ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বব্যাংকের উইমেন বিজনেস এন্ড ল রিপোর্ট

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এখনও বৈষম্যের শিকার নারী

প্রকাশিত: ০৬:২১, ২৪ এপ্রিল ২০১৮

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এখনও বৈষম্যের শিকার নারী

আনোয়ার রোজেন ॥ কিশোরগঞ্জ সদরের সরকারী গুরুদয়াল কলেজে স্নাতক শ্রেণীতে পড়াশোনা করছেন নাঈমা ইয়াসমিন। নিকলীর প্রত্যন্ত হাওড় থেকে এ পর্যন্ত আসতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে নাঈমাকে। দরিদ্র বাবার পক্ষে মেয়ের থাকা-খাওয়ার খরচ বহন করা সবসময় সম্ভব হয় না। জেলা শহর হলেও সার্বিকভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগও এখানে সীমিত। তারপরও একটি মুঠোফোন কোম্পানির কাস্টমার কেয়ারে কাজ জুটিয়ে নিয়েছেন নাঈমা। এই কাজের আয় থেকে নিজের খরচ নিজেই চালাতে পারেন। নাঈমার মতো আরও অনেক নারী এখন লেখাপড়ার পাশাপাশি কর্মমুখী। গ্রাম-মফস্বল শহরে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণও দিন দিন বাড়ছে। সরকার গৃহীত নারীর ক্ষমতায়ন কর্মসূচী নারীদের সক্ষমতার দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। তবে কিছু সমস্যা এখনও রয়েই গেছে। নারীর ক্ষমতায়নের পথটি এখনও মসৃণ হয়ে ওঠেনি। কাস্টমার কেয়ারের চাকরিটি পেতে নাঈমা পারিপার্শি¦ক অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন। যেখানে একই চাকরি পেতে নাঈমার পুরুষ সহকর্মীকে তেমন কোন বাধার মুখোমুখি হতে হয়নি। বিশ্ব ব্যাংকের উইম্যান বিজনেস এ্যান্ড ল রিপোর্ট-২০১৮ এ এমনটাই বলা হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণের পথে এবং অংশগ্রহণের পর বাংলাদেশে নারীরা বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এটা আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক (ফরমাল-ইনফরমাল) দুই ধরনের কর্মক্ষেত্রেই বিদ্যমান। প্রতিবেদনে জেন্ডার সমতা পরিমাপে ব্যবহার করা হয়েছে সাতটি সূচক। এসব সূচকে ০ থেকে ১০০ এর মধ্যে স্কোরিং করা হয়েছে। সূচকগুলোর সম্মিলিত স্কোরে বাংলাদেশের অর্জন ৩৬৯, যা সার্কভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে ষষ্ঠ অবস্থানে নিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে কেবল পাকিস্তান (স্কোর ৩২৯) এবং আফগানিস্তানের ( স্কোর ৩১৪) চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। পঞ্চমবারের মতো প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে বিশ্ব ব্যাংক। প্রতি দুই বছর পরপর এটি প্রকাশিত হয়। এবারই প্রথম বারের মতো ০ থেকে ১০০-এর মধ্যে স্কোরিং পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। সূচকগুলো হচ্ছে- বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানে নারীর বাধাহীন প্রবেশাধিকার, সম্পত্তির অধিকার বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্তি, চাকরি লাভের বা কর্মসংস্থানের সুযোগ, কাজ করার জন্য প্রণোদনা প্রদান, আইনী সহায়তা পাওয়া, ঋণ প্রাপ্তি বা মূলধন নির্মাণ এবং সহিংসতা থেকে নারীদের রক্ষায় আইনী প্রতিকার। সিডও সনদ, মানবাধিকার ও প্রচলিত আইনের ভিত্তিতে প্রতিটি সূচকের অধীনে নারীর অধিকার সম্পর্কিত বেশ কিছু প্রশ্ন করা হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট শ্রম শক্তির ২৯ শতাংশ নারী, যা ভারত (২৫ শতাংশ) এবং পাকিস্তানের (২২ শতাংশ) তুলনায় বেশি। প্রতিবেদনের সূচক অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীর প্রবেশাধিকারে বাংলাদেশের স্কোর ১০০। এক্ষেত্রে পাসপোর্ট তৈরি, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তি, দেশের বাইরে