ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এক মাসেই চাঞ্চল্যকর তিন খুন

পরকীয়ায় ছারখার হয়ে যাচ্ছে সাজানো সোনার সংসার

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২৩ এপ্রিল ২০১৮

পরকীয়ায় ছারখার হয়ে যাচ্ছে সাজানো সোনার সংসার

শংকর কুমার দে ॥ সর্বনাশা পরকীয়া প্রেমের বলি বেড়েই চলছে। মাদক আসক্তির চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে পরকীয়া প্রেমের আসক্তি। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ছে পরকীয়া প্রেমিক-প্রেমিকা। ছারখার হয়ে যাচ্ছে সোনার সংসার। খান খান করে ভেঙ্গে যাচ্ছে রঙিন স্বপ্ন। গত এক মাসেই চাঞ্চল্যকর তিনটি পরকীয়ার ঘটনায় খুন হয়েছেন স্বামী, সন্তান, পিতা। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে তিন নারী। পরকীয়া প্রেমের বলির নির্মম ও মর্মান্তিক ঘটনাগুলো তদন্ত করছে পুলিশ। পুলিশের কাছে তিন নারীর দেয়া জবানবন্দীতে বের হয়ে এসেছে পরকীয়া প্রেমের বলির চাঞ্চল্যকর ও মর্মান্তিক কাহিনী। দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে রংপুরে স্ত্রী দিপা ভৌমিক ও তার পরকীয়া প্রেমিকের হাতে খুন হওয়া পিপি রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা হত্যাকান্ডের ঘটনাটি। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে নিজ পুত্র সন্তানকে নির্মমভাবে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে মা নামের ডাইনি শেফালী বেগম। খোদ রাজধানী ঢাকাতেই পরকীয়া প্রেমে আসক্ত হয়ে প্রেমিকের পিতাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করার পর ব্যাগে ভর্তি করে লাশ ফেলে দেয়ার ঘটনা উদঘাটিত হওয়ার পর গ্রেফতার হয়েছে প্রেমিকা কণিকা। রংপুরের পিপি এ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক তার স্ত্রীর পরকীয়ার কারণে খুন হওয়ার ঘটনাটি আলোচিত হয় দেশজুড়ে। পরকীয়া প্রেমিক, প্রেমিকাসহ সহযোগীদের জবানবন্দীতে প্রকাশ পেয়েছে কিভাবে এই পরকীয়া প্রেমের ঘটনার সৃষ্টির পর খুনের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটেছে। রংপুরের অতিরিক্ত জজ আদালতের পিপি এ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবুসোনা হত্যাকান্ডের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত স্ত্রী দীপা ভৌমিক এবং তার পরকীয়া প্রেমিক কামরুল মাস্টার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। তাদের দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতেই বের হয়ে এসেছে পরকীয়ার বলির চাঞ্চল্যকর কাহিনী। রংপুরের কোতয়ালি পুলিশ খুন হওয়া পিপি রথীশ চন্দ্র ভৌমিকের স্ত্রী দিপা ভৌমিক, তার প্রেমিক কামরুল ইসলামসহ ৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। গত ২৯ মার্চ রংপুরের বাবুপাড়ার বাড়িতে পরকীয়ার কারণে স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিক স্বামী রথীশ চন্দ্র ভৌমিককে ঘুরের ওষুধ খাইয়ে প্রেমিক কামরুল ইসলামসহ অন্যরা মিলে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করে। এরপর ৩০ মার্চ লাশ আলমিরার মধ্যে ঢুকিয়ে ভ্যানে করে বাড়ি থেকে ১ কিলোমিটার দূরে কামরুলের ভাইয়ের মোল্লা পাড়ার একটি নির্মাণাধীন বাড়ির মেঝেতে পুঁতে রাখে। ৫ দিন পর ৪ এপ্রিল র‌্যাব লাশটি উদ্ধার করে। মঙ্গলবার ময়নাতদন্ত শেষে দখিগঞ্জ শ্মশানে রথীশ চন্দ্র ভৌমিকের দাহ সম্পন্ন হয়। রথীশ চন্দ্র ভৌমিকের খুনের ঘটনা তার ভাই সুশান্ত ভৌমিক বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেছেন। তাদের দেয়া জবানবন্দীর তথ্য অনুযায়ী নৃশংস এই হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল রথীশ চন্দ্রের স্ত্রী দীপা ভৌমিকের প্রেমিক কামরুল ইসলাম। তার পরিকল্পনাতেই ২৯ মার্চ রাত সাড়ে দশটার দিকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় আইনজীবী রথীশ চন্দ্রকে। হত্যার পর দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল দু’জনের। আইনজীবী রথীশের সঙ্গে তার স্ত্রীর প্রায়ই কলহ লেগে থাকত। এছাড়া একে অপরের মধ্যে অবিশ্বাস, অশান্তি স্ত্রীকে সময় নাদেয়া, স্ত্রীকে হাত খরচের পর্যাপ্ত টাকা না দেয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অনেক আগে থেকেই সংসারে কলহ লেগে থাকত। অনেক আগে থেকেই দীপা ভৌমিকের চাল-চলন ভাল ছিল না। অনেকটাই উচ্ছৃঙ্খল টাইপের আচরণ ছিল তার মাঝে। পর পুরুষের প্রতি আসক্তি ছিল তার মাঝে। এসব পছন্দ করতেন না স্বামী বাবু সোনা। এসব নিয়েও প্রায়ই ঝগড়া হতো। স্বামী এ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি থাকা অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ৮ অক্টোবর হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন স্ত্রী স্নিগ্ধা সরকার দীপাকে। একই দিনে ইসলাম ধর্মের শিক্ষক হিসেবেও নিয়োগ পান কামরুল ইসলাম। নিয়োগ প্রাপ্তির কিছুদিন পর থেকেই তিনি ঐ স্কুলেরই জনৈক এক শিক্ষকের প্রতি আকৃষ্ট হন। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা চলে বেশ কিছুদিন। পরে আরেক শিক্ষকের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা হয়। এর কিছুদিন পর স্বামী বাবুসোনার সহকারী মিলন মোহন্তের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। এভাবে কিছুদিন চলার পর পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সহকর্মী কামরুলের সঙ্গে পরামর্শ করতে থাকেন দীপা। সাংসারিক বিষয় নিয়ে পরামর্শ করতে গিয়েই ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায় এবং দু’বছর আগে প্রেমের সূত্রপাত হয় তাদের। আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে অন্য পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়। পূর্বের সম্পর্কগুলো বেশিদিন স্থায়ী না হলেও কামরুলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থায়ী হয় এবং তাদের এ সম্পর্কের বিষয়টি এক পর্যায়ে অনেকটাই ওপেন সিক্রেটভাবে চলতে থাকে। মাঝে মাঝে কামরুল প্রেমিকা স্নিগ্ধার বাসায় রাতও কাটাত। এসব নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই দীপার সঙ্গে রথীশের ঝগড়া হতো। গত বছরের অক্টোবর-নবেম্বর মাসের দিকে স্নিগ্ধা সরকার দীপাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার এবং বিয়ের প্রস্তাব দেয় কামরুল। স্নিগ্ধা সেই প্রস্তাবে প্রথমত রাজি না হলেও পরকীয়া চালিয়ে যেতে থাকে। আর তাদের পরকীয়ায় যেন পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে না পারেন সেজন্য দু’মাস আগে রথীশ চন্দ্র ভৌমিককে হত্যার পরিকল্পনা করেন কামরুল ও স্নিগ্ধা। হত্যার পর গোপনে দেশ ছেড়ে ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনাও করেছিলেন সিগ্ধা-কামরুল। এজন্য তারা সবকিছু গুছিয়েও নিয়েছিলেন। কিন্তু