ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অতঃপর আশ্রয়- ‘আমেরিকান ড্রিম’

প্রকাশিত: ০৭:৩২, ২৪ এপ্রিল ২০১৮

অতঃপর আশ্রয়- ‘আমেরিকান ড্রিম’

শুরু থেকেই বলে আসছিলেন সীমানাবিহীন এক বিশ্ব সম্প্রদায়ের কথা। মানুষে-মানুষে সংযোগ স্থাপনের কথা। এই স্লোগানের ওপর দাঁড়িয়ে ফেসবুক প্রধান জাকারবার্গ আজ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের অন্যতম। বিস্ময়কর উত্থান। অভিযোগ ছিল বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহারের। কখনও ক্ষমা চেয়ে, কখনও অস্বীকার করে পার পেয়ে গিয়েছেন এতদিন। কিন্তু ক্যামব্রিজ এ্যানালাইটিকা কা-ে পারেননি দায় এড়াতে। ভুল স্বীকার, ক্ষমা প্রার্থনা, সংশোধনের প্রতিশ্রুতি কাজে আসেনি কিছুই। কংগ্রেস সদস্যদের ধেয়ে আসা প্রশ্নের তীরের মুখে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিলেন ‘আমেরিকান ড্রিম’ আর পুরনো ‘রাশিয়া জুজু’র। এ এক অন্য জাকারবার্গ। লিখেছেন- পপি দেবী থাপা বলা যায় বিশ্বের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য তার নখদর্পণে। অথচ আগের রাতে তিনি কোন হোটেলে ছিলেন, গত এক সপ্তাহে কাকে-কাকে তিনি মেসেজ করেছেন, সেটাও তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার! কিছুতেই তা জানাতে রাজি নন ফেসবুক প্রধান মার্ক জাকারবার্গ। দু’বার ঢোক গিলে এক বার গ্লাসে চুমুক দিয়ে, বোকা বোকা হাসির ফাঁকে আমতা আমতা করে কংগ্রেস সদস্যদের উপরোক্ত প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘না, কোন ভাবেই না।’ অথচ তারই সংস্থা থেকে বেহাত হয়ে গিয়েছে প্রায় ৯ কোটি নেটিজেনের ‘ব্যক্তিগত তথ্য’। এমনকি তার নিজেরও! মার্কিন কংগ্রেসে এমন দাবি করেছেন তিনি নিজেই। তবে কিছুতেই চিড়ে ভেজেনি ক্যাপিটল হিলে। যৌথ শুনানি তাকে ঘণ্টা পাঁচেক একনাগাড়ে বিঁধেছেন ৪২ জন সিনেটর। শুনানি হয় মঙ্গলবার ও বুধবার সকালে। তবে মঙ্গলবার তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ৪ ইঞ্চি ‘বাড়তি গদি’-ও চেয়ারে বসে যে রোবট-সুলভ জাকারবার্গকে দেখা গেল, তা দেখে অনেকেরই অভিমত, ‘লোকটা ভাঙলেও, মচকানোর বান্দা নয়।’ জাকারবার্গ যখন ক্যাপিটল হিলে পা রাখছেন, বাইরে তখন ছেলেমেয়েদের ভিড়। তাদের টি-শার্টে ছাপানো #ডিলিটফেসবুক। কারও চোখে আবার ঢাউস রোদচশমা। তাতে লেখা, ‘স্টপ স্পাইং’। ব্যবহারকারীদের ওপর নজরদারি চালিয়ে তথ্য চুরির পাশাপাশি, দেশ-বিদেশের নির্বাচন প্রভাবিত করার অভিযোগে বিদ্ধ ফেসবুক। ঘৃণা ছড়াতে ভুয়া খবরের পেছনেও ফেসবুকের ‘কালো হাত’ রয়েছে বলে দাবি একাধিক মানবাধিকার সংগঠনের। শুনানিতে সব ‘ভুল’ স্বীকার করে নিলেও, এ জন্য রাশিয়াকেই এক হাত নেন ফেসবুক কর্তা। মার্কিন ভোটে রুশ হস্তক্ষেপ নিয়ে কংগ্রেসে প্রশ্ন উঠতেই জাকারবার্গ বলেন, ‘আমাদের আসল লড়াইটা রাশিয়ার হ্যাকারদের সঙ্গে। রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে আমাদের। এও যেন অস্ত্র প্রতিযোগিতা।’ তার দাবি, আগামী দিনেও ফাঁদ পাততে পারে মস্কো। রুশ হস্তক্ষেপ নিয়ে তদন্ত চলছে এই যুক্তি দেখিয়ে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি জাকারবার্গ। তবে জানিয়েছেন, গোড়া থেকেই তদন্তে সহযোগিতা করছে ফেসবুক। সিনেটরদের একাংশ অবশ্য তার রাশিয়া জুজুর কথা পুরোপুরি মানতে চাননি। কারণ অভিযোগ, ক্যামব্রিজ এ্যানালাইটিকাকে ওই তথ্য নিজেরাই বেচে দিয়েছিল ফেসবুক। জাকারবার্গের দাবি, তথ্য বেহাত হয়ে যাওয়ার কথা ২০১৫তে জানতে পারেন তিনি। কিন্তু এর পরেও ব্যবহারকারীদের কেন সতর্ক করা হয়নি, তার কোন সদুত্তর দিতে পারেননি ফেসবুক কর্তা। ঘুরেফিরে সেই একই কথা ‘ফেসবুক আমার সংস্থা। সব দায় আমার। তবে ভবিষ্যতে এমন যাতে না হয়, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আমার সহকর্মীরা।’ সেনেটররা ফেসবুকের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা তুললে সুর নরম রেখে জাকারবার্গ বলেন, ‘সঠিক নিয়ন্ত্রণ আরোপে তার আপত্তি নেই।’ যদিও সঠিক নিয়ন্ত্রন বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন সে প্রশ্ন থেকেই গেল। তবে কি সঠিক নিয়ন্ত্রনের শর্তও তিনিই ঠিক করে দিতে চান! অন্যদিকে, এ্যানালাইটিকার অন্যতম শীর্ষ কর্তা আলেকজান্ডর টেলার জানিয়েছেন ইস্তফা দেওয়ার কথা । তদন্তের আওতায় আনা হবে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিকেও। জাকারবার্গের দাবি, শুরুতে একবার এ্যানালাইটিকা সব তথ্য মুছে ফেলার কথা বলেছিল। কিন্তু তা মেনে নেওয়া যে ভুল হয়েছিল, স্বীকার করেন ফেসবুক-কর্তা। জাকারবার্গেরই অপর সংস্থা হোয়াটসঅ্যাপের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছিল। তবে শুনানীতে তিনি আশ্বস্থ করেছেন, এই অ্যাপ সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। এর ম্যাসেজ ফেসবুক সিস্টেমের নজরের বাইরে। যে যাই বলুক এখনও ফেসবুক মানে জাকারবার্গ। তিনিই সর্বেসর্বা। তাই ফেসবুক থেকে তাকে ছাঁটাইয়ের প্রশ্নই ওঠে না। সংবাদমাধ্যমের একাংশের অবশ্য দাবি, এ দিন তিনি তার ইস্তফা-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দিতেও তৈরি হয়ে এসেছিলেন। তার নোটবইয়ে নাকি লেখা ছিল, বাইরের কিছু এ্যাপই যে গন্ডগোল পাকাচ্ছে, তা এ্যাপল-কে জানানো সত্ত্বেও তারা সেটা নিজেদের গ্রাহকদের জানায়নি। ভাবটা এমন, ‘দোষ কি আর আমার একার!’ জাকারবার্গকে এটা মুখে বলতে হয়নি, শুনানির বিরতিতে নিজের নোটবইটা শুধু খোলা রেখে চেয়ার ছেড়েছিলেন তিনি। ন’কোটি নেটিজেনের ‘ব্যক্তিগত তথ্য’ তার সংস্থা থেকে বেহাত হয়েছে। এ নিয়ে তোলপাড় সোশ্যাল মিডিয়া। এই অভিযোগ সত্ত্বেও তার সংস্থার ওপর আস্থা হারাননি নেটিজেনরা। মার্কিন সিনেটের শুনানীতে এমন দাবিই করেছেন ফেসবুক কর্তা মার্ক জাকারবার্গ। কংগ্রেস সদস্য ডানা লুইস ডিগেট যখন জাকারবার্গের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ক্যামব্রিজ এ্যানালিটিকা কাণ্ডের পওে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা ভয় পেয়ে বেশি করে তাদের এ্যাকাউন্ট ডিএ্যাক্টিভেট করে দিচ্ছেন কি না। এবারে দেখা গেল অন্য এক জাকারবার্গ। দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী। ফেসবুক প্রধান স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, তেমনটা হয়নি মোটেও। তথ্য চুরির অভিযোগে বিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও নেটিজেনরা তাদের ফেসবুক এ্যাকাউন্ট ডিলিট বা ডিএ্যাক্টিভেট করেননি। সেনেটের বিচারবিভাগীয় এবং বাণিজ্য বিষয়ক কমিটিকে একই সঙ্গে জাকারবার্গ জানিয়েছেন, ক্যামব্রিজ এ্যানালাইটিকা তার কিছু ব্যক্তিগত তথ্যও ব্যবহার কওে সেগুলি বিক্রি করে দিয়েছিল। এবং ব্রিটিশ ওই সংস্থার বিরুদ্ধে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বা ব্রেক্সিট শুধু নয়, ভারতের একাধিক ভোটেও ফেসবুক-এ্যানালিটিকার যোগসাজশের অভিযোগ উঠে এসেছে। শুনানির প্রথম দিনে মার্কিন কংগ্রেসে কার্যত তা মেনে নিয়েই মার্ক জাকারবার্গ জানালেন, এমন ভুল আর হবে না। তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা এবং নির্বাচনে তৃতীয় পক্ষের দখলদারি ঠেকাতে ইতোমধ্যেই ফেসবুকের বোর্ড মিটিং হয়েছে বলেও জানান তিনি। ২০১৮ ও ২০১৯-এ ভোট রয়েছে ভারত, পাকিস্তন, মেক্সিকো এবং হাঙ্গেরিতে। প্রশ্ন উঠছে, তবে কি ফেসবুকে ইউজারদের তথ্য সুরক্ষিত নয়? তবে কি ভারতের নির্বাচনেও সে রকম কিছু ঘটতে পারে? মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে জাকারবার্গ বলেছেন, ‘সামনেই ভারত, পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটা দেশে সাধারণ নির্বাচন রয়েছে। সেই ভোট প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য আমরা চেষ্টা করব।’ সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মেনেই ফেসবুক-প্রধান জানান, জাল প্রোফাইল শনাক্ত করতে নতুন ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে। কোথাও কোন মিথ্যা সংবাদ ছড়ানো হচ্ছে কি না, তাও খতিয়ে দেখবে ফেসবুক। প্রয়োজনে ব্যবস্থাও নেয়া হবে বলে জানান জাকারবার্গ। কেমব্রিজ এ্যানালিটিকার প্রাক্তন কর্মী ক্রিস্টোফারর ওয়াইলি জানিয়েছেন, ফেসবুক থেকে যে তথ্য হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে, তা তিনি অনেকদিন আগেই আঁচ করেছিলেন। তার আশঙ্কা, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোটে জেতানোর জন্য সেই তথ্য ব্যবহার করেছিল রাশিয়া। শুনানিকে কেন্দ্র করে গোটা দুনিয়ার চোখ ছিল মার্কিন কংগ্রেসের দিকে। তথ্য ফাঁসের ঘটনায় ফেসবুকের সিইও জাকারবার্গকে ঠিক কতটা চেপে ধরবেন মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরা, তা নিয়েও জল্পনা ছিল তুঙ্গে। মঙ্গলবার, প্রথম দিনের শুনানিতে কিন্তু দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন মার্ক জাকারবার্গ তার কথায়, ‘কেমব্রিজ এ্যানালিটিকার ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি। কথা দিচ্ছি এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না।’ আগেও ফেসবুক থেকে তথ্য ফাঁসের দায় নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন জাকারবার্গ। মার্কিন কংগ্রেসের সামনে তিনি এ দিনও তিনি বলেছেন, ‘আমি ফেসবুক তৈরি করেছি। ফেসবুকের যাবতীয় দায় আমার। যে ভুল হয়েছে, সে জন্য আমি দুঃখিত। শেষ বেলায় অবশ্য খোলস ছাড়লেন জাকারবার্গ। বুক চাপড়ে বলেন, ফেসবুকের মাধ্যমে তিনি ‘আমেরিকার স্বপ্ন’কেই সার্থক করেছেন অর্থাৎ সেই পুরনো রাজনৈতিক বড়ি- ‘আমেরিকান ড্রিম’। সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়েন বাণিজ্য কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর জন থুনে। আবার হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেন, ‘আপনার এই স্বপ্ন, যেন সাধারণ মানুষের দুঃস্বপ্নের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।’ এ কথা সত্যি যে, প্রযুক্তির ভাল-মন্দ দুটো দিক আছে। ব্যবহারকারীরা তা কীভাবে ব্যবহার করবেন তা সব সময় ¯্রষ্টার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। বিগত কিছুদিন ধরেই বিশ্বের নানা প্রান্তে, বিভিন্ন ঘটনায় ফেসবুকের অপব্যবহারের অভিযোগ উঠছিল। এর সব দায় জাকারবার্গের এমনটা বলাও সঙ্গত নয়। তবে যা তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন তা না করা, বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহারকারীদের তথ্যের অপব্যবহারের মতো অভিযোগগুলো তাকে তাড়িয়ে ফিরবে অনেকদিন- এটি নিশ্চিত।
×