ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৪ এপ্রিল ২০১৮

পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে অনিয়ম

প্রতি বছর সারাদেশে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও সরবরাহের কাজটি করে থাকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এটি একটি বিশাল ও ব্যাপক কার্যক্রম। যেমন, এনসিটিবি ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে চার কোটি ৩৭ লাখ ছয় হাজার ৮৯৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য মোট ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৮৫ হাজার ৯৪৯ কপি পাঠ্যবই ছেপে বিতরণ করেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সরকারী প্রতিষ্ঠানটি দক্ষতার সঙ্গে কাজটি সম্পন্ন করতে পারে না। বরং প্রতি বছরই এ নিয়ে গণমাধ্যমে তীব্র বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। যেমন, বইয়ের কাগজ নিম্নমানের, ছবিসহ ছাপার মান খারাপ, ভুলে ভর্তি, বাঁধাই নিম্নমানের, সর্বোপরি বিতর্কিত পাঠ্যসূচী, যা এমনকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এবং ধর্মান্ধতা দোষে দুষ্ট। প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতি-অনিয়মও ওপেন সিক্রেট, যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। এবারে এনসিটিবি শর্ত লঙ্ঘন করে নিম্নমানের বই মুদ্রণ ও সরবরাহের অভিযোগে ৮টি ছাপাখানাকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, সংস্থাটিতে আরও ব্যাপক পরিবর্তন, সংস্কার সর্বোপরি দুর্নীতিমুক্ত করা বাঞ্ছনীয়। দেশে যে প্রতিবছর পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ ও সরবরাহ নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে থাকে, তার ভয়াবহ ও আশঙ্কাজনক বিবরণ মেলে টিআইবির প্রতিবেদনে। উল্লেখ্য, এই কাজটির দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি। প্রতিষ্ঠানটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়টি সুবিদিত। ইতোপূর্বে মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কট্টর মতাদর্শ ও পরামর্শে পাঠ্যপুস্তকের মর্জিমাফিক পরিবর্তনসহ ভুল মুদ্রণের অভিযোগ উঠেছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। এবার উঠেছে ব্যাপক আর্থিক অনিয়মসহ দুর্নীতির অভিযোগ। বছরে দুটি উৎসব বোনাস সব সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ থাকলেও এনসিটিবির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতি বছর নিয়ে থাকেন ৬টি উৎসব বোনাস। নানা ছুঁতোয় চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে কর্মচারীরা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন সম্মানী ভাতা, যার পরিমাণ প্রায় ৩০ লাখ। প্রতি বছর পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ এবং সরবরাহের নামেও চলে ব্যাপক দুর্নীতি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ কেউ অর্থের বিনিময়েই মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে আগাম জানিয়ে দেন প্রাক্কলিত ব্যয়। কেউ কেউ এমনকি নামে-বেনামে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মালিক। পা-ুলিপি প্রণয়নের নামে স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ চাপিয়ে দেয়াসহ অফিসে বসেই শেয়ার ব্যবসা, এনজিও পরিচালনাসহ মুদ্রণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার অভিযোগও আছে। আছে নিম্নমানের কাগজ ও মুদ্রণের অভিযোগ। এর সঙ্গে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো রয়েছে বিপুল আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে সহায়ক পাঠ্যপুস্তক ও গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসা-বাণিজ্য। গোটা বিষয়টি পড়ে গেছে সিন্ডিকেটের খপ্পরে এবং এর নেতৃত্বে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। সত্যি বলতে কি এনসিটিবির এই বিষয়টি এক রকম ওপেনসিক্রেট, যা নিয়ে প্রতিবছরই বিস্তর লেখালেখি হলেও প্রায় কোন প্রতিকারই মেলে না। শিক্ষামন্ত্রী এ নিয়ে যৎসামান্য সাফাই গাইলেও প্রতিষ্ঠানটির সর্বত্র স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই বললেই চলে। এও সত্য যে, দেশের প্রবীণ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত। তাদের সবাই দুর্নীতি-অনিয়মকে প্রশ্রয় দেন, তা চিন্তা করাও বাতুলতা। অতঃপর এনসিটিবির ভাবমূর্তি রক্ষার্থে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট, সতর্ক ও উদ্যোগী হতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে।
×