হত্যাকান্ডের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাননি তারা। চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত স্ত্রী স্নিগ্ধা ও কামরুলকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। আর রথীশের স্ত্রী স্নিগ্ধা সরকার এবং তার দুই ছাত্র রোকন ও সবুজ পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় এবং আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। মেয়ে অদিতী ভৌমিককে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া খুনের ঘটনায় তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ও সহকারী মিলন মোহন্তকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হলে হেফাজাতে মারা যায় মিলন মোহন্ত। খুন হওয়া পিপি রথীশের স্ত্রী দিপা ভৌমিক ও তার পরকীয়া প্রেমিক কামরুল মাস্টার এখন কারাগারে আটক। রথীশকে খুন করার পর স্ত্রী কারাগারে যাওয়ার পর তার সন্তানরা এখন এতিম। সোনার সংসার ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেলে সর্বনাশা পরকীয়ায়। পরকীয়ায় নিজ সন্তানকে পুড়িয়ে হত্যা ॥ আরেক পরকীয়ার নির্মম বলি হয়েছে অবুঝ শিশুপুত্র। ডাইনি মা তার নিজের শিশুপুত্রকে কাঁথা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এই ঘটনাটি রাজধানী ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ঘটেছে। মায়ের পরকীয়ার বলি নিষ্পাপ সন্তানকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৩ এপ্রিল। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে উপজেলার উচিতপুরা ইউনিয়নের বাড়ৈপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পরকীয়ার জেরে সন্তানকে আগুনে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ ওঠেছে শেফালী নামের এক নারীর বিরুদ্ধে। সৌদি প্রবাসী আনোয়ার হোসেনের বড় ছেলে হৃদয়কে পুড়িয়ে হত্যা করেছে তার মা শেফালী বেগম। নিহত হৃদয় ছিল বাড়ৈপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। অভিযুক্ত শেফালী বেগমকে (২৮) গ্রেফতার করা হয়েছে জানিয়ে পুলিশ বলছে, তিনি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার উদ্দেশে সন্তানদের শরীরে আগুন দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন। আড়াইহাজার পুলিশ জানায়, প্রায় ১১ বছর আগে বাড়ৈপাড়ার বিল্লালের ছেলে প্রবাসী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কেরানীগঞ্জের সুন্দর আলীর মেয়ে শেফালীর বিয়ে হয়। পরে তাদের দুই ছেলের জন্ম হয়। আনোয়ার বিদেশে থাকার সময় পার্শ্ববর্তী মোমেনের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন শেফালী। এ নিয়ে আনোয়ার তিন মাস আগে শেফালীর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কিন্তু শেফালী বিষয়টি না মেনে শ্বশুর বাড়িতেই থাকছিলেন। স্বামীর প্রতি প্রতিশোধ নিতে গত ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় দুই সন্তান হৃদয় ও শিহাবকে কাঁথায় জড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দেন তিনি। এতে হৃদয়ের পুরো শরীর দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হয়। আরেক সন্তান অগ্নিদগ্ধ শিহাবকে (৭) উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। পরে মা শেফালীকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় গ্রামবাসী। আড়াইহাজার থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ হক বলেন, ডিবি পুলিশ ও থানা পুলিশ ময়মনসিংহের নান্দাইল থানার মেরাকোনা এলাকায় যৌথ অভিযান চালিয়ে মোমেনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার মোমেন পুলিশের কাছে হৃদয়কে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। পরকীয়ায় পিতাকে হত্যা ॥ সবুজবাগ থানার পুলিশ বলেছেন, গত ৮ এপ্রিল রাজধানীর পূর্ব মাদারটেক এলাকায় একটি অটোরিক্সায় থাকা লাগেজ থেকে অজ্ঞাতনামা হিসাবে উদ্ধার করা হয় একটি লাশ। পরে নিহতের পরিচয় না পেয়ে পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। পরদিন স্বজনরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। শনাক্ত করা হয় এটা শাহ আলমের লাশ। পুত্র সৈকতের পরকীয়া প্রেমিকা কণিকার হাতে খুন হন শাহ আলম। মোবাইল ফোন সেট মেরামত করতে গিয়ে সৈকতের সঙ্গে পরিচয় হয় কণিকার। আলাপ প্রসঙ্গে সৈকত জানতে পারেন কণিকা ডিজে পার্টিতে নাচ করেন। কণিকা তাকে ডিজে পার্টিতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। এর এক সপ্তাহ পরে সৈকত ডিজে পার্টিতে গেলে কণিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়। এরপর থেকে তাদের মধ্যে গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এভাবে বছরখানেক প্রেম করার পর কণিকা জানতে পারেন যে সৈকত বিবাহিত। একদিন এক দুপুরে কণিকা হাজির হন সৈকতের বাড়িতে। খিলগাঁও ঈদগাহ জামে মসজিদের সামনের একটি বাড়িতে শাহ আলম সপরিবারের ভাড়া থাকতেন। সৈকত খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের একটি দোকানে মোবাইল ফোন মেকানিক হিসেবে কাজ করেন। সৈকতের বাবা শাহ আলমের পা ছুঁয়ে সালাম করেন। শাহ আলম একটি জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ছেলেকে ২০১১ সালে বিয়ে দেন। সৈকতের স্ত্রীর নাম নিতু। তাদের ঘরে একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। এসব তথ্য জানার পর কণিকার মন ভেঙ্গে যায়। সৈকতকে বারবার চাপ দিতে থাকেন। ডিভোর্স দিয়ে তাকে বিয়ে করতে হবে। পিতা শাহ আলম তার ছেলে সৈকতকে রক্ষা করার জন্য সৌদি আরব পাঠানোর ব্যবস্থা করতে থাকেন। গত মাসে চার লাখ টাকা খরচ করে সৈকতকে সৌদি আরব পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সৌদি আরব যাওয়ার কথা সৈকতের। এ খবর শুনে কণিকা তার প্রেমের পথের কাঁটা হিসেবে শাহ আলমকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে বের হয়ে আসে শাহ আলমকে হত্যার আগে গোড়ানের ৩১ নম্বর টিনশেডের বাসায় ডেকে নেয়া হয়। ওই টিনশেড বাসায় কণিকা তার দাদি ও তিন ভাইবোনের সঙ্গে থাকেন। ঘটনার দিন রাতে কণিকা তার দূর সম্পর্কের দুলাভাই মনির ওরফে আলমগীরসহ দুজনকে ডেকে নেন ওই বাড়িতে। তারা তিনজন মিলে শাহ আলমকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর লাশ লাগেজে ভরে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী তার আরও তিন বন্ধুর সহযোগিতায় শাহ আলমকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। লাশ লাগেজে ভরে একটি সিএনজি অটোরিক্সায় করে নিয়ে যায় নিরাপদ কোন স্থানে ফেলে দেয়ার জন্য। এরপর সেই লাশ গুম করার জন্য কণিকা নিজেই একটি অটোরিক্সা ঠিক করে রওনা হন। পথিমধ্যে লাগেজ রেখে পালিয়ে যান কণিকা। সবুজবাগ থানাধীন বনশ্রীর পেছনে পূর্ব মাদারটেক প্রজেক্টের রাস্তায় সিএনজি থামিয়ে লাগেজ রেখে পালিয়ে যান কণিকা। কণিকা