ভ্রমণ, চাকরি প্রাপ্তি, চুক্তি সইয়ের ক্ষমতা, ব্যবসা খোলা, ব্যাংক এ্যাকাউন্ট চালু করা, পরিবারের প্রধান হওয়া ইত্যাদি কাজগুলো পুরুষের অনুরূপ করতে পারেন কি না তা যাচাই করা হয়েছে। সম্পত্তির অধিকার সূচকে স্কোর ৪০। এক্ষেত্রে সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়ের সমান অধিকার এবং সম্পত্তিতে স্বামী এবং স্ত্রীর সমান উত্তরাধিকার নিশ্চিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। চাকরি লাভের সুযোগের ক্ষেত্রে স্কোর ২৯। কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য মানসম্মত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, গর্ভবতী নারীর চাকরি সুরক্ষা, সব ধরনের পেশায় অংশগ্রহণের সুযোগ বাংলাদেশ এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি। এছাড়া কাজ করার জন্য প্রণোদনা পাওয়ার ক্ষেত্রে ৪০, আদালতের সেবা পাওয়ার সুযোগ-সুবিধায় ১০০, সহিংসতা থেকে নারীদের রক্ষার ক্ষেত্রে আইনী প্রতিকারে স্কোর ৬০। তবে ঋণ প্রাপ্তি এবং মূলধন বিনির্মাণে বাংলাদেশ কোন স্কোর অর্জন করতে পারেনি। ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য নারী-পুুরুষ বৈষম্য এবং নারীর বৈবাহিক অবস্থাভেদে ঋণপ্রাপ্তিতে বৈষম্যের কারণে বাংলাদেশের স্কোর ০। অবশ্য এই সূচকে মালদ্বীপ (৫০) ছাড়া সার্কভুক্ত অন্য সাতটি দেশের স্কোর বাংলাদেশের মতোই শূন্য। সূচকগুলোর সম্মিলিত স্কোরে জেন্ডার সমতায় দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে মালদ্বীপ (৪৬৭)। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে ভারত (৪৬০) এবং শ্রীলঙ্কা (৪৫৮)। এরপরের অবস্থানে আছে ভুটান (৪২০), নেপাল (৩৯২), বাংলাদেশ (৩৬৯), পাকিস্তান (৩২৯) এবং আফগানিস্তান (৩১৪)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্যের কারণে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে দক্ষিণ এশিয়া পিছিয়ে পড়ছে। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়াতে নারীকে চাকরি উদ্যোক্তা হতে সব চেয়ে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক আইন ও সামাজিক ব্যবস্থা দায়ী। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নারীদের ভারি জিনিস বহন বা উত্তোলনের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা চালু রয়েছে। এ অঞ্চল এসব সংস্কার কার্যক্রমে পিছিয়ে রয়েছে। প্রতিবেদনের ভূমিকায় বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্রিস্টালিনা জর্জিয়াভা বলেছেন, অর্থনৈতিক কর্মকা-ে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এখনও নারীকে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। কেবল নারী হওয়ার কারণে বিশ্বের ১০৪টি দেশ এখনও কিছু সুনির্দিষ্ট চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণের অনুমতি নেই। কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন রোধে কার্যকর কোন আইন নেই ৫৯টি দেশে। ১৮টি দেশে স্ত্রী চাকরি করতে পারবে কি পারবে না সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আইনগতভাবে স্বামীর। তিনি আরও বলেন, চীন, লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলমান যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন প্রমাণ করে কর্মক্ষেত্রে নারীরা নিয়মিতভাবেই যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। যদিও এসব ক্ষেত্রে তাদের আইনগত প্রতিকার পাওয়ার কোন সুযোগ নাই। আর শ্রমবাজারে একই কাজের জন্য পুরুষের তুলনায় নারীর কম মজুরি প্রাপ্তিও নিয়মিত ঘটনা। তিনি বলেন, পছন্দ মতো চাকরি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে ২৭০ কোটির বেশি নারী বাধা প্রাপ্ত হন।
×