ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

ভাল নেই ভারতের সংখ্যালঘুরা

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৪ এপ্রিল ২০১৮

ভাল নেই ভারতের সংখ্যালঘুরা

ভারতের মুসলমান ও সংখ্যালঘুরা এখন কেমন আছে? এ প্রশ্নের জবাব হলো দুটি শব্দ ‘ভাল নেই’। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের সত্তর বছর পর মুসলমানদের ভাগ্যের উন্নতি হওয়া তো দূরের কথা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের আমলে তার আরও অবনতি ঘটেছে। সর্বত্র বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তারা । জাতীয় রাজনীতিতে মুসলমানদের অবস্থান শোচনীয়। বিগত ২০১৪-এর নির্বাচনে মুসলমানরা লোকসভায় ২২টি আসন পেয়েছে, যা স্বাধীনতার পর থেকে সর্বকালের সর্বনিম্ন। মুসলমানরা ভারতের মোট জনসংখ্যার সাড়ে ১০ শতাংশ। অথচ লোকসভায় মোট আসনে তাদের প্রতিনিধিত্ব মাত্র ৪.২ শতাংশ, যা আগে কখনও ছিল না। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোÑ গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খ- ও ছত্তিশগড়ে আরএসএসের রাজনৈতিক ফ্রন্ট বিজেপির রাজ্যবিধানগুলোতে একজনও মুসলমান সদস্য নেই। পুলিশ বাহিনীতে মুসলমানদের রিক্রুটমেন্ট যেমন কম, তেমনি খারাপ তাদের প্রতি পুলিশের আচরণ। সেনাবাহিনীতেও মুসলিম অফিসারের সংখ্যা শোচনীয় রকমের কম। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কতখানি নিরাপদÑ গণতন্ত্রকে বিচার করার এটাও এক মানদ-। ভারত বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বিশেষ করে মুসলমান ও খ্রীস্টানরা রীতিমতো বৈষম্যের শিকার। তাছাড়া তাদের সম্পর্কে নানা রকমের ভুল ও বানোয়াট তথ্যও পরিবেশন করা হয় এবং তার পরিণতিতে তাদের প্রতি করা হয় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগে মুসলমানদের পাইকারি গ্রেফতারের ঘটনাও আছে। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় অনেক হিন্দু জাতীয়তাবাদী এই সংগঠনে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধী ছিল। যদিও পরবর্তীকালে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের মতো নেতারা কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে তো গান্ধীর বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের অভিযোগও উঠেছিল। কথাটা শতভাগ মিথ্যা ছিল, তা নয়। ক্ষেত্রবিশেষে করা হলেও সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে। সপ্তম শতাব্দীতে মালাবার উপকূলে আরব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ভারতে প্রথম ইসলামের আগমন ঘটে। পরে সুফী সাধকদের হাত দিয়ে অনেকে অদ্ভুত বর্ণভেদ ব্যবস্থা ও জাতপাতের স্বৈরাচার থেকে মুক্তি পেতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এরা ছিল সমাজের আর্থ-সামাজিক স্তরের নিম্নস্তরের অন্তর্গত। আধুনিক শিক্ষা আসার পর একপর্যায়ে অভিজাত মুসলমানরা বিপুল সংখ্যায় এই শিক্ষা গ্রহণ করলেও দরিদ্র মুসলমানদের শিক্ষার জন্য তেমন কিছুই করা হয়নি। ভারত বিভাগের পর বিত্তবান ও শিক্ষিত মুসলমানদের বিরাট অংশ পাকিস্তানে চলে যায়। শিক্ষা, দীক্ষা, বিত্তে অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরের মুসলমানদের বিরাট অংশ থেকে যায় ভারতে। ভারতে থেকে যাওয়া এই মুসলমানদের জীবন ছিল দুঃস্বপ্নে ভরা। পাঞ্জাব ও বাংলার জনমিতি চিত্রটা রাতারাতি পাল্টে যায়। প্রধান এই দুই অঞ্চলসহ অধিকাংশ এলাকার মুসলমান সমাজ খ-িত হয়ে যায় এবং দক্ষিণপন্থী হিন্দুদের দাপটে কোণঠাসা ও বিপন্ন হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এই প্রচার শুরু করে যে, মুসলমানরাই ভারত বিভাগের জন্য দায়ী। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক গ্রুপগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্টতাকে জনপ্রিয় করে তোলে। সেই সঙ্গে চালানো হতে থাকে মুসলমান বিদ্বেষী অপপ্রচার, যা থেকে সাম্প্রদায়িক হিংসার ভিত্তি রচিত হয়। সহিংসতার সংখ্যাগরিষ্ঠ শিকার ছিল গরিব মুসলমানরা। