার্যক্রম শুরু করার সময় এখনও নির্দিষ্ট করা হয়নি। এক্সিলেন্স-এর স্থানীয় এজেন্ট চট্টগ্রাম ভিত্তিক সীকম শিপিং লাইন্স লিমিটেডের পরিচালক জহুর আহমেদ জানিয়েছেন, দুপুর ২টার দিকে জাহাজটি নোঙ্গর করেছে। সরবরাহের জন্য প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষ হতে সামান্য সময় লাগবে বিধায় এই জাহাজটিকে অপেক্ষায় থাকতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী ১৫ বছর মেয়াদে ভাসমান টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহৃত হবে বিশেষায়িত জাহাজ। এরপর তা বাংলাদেশের মালিকানায় চলে আসবে। সীকম শিপিং লাইন্সের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর আমিরুল হক জানিয়েছেন, দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির সঙ্গে এই কাজে জড়িত হতে পেরে তারাও গর্বিত। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী খায়েজ আহমেদ মজুমদার জানান, জাহাজ এলেও তরলীকৃত এই গ্যাস স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আনতে কিছু ট্রায়ালের প্রয়োজন হবে। এই কাজটি জাহাজেই সম্পন্ন হবে। এরপর তা সমুদ্রের তলদেশের পাইপ দিয়ে চলে আসবে আনোয়ারায় নির্মিত সাবস্টেশনে। তিনি জানান, ইতোমধ্যেই কর্ণফুলী গ্যাস কর্তৃপক্ষ নিজেদের গ্যাস দিয়ে পাইপলাইন কমিশনিং করে রেখেছে। এখন শুধু জাহাজ থেকে গ্যাস এসে পৌঁছার অপেক্ষা। তাছাড়া সামান্য কিছু প্রক্রিয়াগত কাজ সম্পন্ন করতে হবে। তবে তা কোনভাবেই দীর্ঘসূত্রতায় গড়াবে না। আগামী ১৫ মে’র মধ্যে পাইপলাইনে এলএনজি সরবরাহ সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন কোম্পানির এই শীর্ষ কর্মকর্তা। কেজিডিসিএল এর জনসংযোগ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আগামী ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রামে আসবেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। তিনি সরাসরি মহেশখালীতে গিয়ে সরেজমিন এলএনজি টার্মিনাল এবং বিশেষায়িত জাহাজ পরিদর্শন করবেন। প্রয়োজনীয় সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে যতটা সম্ভব দ্রুত। এলএনজি সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা পর্যন্ত ৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের কাজ আগেই সম্পন্ন হয়েছে। এই পাইপলাইনের ব্যাস ৩০ ইঞ্চি। আনোয়ারা থেকে সীতাকু- পর্যন্ত আরও ৩০ কিলোমিটার পাইপলাইনের কাজ চলছে, যার ব্যাস ৪২ ইঞ্চি। পরবর্তীতে মীরসরাই ইকনোমিক জোনেও গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে। সে লক্ষ্যেও প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামের সীতাকু- পর্যন্ত পাইপ লাইন স্থাপন সম্পন্ন না হওয়ায় প্রথমদিকে গ্যাস সরবরাহ করা হবে চট্টগ্রাম নগরীতে। এক্ষেত্রে গুরুত্ব পাবে ক্যাপটিভ পাওয়ার ইউনিটগুলো। নিকট ভবিষ্যতে চট্টগ্রামের চাহিদা মিটিয়ে এই গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। কেননা, যে পরিমাণ গ্যাস আমদানি হচ্ছে তা চট্টগ্রামের চাহিদার চেয়ে বেশি। মহেশখালীতে এলএনজির প্রথম চালান আসার আগে চট্টগ্রামে এসে পৌঁছেছিল আরও ৫টি টাগ। ডাইডকে এগুলো অবস্থান করছে। এই টাগগুলো ব্যবহৃত হবে বাঙ্কারিং এবং ক্রুদের আনা নেয়ার কাজে। প্রসঙ্গত, এলএনজি নিয়ে আসা বিশেষায়িত প্রথম জাহাজে রয়েছেন ক্যাপ্টেনসহ ৩০ জন ক্রু ও নাবিক। দেশে দীর্ঘ সময় ধরে তীব্র গ্যাস সঙ্কট থাকায় ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে এলএনজি আমদানির দাবি ছিল অনেক দিন ধরে। শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান সরকার যুগান্তকারী এই পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১৫৬ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। দৈনিক ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে পাইপ লাইনে। এই লক্ষ্যে পেট্রোবাংলা এবং এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সাক্ষরিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের কাতার থেকে এলএনজির প্রথম চালান চলে আসার খবরে বিভিন্ন ট্রেডবডি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও এক ধরনের স্বস্তি ফিরে আসে। কেননা, গ্যাসের তীব্র সঙ্কটে ঠিকভাবে জ্বলছিল না রান্নার চুলা। শিল্প কারখানায় উৎপদানও ব্যাহত হচ্ছিল। সার উৎপাদনের জন্য বন্ধ রাখতে হয় বিদ্যুত কেন্দ্র। আবার বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য শাটডাউন দিতে হয় সার কারখানায়। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের অপারেশন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরীতে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে কেজিডিসিএল সরবরাহ করতে পারে সর্বোচ্চ ২১০ মিলিয়ন ঘনফুট। খাগড়াছড়ির স্যামুতাং গ্যাসফিল্ড থেকে পাওয়া যায় ২শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বাকি গ্যাস জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ করা ছিল খুবই কঠিন বিষয়। কেননা, প্রয়োজনের তুলনায় গ্যাস উত্তোলন অনেক কম। এখন দৈনিক ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি যুক্ত হলে বাড়তি গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ করা সম্ভব হবে।
×