ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে চিরদিনের জন্য- মুক্তিযোদ্ধারা চান স্মৃতিস্তম্ভ

দক্ষিণাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিধন্য শতবর্ষী বটবৃক্ষ

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৪ এপ্রিল ২০১৮

দক্ষিণাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিধন্য শতবর্ষী বটবৃক্ষ

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক পথে প্রথম পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ স্থানে শত বছর ধরে স্মৃতিবহন করে চলছে বিশাল আকৃতির একটি বটবৃক্ষ। প্রতিবছরের ২৫ এপ্রিল প্রতিরোধ দিবসে ওই বটবৃক্ষের নিচে নানা কর্মসূচী পালনের পাশাপাশি সরকারীভাবে যুদ্ধস্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি করে আসছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। সম্প্রতি মহাসড়ক ফোর লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু হয়েছে। এজন্য শীঘ্রই স্মৃতিবিজড়িত বটগাছটি হারিয়ে যাবে চিরদিনের জন্য। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক পথে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধস্থলে সরকারীভাবে কোন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ না করায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ২৫ এপ্রিলের সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টু পাক সেনাদের সঙ্গে তাদের সম্মুখ যুদ্ধের বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরুর পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সারা দিয়ে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের দিকনির্দেশনায় এলাকার যুব সমাজের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সৃষ্টি করে গৌরনদী কলেজের ছাত্রাবাসের সামনে বসে স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ২৫ এপ্রিল সকালে খবর আসে পাক সেনারা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে এ জনপদে প্রবেশ করছে। তাদের প্রবেশের খবর পেয়েই তৎকালীন সেনা সার্জেন্ট সৈয়দ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে সুবেদার গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ আবুল হাসেম, সৈয়দ অলিউল ইসলাম, মোক্তার হোসেন, সিপাহী আলাউদ্দিন সরদার ওরফে আলা বক্স, আব্দুল হাকিম, মোসলেম উদ্দিন, মুজিবুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক চোকদারসহ প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে পাক সেনাদের প্রতিহত করার জন্য সাউদের খালপাড় নামকস্থানের ওই বটবৃক্ষের পাশে এ্যামবুশ (যুদ্ধ প্রস্তুতি) গ্রহণ করা হয়। সকাল দশটার দিকে পাক সেনারা সেখানে পৌঁছলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সে দিনের সম্মুখ যুদ্ধে আটজন পাক সেনা নিহত ও চারজন বীর সৈনিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। এটাই ছিল দক্ষিণাঞ্চলে সড়কপথে প্রথম যুদ্ধ এবং এরা চারজনই প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। যে কারণে স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে ২৫ এপ্রিলকে গৌরনদী প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সম্মুখ যুদ্ধের পূর্বে বরিশালে প্রবেশদ্বার মুখে পাক হানাদাররা গৌরনদীর খাঞ্জাপুরে মোস্তান নামের এক পাগলকে গুলি করে হত্যা করেছিল। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টু আরও বলেন, ওইদিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটজন পাক সেনা নিহত হওয়ার পর তারা ক্ষিপ্ত হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। তাদের গুলিতে ওইদিন দুই শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসী মারা যায়। হানাদাররা গৌরনদী বন্দরসহ শত শত ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। যুদ্ধের তিনদিন পর তিনি (বুলেট ছিন্টু) কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধস্থান থেকে গৌরনদীর নাঠৈ গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবুল হাসেম, গৈলার শহীদ সিপাহী আলাউদ্দিন সরদার ওরফে আলা বক্স ও চাঁদশীর শহীদ পরিমল ম-লের লাশ উদ্ধার করে তাদের স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু দূরত্বের কারণে বাটাজোরের শহীদ মোক্তার হোসেনের লাশটি তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়নি। তাকে ধানডোবা গ্রামের একটি বাঁশ বাগানে দাফন করা হয়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ মে তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত গৌরনদীতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। দীর্ঘদিনে গৌরনদীতে নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিসৌধ। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধস্থানে কোন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ না করাসহ প্রথম চার শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি সংরক্ষণে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ, ২৫ এপ্রিলের সম্মুখ যুদ্ধ ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কথা অনেকটাই ভুলে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী জরুরী ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে ‘স্মৃতিসৌধ’ নির্মাণ এবং চার বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে এলাকার সরকারী বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এদিকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালন উপলক্ষে অদ্যাবধি সরকারীভাবে কোন কর্মসূচী পালন করা না হলেও প্রতিবছরের ন্যায় এবারও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের উদ্যোগে র‌্যালি, আলোচনা সভা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া-মিলাদ ও বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।
×