ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফেসবুক, ইউরোপের জিডিপি রেগুলেশন এবং আমাদের সতর্কতা

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৫ এপ্রিল ২০১৮

ফেসবুক, ইউরোপের জিডিপি রেগুলেশন এবং আমাদের সতর্কতা

ফেসবুকের অপব্যবহার করে ভুয়া পোস্টিং দিয়ে যখন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, পাবনার সাঁথিয়া এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছিল তখন আমি বাংলাদেশের স্থানীয় পত্রিকায় ‘ফেসবুকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মামলা করা উচিত’ এবং ‘রসরাজের পরিবারকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা উচিত’ শিরোনামে দুটো কলাম লিখেছিলাম। এমনকি ফেসবুকের কর্ণধার জাকারবার্গের কাছে তথ্যপ্রমাণসহ সরাসরি এক প্রতিবাদপত্র পাঠিয়ে ফেসবুক অপব্যবহারের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ প্রদানের অনুরোধ করেছিলাম। সেইসঙ্গে নির্বিচারে ভুয়া ও আপত্তিকর পোস্টিং দেয়ার ব্যাপারে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ বা এডিটিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জাকারবার্গকে সরাসরি আহ্বানও জানিয়েছিলাম। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাও যেমন ফেসবুক কর্তৃপক্ষের নিকট পৌঁছায়নি, তেমনি এর কর্ণধার জাকারবার্গও আমার মতো এক অতি নগণ্যের লেখা পত্রটিও একটি আবর্জনা বা ট্র্যাস পেপার মনে করে ছুড়ে ফেলেছেন নিশ্চয়ই। তবে আমার মতো অনেকেই ফেসবুকের এমন নিয়ন্ত্রণবিহীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পরিচালনা করে ভুয়া পোস্টিং-এর সুযোগ অবারিত করে দেয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করেছেন অনেক দিন থেকেই। তাদের অনেকেই ফেসবুকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। তাদেরই একজন হলেন অস্ট্রিয়া বংশোদ্ভূত ইউরোপের উঠতি আইনজীবী ম্যাক্স স্ক্রেমস। ফেসবুক অবশ্য শুধু আমাদের মতো অতি সাধারণের আহ্বানকেই অবজ্ঞা করেছে তেমন নয়, তারা বিশ্বের কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তিকেও পাত্তা দেয়নি। ফেসবুক কোনরকম ব্যাপক বিনিয়োগ ছাড়াই অতি অল্প সময়ে বিশ্বের সেরা পাঁচটি ধনী কোম্পানির একটি হওয়ায় তারা পৃথিবীর কোন ব্যক্তি বা দেশকেই গোনায় ধরত না। তাছাড়া এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ কোম্পানি হওয়ায় তাদের মধ্যে সমগ্র বিশ্ববাসীকে অবজ্ঞা করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্রাতিরিক্ত। বাংলাদেশ সরকার ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক আবেদন-নিবেদন করেছিল তাদের পরিচালিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া ও আপত্তিকর পোস্টিং বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। কিন্তু তারা সেই আবেদনে সারা দেয়নি। জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মেরকেলের অনুরূপ আবেদনকেও ফেসবুক কর্ণধার জাকারবার্গ আমলে নেয়নি। এ নিয়ে জাকারবার্গের সঙ্গে এ্যাঞ্জেলা মেরকেলের সরাসরি সাক্ষাত এবং আলোচনাও হয়েছিল; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এমনকি অতি সম্প্রতি ফেসবুক এবং ক্যামব্রিজ এনালিটিকার মধ্যে ডাটা হস্তান্তরকে কেন্দ্র করে যে জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হওয়ায় বিশ্বব্যাপী তোলপাড় হয়ে গেল, তার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্যের সংসদীয় কমিটি জাকারবার্গকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ডেকে পাঠালে জাকারবার্গ তাতে সারা দেয়নি। অবশেষে সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটির ডাকে সারা দিয়ে সেই কমিটিতে হাজির হয়ে দোষ স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং ক্ষমাও চেয়েছে। মার্কিনীদের চরিত্রই এমন। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের নিজেদের স্বার্থে আঘাত না লাগবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা চুপ করে থাকবে, তা সে যত বড় অন্যায়ই হোক না কেন। আর তাদের স্বার্থে আঘাত লাগলে তারা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে এবং ব্যবস্থা নিতে উঠেপড়ে লাগবে, তা যদি খুব সামান্য বা তুচ্ছ ঘটনাও হয়। ফেসবুকের অপকর্মে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মার্কিনীরা। কেননা প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন আমেরিকানের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি হয়ে গেছে অন্যত্র। ফলে এবার মার্কিন প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে এবং ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অন্যান্য তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ডিজিটাল এনভায়রনমেন্টাল এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবছে জোরেশোরে। অস্ট্রিয়ার সেই তরুণ আইনজীবী ম্যাক্স স্ক্রেমস দীর্ঘদিন ধরেই ফেসবুকের এই নিয়ন্ত্রণবিহীন পথ চলা, ভুয়া পোস্টিং দেয়া, খুব সহজে যে কারও চরিত্র হনন করা এবং ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে বাণিজ্য করার মতো কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে আসছেন। সংগ্রহ করছিলেন প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ। ফেসবুকের বিরুদ্ধে এই আইনজীবীর ক্ষোভ প্রচ- বাড়িয়ে দেয় ২০১১ সালের একটি ঘটনা। তখন ছাত্র বিনিময় কর্মসূচীর আওতায় ইউরোপের এক ছাত্রী আমেরিকার শান্তা কারলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার সময় সে ফেসবুকের ভুয়া পোস্টিংয়ের কারণে হয়রানির শিকার হয়। এই ঘটনার প্রতিকার চেয়ে তিনি আইনী লড়াই শুরু করতে চেয়েছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যে ফেসবুকের কাছে সহযোগিতা চেয়ে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তার সেই অনুরোধে সারা দেয়নি এই কারণে যে, এটা তাদের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গের শামিল হবে। ফলে সেই তরুণ আইনজীবী বিষয়টি নিয়ে আর বেশিদূর এগোতে পারেননি। এখন তিনি সরব হয়েছেন এবং ফেসবুকের বিরুদ্ধে বড় ধরনের মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেননা ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি যে জেনারেল ডাটা প্রোটেকশন রেগুলেশন জারি করেছে তার অধীনে তিনি খুব সহজেই ফেসবুকের বিরুদ্ধে বড় ধরনের মামলা দায়ের করতে সক্ষম হবেন। এ ব্যাপারে তিনি অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছেন। মামলা পরিচালনার খরচ মেটানোর জন্য প্রায় তিন লাখ ইউরো সংগ্রহও করেছেন তিনি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাধারণ তথ্য সংরক্ষণ বিধান বা জেনারেল ডাটা প্রোটেকশন রেগুলেশন সংক্ষেপে জিডিপিআর প্রণয়ন করেছে, যা আগামী পঁচিশে মে তারিখ থেকে কার্যকর হবে। ইউরোপের জারি করা রেগুলেশনটি যথেষ্ট কঠোর। কেননা এই বিধানের অধীনে অভিযুক্ত কোম্পানিকে তার সার্বিক রাজস্বের (গ্লোবাল রেভিনিউ) ৪ শতাংশ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে। ফেসবুকের তথ্য কেলেঙ্কারির ঘটনা এই রেগুলেশন কার্যকর হওয়ার পর অর্থাৎ আগামী পঁচিশে মের পর ফাঁস হলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে প্রায় দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হতো। তাছাড়া এই রেগুলেশনে তথ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলো এমনভাবে বিস্তৃত করা হয়েছে যাতে করে মানুষের জীবনের হেন কোন বিষয় নেই যা এই রেগুলেশনের আওতায় পড়বে না। কারও ব্যক্তিগত ঠিকানা, ক্রেডিট কার্ড নম্বর, ভ্রমণ সংক্রান্ত কাগজপত্র অর্থাৎ পাসপোর্ট, এয়ার টিকেট, ধর্মীয় বিষয়, ইন্টারনেটে কোন ওয়েবসাইট সার্চ করার রেকর্ড, কম্পিউটার ব্যবহারকারীর আইডি, বায়োমেট্রিক তথ্যসহ এমন অনেক কিছুই এই রেগুলেশনের আওতায় আনা যাবে। এই রেগুলেশনের ফলে ইউরোপিয়ানদের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে কাজ করা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। এমনকি ইন্টারনেটে ব্রাউজ করে যে কোন ওয়েবসাইট সার্চ করাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা ইউরোপের জিডিপি রেগুলেশনের কারণে বিশ্বের অধিকাংশ কোম্পানি বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কেননা বর্তমান যুগে সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করে