ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মৃত ঘোষিত নবজাতক নড়ে উঠল কবরস্থানে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৪ এপ্রিল ২০১৮

মৃত ঘোষিত নবজাতক নড়ে উঠল কবরস্থানে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক নবজাতককে মৃত ঘোষণার পর আজিমপুর কবরস্থানে গোসল করানোর সময় ‘নড়েচড়ে ওঠায়’ তাকে নিয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পরে সেখানে নবজাতককে কার্ডিয়াক আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। সোমবার সকালে এ ঘটনার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত ঘোষিত নবজাতক শিশুটিকে নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এদিকে এ ঘটনায় ঢামেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক বিদ্যুৎ কান্তি লালকে প্রধান করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সোমবার দুপুরে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ডাঃ মোঃ আব্দুল আজিজ সাংবাদিকদের জানান, শিশুটিকে বর্তমানে কার্ডিয়াক আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। তার অবস্থা যে খুব একটা ভাল তা বলা যাবে না। তবে তাকে যে অবস্থায় এখানে (ঢাকা শিশু হাসপাতাল) আনা হয়েছিল তার চেয়ে ভাল আছে। তিনি জানান, তার হার্টবিট খুবই কম। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে না। সাত মাসে ভূমিষ্ঠ হওয়ায় তার ওজনও কম। মাত্র এক কেজি। শরীরে রক্ত শূন্যতা আছে। নাভি দিয়ে রক্ত বের হয়েছে। এখানে নিয়ে আসার পর তা বন্ধ করা হয়েছে। একটু সুস্থ হলে লাইফ সাপোর্ট খুলে দেয়া বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হবে। ঢামেক হাসপাতাল থেকে তাহলে কিভাবে মৃত ঘোষণা করা হলো। এক প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর আব্দুল আজিজ জানান, আমরা যতটা জেনেছি, গতকাল (রবিবার) রাতে গর্ভাবস্থায় কোন নাড়াচাড়া না পেয়ে তখনই মৃত ধরে নেয়া হয়। পরে আজ (সোমবার) সকালে নরমালি ডেলিভারি করানো হয়। তিনি জানান, ডেলিভারির পর নবজাতক সাধারণত ৩ মিনিটের মধ্যে কেঁদে ওঠে। শিশুটি ১৫ মিনিটের মধ্যে না কাঁদলে সে আর সার্ভাইব করে না। এ নবজাতকের ক্ষেত্রে কী হয়েছে তা আমাদের জানা নেই। তবে আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য শিশুকে বাঁচানো। ঢাকা শিশু হাসপাতালের উপ পরিচালক ডাঃ আবু তৈয়ব জানান, শিশুটিকে আইসিইউতে রেখে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার অবস্থা ভাল না। তিনি জানান, যখন শিশুটিকে আমাদের এখানে আনা হয়। তখন তার হার্টবিট ছিল ১০ থেকে ১২, পরে ৩৫ থেকে ৪০ হয়। তবে তার হার্টবিট প্রয়োজন ১০০। ডাঃ তৈয়ব জানান, চিকিৎসকরা শিশুটিকে সুস্থ করে তুলতে চেষ্টা করবেন। শিশুটির বাবা মিনহাজ উদ্দিন সাভারের নয়াডিঙ্গির একটি পোশাক কারখানায় আয়রনম্যান পদে কাজ করেন। শিশু হাসপাতালে উপ-পরিচালক ডাঃ তৈয়ব জানান, ১৯ এপ্রিল সাভারের স্থানীয় একটি ক্লিনিকে শিশুটির মা শারমিন আক্তারকে ভর্তি করা হয়। শারমিন রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত ছিলেন। সেখানে তাকে দুই ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়। ২০ এপ্রিল সকালে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন স্থানীয় চিকিৎসক। ওই দিনই তাকে সাভারের মালেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু মালেক হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ওই রোগীকে ভর্তি করেনি। তারা উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। এরপর ২১ এপ্রিল রাত একটার সময় ঢামেকে ভর্তি করার পর শিশুটির মা শারমিন আক্তার এখনও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। তিনি জানান, আমরা যতটা জেনেছি, আজ (সোমবার) সকাল ৯টা ১০ মিনিটের দিকে ঢামেক হাসপাতালকে থেকে শিশুটিকে কবর দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ৯টা ৩৫ মিনিটে কবরস্থানে তার হার্টবিট দেখতে পান। ১০টা ১২ মিনিটে আজিমপুর মেটারনিটি হসপিটালে নেয়া হয়। সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে এখানে (ঢাকা শিশু হাসপাতাল) নিয়ে আসা হয়। এদিকে শিশু হাসপাতালে সংবাদ সম্মেলনে শিশুটির মামা শরিফুল জানান, প্রথমে শনিবার রাতে যখন আমার বোনকে শারমিন ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করি। তখন ডাক্তাররা তাকে জিজ্ঞেস করেন, করি। তখন ডাক্তাররা তাকে দেখে বলেন, গাছ নেবেন না। ফল নেবেন। তখন বোনকে (শারমিনকে) বাঁচাতে জোর দেই। আমি বলি আমাদের গাছ চাই। রবিবার রাতে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদের জানানো হয় শিশুটি নড়াচড়া করছে না। সে পেটে মারা গেছে। শিশুটির মামা শরিফুল ইসলাম জানান, আজ (সোমবার) ৮টা ১০ মিনিটে শারমিনের স্বাভাবিক প্রসব হলে দেখা যায়। শিশুটি নড়াচড়া করছে না। তখন ঢামেক হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ কাশফিয়া শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন। তাকে মৃত ঘোষণা করে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’-ও দেয়া হয়েছে। পরে তাকে একটি বক্সের ভেতরে রাখা হয়। তারপর আজিমপুরে নিয়ে যাওয়ার পর বাকি ঘটনা ঘটে। তিনি জানান, তাদের পক্ষ থেকে গতকাল (রবিবার) রাতের একটি টেস্টের রিপোর্ট দেয়া হয়। যেখানে শিশুটি পেটে নড়াচড়া করছে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শরিফুল জানান, কবর দেয়ার সময় একটা নাম দিতে হয় তাই আমি নাম দিয়েছিলাম মিম। এটি তার বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। দুইজনই চাকরিজীবী। তিনি জানান, শিশুটির মা শারমিন ১০৫ নম্বর ওয়ার্ডে এখনও ভর্তি আছে। গতকাল (রবিবার) রাতে শিশুটির মায়ের রক্ত বমি হয়েছে। ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শারমিন জানান, তাদের বিয়ে হয়েছে তিন বছর আগে। এটিই তাদের প্রথম সন্তান। আজ (সোমবার) সন্তান জন্ম দেয়ার পর জ্ঞান ফিরলে তিনি জানতে পারেন তার সন্তান মারা গেছে। পরে গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে জানতে পারেন তার শিশুটি ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছে। এতে তিনি কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন বলে জানান। আজিমপুর মাতৃসদনের সুপার ডাঃ ইসরাত জাহান জানান, আজ (সোমবার) সকালে আমাদের এখানে শিশু ইউনিটে তার প্রাথমিক চিকিৎসা হয়েছে। তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় আমরা তাকে এ্যাম্বুলেন্সে করে পরিবারের সঙ্গে শিশু হাসপাতালে পাঠিয়েছি। তিনি বলেন, পরিবার আমাদের জানিয়েছিল, শিশুটিকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করতে নেয়া হয়েছিল। যেভাবে আজিমপুর কবরস্থানে মৃত শিশু গোসলের পর জেগে উঠল ॥ সকাল সাড়ে ৯টা শিশুটিকে দাফনের জন্য আজিমপুর কবরস্থানে আনা হয়। এ সময় মোহরার কক্ষে নবজাতকের দাফনের জন্য বাঁশ, চাটাই নিচ্ছিলেন শিশুটির পিতা মিনহাজ ও তার বন্ধু শরিফুল। মেহেরাব কক্ষে রশিদে লেখা ছিল বাঁশ ৫০ টাকা, চাটাই ৩২ টাকা, কবর খোঁড়া ৫ টাকা ও সরকারি ফি ২০০ টাকা। মোট ২৮৭টাকা। শিশুটি বাবা মিনহাজ জানান, ভাংতি না থাকায় আজিমপুর কবরস্থানের মোহরারকে নগদ ২৯০ টাকা পরিশোধ করেন। টাকা পরিশোধের পর মোহরারও রেজিস্ট্রার খাতায় নাম ঠিকানা লিখছিলেন। এ সময় খবর আসে নবজাতক (মেয়ে) শিশুটি শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করছে। হাত-পা নাড়াচাড়া করছে। খবর পেয়ে নবজাতকের তিনি (পিতা) সেখানে ছুটে যান। নবজাতককে বাঁচাতে প্রথমে আজিমপুর কবরস্থানের অদূরে আজিমপুর ম্যাটারনিটিতে নিয়ে যান। সেখানে ভর্তি না করে আগারগাঁওয়ের ঢাকা শিশু হাসপাতালে রেফার করা হয়। দুপুরে আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানে সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, খবর পেয়ে মোহরারের কার্যালয়ে পুলিশ এসেছে। পুলিশ কর্মকর্তা বার বার নবজাতকের পিতার মোবাইল নম্বর আছে কিনা জানতে চাইছেন। জবাবে মোহরার হাফিজুল ইসলাম বলছিলেন, মোবাইল নম্বর নেয়ার সময়টুকুও পাইনি। রেজিস্ট্রারে নাম-ঠিকানা লেখা শেষ হওয়ার আগেই মৃত নবজাতক নড়েচড়ে উঠে সবাই দৌঁড়ে চলে যায়। এ বিষয়ে আজিমপুর কবরস্থানের মোহরার হাফিজুল ইসলাম জানান, নবজাতকের মামা কনস্টেবল শরীফুল ইসলাম দাফনের জন্য সকালে আজিমপুর কবরস্থানে আসেন। কবরস্থানের নিবন্ধন বইয়ে নবজাতকের নাম লেখা হয়েছে মীম। তার বাবার নাম মিনহাজউদ্দিন। মা শারমিন আক্তার। বাড়ি ঢাকার ধামরাইয়ের শ্রীরামপুর গ্রাম। সকালে নবজাতকের লাশের গোসল করাচ্ছিলেন জেসমিন। এ সময় নবজাতক চিৎকার করে কান্না করলে, ওই নারী ছুটে এসে তার কাছে খবর দেয়। এরপর নবজাতকের মামা নবজাতকটিকে নিয়ে হাসপাতালে রওয়ানা দেন। আজিমপুর কবরস্থানের নারী ড্রেসার জেসমিন আক্তার ঝর্ণা জানান, মোহরারের মাধ্যমে একটি বক্সে করে নবজাতকের লাশটি কবরস্থানের ভেতরে গোসলখানায় পাঠানো হয়। তিনি নবজাতক শিশুটির গায়ে এক মগ পানি ঢেলে শরীরে সাবান লাগাতে না লাগাতেই দেখেন শিশুটি নড়াচড়া করছে। প্রথমে চোখের ভুল ভেবে আবার সাবান ঘষতেই নবজাতকটি হাত-পা নাড়ায়। এ সময় তিনি সহকর্মীদের ডেকে বিষয়টি জানান। পানি ঢালার কারণে শিশুটির ঠা-া লেগে শরীর আরও খারাপ হতে পারে এই ভেবে তোয়ালায় পেঁচিয়ে দ্রুত কবরস্থানের দক্ষিণ গেটে নিয়ে আসেন বলে জানান তিনি। ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক যা বললেন ॥ ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন জানান, ঢামেক হাসপাতালে জন্ম নেয়া আলোচিত শিশু মীমের মা শারমিন কি না। তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি জানান, বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডাঃ সালমার মাধ্যমে জানতে পারলাম শারমিন নামে একজন রোগী আমাদের এখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি ২৭ সপ্তাহের প্রেগনেন্সি নিয়ে এখানে ভর্তি হয়েছিলেন। আজ (সোমবার) যখন তার ডেলিভারি হয়েছে তখন একটা মৃত সন্তান জন্ম হয়েছে। সে অনুযায়ী এখনও তার ব্লিডিং হচ্ছে। সেজন্য তার চিকিৎসা চলছে। এখানে তার আত্মীয়-স্বজন যারা ছিলেন সম্ভবত তাদের কাছে মৃত সন্তানটি দেয়া হয়েছিল। তিনি জানান, যেহেতু মৃত সন্তান জন্ম হয়েছে তাহলে এখন মীম নামের যে শিশুটি নিয়ে এত আলোচনা সেটি কার এটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সেজন্য প্রয়োজন তার ডিএনএ টেস্ট করা হতে পারে। এছাড়া এ ঘটনায় ঢামেকের উপ-পরিচালক বিদ্যুৎ কান্তি লালকে প্রধান করে প্রাথমিকভাকে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন জানান।
×