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মুসলমান সম্প্রদায়কে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। ফলে তারা ক্রমশ অন্তর্মুখী হয়ে ওঠে। তাদের বিরুদ্ধে বারংবার সহিংসতার কারণে নিরাপত্তার ওপর তাদের গুরুত্বটা সমতার ইস্যুর ওপর প্রাধান্য লাভ করে। এতে শিক্ষার দিকটা উপেক্ষিত হয়। গত কয়েক দশকে বিশেষ করে নাইন ইলেভেনের পর বেশিরভাগ সন্ত্রাসী হামলায় অনেক নিরীহ মুসলিম যুবককে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ কর্তৃপক্ষের একটা প্রবণতা দেখা দেয় সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভিযোগে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়। তারপর তারা পচতে থাকে জেলে। সরকারী চাকরিতে মুসলমানদের নিয়োগ নৈরাশ্য রকমের কম। দেশে মোট জনসংখ্যার তারা ১৪ শতাংশের বেশি হওয়া সত্ত্বেও সরকারী চাকরিতে তাদের নিয়োগ ৩ শতাংশের বেশি নয়। বেসরকারী খাতে মুসলমান প্রতিনিধিত্বের অবস্থানও ভাল কিছু নয়। ক্ষুদ্র কৃষক, প্রান্তিক চাষী, কৃষি শ্রমিক, ভূমিহীন শ্রমিক ইত্যাদির মতো গ্রুপগুলোর জন্য সরকারের যে বিভিন্ন স্কিম রয়েছে, মুসলমানরা তারও সুযোগ দিতে পারেনি। এর পেছনে রয়েছে কর্তৃপক্ষের বৈষম্য ও অবহেলা। ফলে মুসলমানদের কিছু অংশ ইত্যবসরে যে সীমিত অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা প্রায় সম্পূর্ণরূপে তাদের নিজেদের চেষ্টায় অর্জিত হয়েছে। বেশিরভাগ মুসলমানের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেই ঈর্ষণীয় নয়। এদের এক বড় অংশ ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্য করে কিংবা নির্মাণ শ্রমিক, রিক্সাওয়ালা, ট্যাক্সি ও ট্রাক ড্রাইভার, ঠেলাগাড়ি চালক, কুলি কামিন, দর্জি, নানা ধরনের মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করে দিন এনে দিন চালায়। প্রধানমন্ত্রী মোদি ক্ষমতায় আসার পর গত তিন বছরে ‘সব সাথ সব বিকাশ’-এর কথা বলা হলেও মুসলিম সমাজের মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়ার নীতি নেয়া হয়েছে। এর একটি দৃষ্টান্ত হলো গো হত্যা নিষেধাজ্ঞা ও গরুর মাংসের দোকান বন্ধ করে দেয়া। গো মাতাকে ঘিরে এমন এক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে, যার ফলে গরুর প্রতি ভালবাসার চেয়ে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা আরও বেশি করে সঞ্চারিত হয়েছে। আরএসএ-বিজেপির আদর্শে অনুপ্রাণিত উগ্র হিন্দু গোরক্ষকরা কয়েকজন নিরীহ মুসলমানকে হত্যা করায় একটা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মুসলমানরা আরও বেশি ভয়ভীতির মধ্যে আছে এবং তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করার উদ্যোগ পুরোদমে চলছে। গত বছরের জুন মাসে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের বেশকিছু রাজ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার জোয়ার সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ক্রমবর্ধমান ইসলাম বিদ্বেষের মধ্যে ২০১৭-এর এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে কমপক্ষে ১০ জন নিরীহ মুসলমান উগ্রবাদী হিন্দু জনতার হামলায় নিহত হয়। এতে অনেক মুসলমানের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে যায় এবং ধর্মীয় উত্তেজনাও তীব্রতর হয়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধের বেশিরভাগই ঘটেছে সে সব রাজ্য যেখানে বিজেপি ক্ষমতায় আছে এবং সেটাই অধিকতর উদ্বেগজনক। উগ্রবাদী গোরক্ষক গ্রুপগুলো অনেক ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের প্রচ্ছন্ন অনুমোদন নিয়েই কাজ করছে। ক্ষেত্র বিশেষে বিজেপি নেতারা তাদের হামলা ও অন্যান্য কর্মকা- দেখেও না দেখার ভান করেছে কিংবা হামলার যৌক্তিকতা সমর্থন করেছে। গত বছর মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেসব হামলা ও হত্যাকা- হয়েছে তার মধ্যে আছে ১ এপ্রিল রাজস্থানে পেহলু খানকে হত্যা। ডেইরি খামারের মালিক পেহলু খান (৫৫) ও আরও ৪ জন মুসলমানকে উগ্রবাদী হিন্দু জনতা গরু চোরাচালানকারী এই মিথ্যা অভিযোগে মহাসড়কে প্রচ- মারধর করে। পেহলু খান ২ দিন পর মারা যায়। ৬ এপ্রিল ঝাড়খ-ে মোহাম্মদ সালিক নামে ১৯ বছরের এক যুবককে এক হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক থাকার অপরাধে উগ্রপন্থী হিন্দুরা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে মারতে মারতে মেরেই ফেলে। ৩০ এপ্রিল অসমে আবু হানিফা ও রিয়াজউদ্দিকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা গরু চুরির সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলে। ২৬ মে মহারাষ্ট্রে দুই মুসলিম মাংস ব্যবসায়ী গোরক্ষক স্কোয়াডের দ্বারা প্রহৃত হয় স্রেফ এই সন্দেহে যে, তাদের কাছে গো মাংস ছিল। জনতা ওই দুই ব্যক্তিকে মারধরকালে জয় শ্রীরাম উচ্চারণ করতে বলেছিল। ১৬ জুন রাজস্থানে ৪৪ বছর বয়স্ক জাফর হোসেন জনতার প্রহারে মারা যায়। ২২ জুন হরিয়ানায় এক ট্রেনে আসন নিয়ে ঝগড়ার এক পর্যায়ে উন্মত্ত হিন্দু জনতা ১৫ বছরের কিশোর জুনায়েদ খানকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। হামলায় তার ভাইও গুরুতর আহত হয়। ছুরিকাঘাতে আগে জুনায়েদের মাথার টুপি ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাকে মোল্লা ও গরু-খেকো বলে গালিগালাজ করা হয়েছিল। এর দুই দিন পর পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরে ক্রুব্ধ জনতা নাসিরুল হক, মোহাম্মদ সমিরুদ্দীন ও নাসির নামে তিন নির্মাণ শ্রমিককে কথিত গরু চুরির দায়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এর পরও ২৭ জুন ঝাড়খ-ে ওসমান আনসারী নামে এক ডেইরি খামার মালিক শতাধিক লোকের এক উগ্রবাদী জনতা পিটিয়ে হত্যা করে ও তার বাড়িতে আগুন লাগায়। তার বাড়ির বাইরে একটা মৃত গরুকে দেখতে পেয়ে নাকি তারা এ ঘটনা ঘটায়। এদিকে দুটি মানবাধিকার সংগঠন মুম্বাই ভিত্তিক সেন্টার ফর স্টাডি অব সোসাইটি এ্যান্ড সেকুলারিজম (সিএসএসএস) এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ ইন্টান্যাশনাল (এমআরজি) এর যুক্ত রিপোর্টে বলা হয় যে, ২০১৭ সালে ভারতে ৭শ’রও বেশি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেছে এবং তাতে ৮৬ জন নিহত ও ২৩২ জন আহত হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক ঘটনারই খবর মিডিয়ায় আসে না। গত ৫ বছরে সাম্প্রদায়িক হামলায় খ্রীস্টান ও শিখসহ সংখ্যালঘুদের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে দেশের জনগোষ্ঠীর ১৫ শতাংশ যে মুসলমান সম্প্রদায় তাদেরই ওপর বড় ঝাপ্টা গেছে যেমন, পিটিয়ে মারা, হুমকি ধামকি, মসজিদে হামলা এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ। গত বছরের রিপোর্ট এমআরজির ডেপুটি ডিরেক্টর ক্লেয়ার টমাস বলেন, সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য দীর্ঘকাল ধরে একটা উদ্বেগের বিষয় হিসেবে রয়েছে। তবে ইদানিংকার পরিস্থিতি বিশেষভাবে মারাত্মক। রিপোর্টে বলা হয়, মোদি যদিও তার ভাবমূর্তিকে ব্যবসাবাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কেন্দ্রীক করার চেষ্টা করছেন, তথাপি তার শাসনামলে হিন্দু চরমপন্থী গ্রুপগুলোর হাত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাদের কর্মকা- ও হামলার নিন্দা করার ব্যাপারে মোদির মধ্যে এক ধরণের অনীহার ভাব দেখা গেছে। এতে এই গোষ্ঠীগুলো আরও উৎসাহিত বোধ করছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতির ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের বৈষম্য এবং তার পাশাপাশি মৌলবাদী হিন্দুদের দাপটে ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা উত্তরোন্তর অনিরাপদ বোধ করছে। সূত্র : ফ্রন্টলাইন ও অন্যান্য
×