থাকে। এক গবেষণায় জানা গেছে, ইউরোপের এই রেগুলেশন মেনে চলতে হলে বিশ্বের বড় বড় পাঁচশত কোম্পানিকে সাত বিলিয়নেরও বেশি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হবে। এই আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। কেননা তাদের একদিকে যেমন কোনরকম প্রস্তুতি নেই বললেই চলে, অন্যদিকে তেমনি অন্য দেশ বা অঞ্চলের আইন নিয়ে ভাবনা-চিন্তার কোন অভ্যাসও নেই। ইউরোপের এই রেগুলেশন মেনে চলার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদেরও বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এই রেগুলেশন মেনে চলার ক্ষেত্রে যে সমস্ত কোম্পানি তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে, বিশেষ করে যারা আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছেন তারা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারেন। কেননা অধিকাংশ আউটসোর্সিংয়ের কাজই হচ্ছে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে। তাই আউটসোর্সিংয়ের কাজে নিয়োজিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইউরোপের এই নতুন রেগুলেশন ভাল করে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনে একজন আইন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে আউটসোর্সিং প্রদানকারী বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে এই রেগুলেশনের কার্যকারিতার বিষয়টি পরিষ্কার করে নিতে হবে। এ ব্যাপারে আউটসোর্সিং সংক্রান্ত চুক্তিপত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশনা বা ডিসক্লেইমার থাকা বাঞ্ছনীয় যে, তারা শুধু আউটসোর্সিং প্রদানকারী কোম্পানি প্রদত্ত কাজ তাদেরই নির্দেশ মোতাবেক সম্পন্ন করছেন। তাই এ সংক্রান্ত কোনরূপ প্রশ্ন উঠলে বা কোন দেশের কোন আইন লঙ্ঘিত হলে তার দায়-দায়িত্ব সেই আউটসোর্সিং প্রদানকারী কোম্পানির উপরই বর্তাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোন কোম্পানি বা ব্যক্তির দায়-দায়িত্ব থাকবে না। পাশাপাশি আমাদের সরকারেরও উচিত হবে এরকম একটি আইন পাস করা, যার অধীনে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। ইউরোপের কোন নাগরিক ফেসবুকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফেসবুকের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় কর্তৃপক্ষ তাদের জারি করা রেগুলেশনের অধীনে ব্যবস্থা নিতে পারবে। তেমনি ফেসবুকের কারণে কোন বাংলাদেশী ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশও তার প্রণীত আইনের অধীনে ফেসবুকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেÑ এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশের উচ্চ আদালত ইতিমধ্যে ফেসবুক এবং টুইটার থেকে রাজস্ব বা লেভি আদায় করার জন্য এক নির্দেশনা জারি করেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভাল খবর। তবে প্রচলিত আইন না থাকলে শুধু আদালতের নির্দেশে কতটা সফলতা আসবে তা বলা কঠিন। তাই সরকারের উচিত এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সদ্য প্রণীত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডিজিপি রেগুলেশনটি ভালভাবে পর্যালোচনা করে আমাদের সরকারও একটি অনুরূপ আইন প্রণয়ন করতে পারে, যার অধীনে ফেসবুকসহ যে কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। উল্লেখ্য, ফেসবুকের অপব্যবহারের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ এবং এখনও হয়ে চলেছে। সম্প্রতি কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্বার্থান্বেষী মহল সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করেছিল এই ফেসবুকের মাধ্যমে ছাত্র মারা যাওয়ার বা কোন ছাত্রীর পায়ের রগ কাটার গুজব রটিয়ে। ফেসবুকের সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারির প্রেক্ষিতে এখন দেশে দেশে যেহেতু আইন প্রণয়নের প্রচেষ্টা চলছে, তাই এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশেও এখন এরকম একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ বর্তমান সরকার গ্রহণ করবে বলে সবার দৃঢ় বিশ্বাস। লেখক : ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা [email protected]
×