লাশ ফেলে আসার পর বাসায় না ফিরে খিলগাঁও এলাকার তার বান্ধবী মিথির বাসায় যান। ওই রাত মিথিদের বাসায় থাকার পর ভোরে সেখান থেকে বের হন। কাউকে কিছু না বলেই চলে যান যশোরের বেনাপোলে। বেনাপোলে পৌঁছেই নতুন একটি মোবাইল ফোন নম্বর থেকে বান্ধবী মিথিকে ফোন করেন কণিকা। পরে পুলিশ সন্দেহবশত মিথিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তার মোবাইল ফোনের কল লিস্টের সূত্র ধরে বেনাপোল থেকে কণিকাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপরই কণিকার বোন হীরা, ভাই অনিক ও তার ফুপু কুলসুমকে গোড়ানের বাসা থেকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় শাহ আলমের ছেলে সৈকতকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরপরই সবুজবাগ থানা পুলিশ ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করে পিতাকে খুন করার অভিযোগে পুত্র সৈকত ও তার পরকীয়া প্রেমিকা কণিকাকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে পরকীয়া প্রেমের আরেক বলির রহস্য উদঘাটন করা হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবছরই দেশে অনেক পরকীয়া প্রেমের বলির ঘটনা ঘটছে। নৈতিকতার স্খলন ঘটলে মানুষ অনেক ন্যক্কারজনক কাজ করতে পারে। নীতি ও বিবেক ভ্রষ্ট হয়ে নিজের মানবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে হয়ে পড়ছে পাষাণ হৃদয়ের মানব। তারই প্রমাণ দিচ্ছে পরকীয়া প্রেম। নিজের স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ থাকা অবস্থায় আরেকটি অনৈতিক প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়াটাই আমরা পরকীয়া হিসেবে জানি। তবে এটা অনেকেই জানি না যে শুধু দেশেই নয়, বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য মানুষ এই পরকীয়ার ব্যাধিতে আসক্ত। শুধু তাই নয়, অনেকে একাধিক পরকীয়াও একত্রে চালিয়ে যান। আর এই পরকীয়া করার জন্য ও বিপরীত লিঙ্গের মন ভোলাতে মানুষ আশ্রয় নিয়ে থাকেন জঘন্য কিছু কৌশলের। চলুন, চিনে নিই পরকীয়া করার আগ্রহে যেসব জঘন্য বাজে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকেন বেশিরভাগ মানুষ। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা পরকীয়া প্রেমের বলির বিষয়ে বলেন, যেভাবে পরকীয়া প্রেমের সৃষ্টি হয় তার অনেক ঘটনা বের হয়ে এসেছে তদন্তে। এর মধ্যে নিজের জীবনসঙ্গী ভাল হওয়া সত্ত্বেও তার নামে বদনাম করা, কুৎসা রটানো, সকলের সামনে নানাভাবে তাকে হেয় করার মধ্য দিয়ে পরকীয়া প্রেমের সৃষ্টি হয়। এরপর নিজের জীবনসঙ্গীকে খারাপ প্রমাণ করে সহানুভূতি কুড়ানোটাই মূল কৌশল। সংসারে স্বামী বা স্ত্রীর অনুপস্থিতি, অশান্তি, দাম্পত্য কলহ, নিজেকে নিঃসঙ্গ ভেবে পরকীয়ায় সমর্পণ। অর্থের জোরে সম্পর্ক কেনা অর্থাৎ টাকা দিয়ে পরকীয়ার সম্পর্ক তৈরি করাও খুব কমন। এক্ষেত্রে পরকীয়তা মানসিক সম্পর্কের চাইতে শারীরিকই হয় বেশি। এমন সম্পর্কে জড়ানো যা খুবই লজ্জাজনক পরকীয়া এমনিতেই অনৈতিক, কিন্তু পরকীয়ার তাগিদে মানুষ এর চাইতেও অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। যেমন কাজের মেয়ে বা ড্রাইভারের সঙ্গে প্রেম বা এমন কোন আত্মীয়ের সঙ্গে প্রেম যার সঙ্গে সমাজ প্রেমকে স্বীকৃতি দেয় না। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা অনৈতিক কার্যকলাপ যেমন ফেসবুকে বা অন্য সোশ্যাল মিডিয়ার হরেক রকমের বন্ধু তৈরি, তাদের সঙ্গে নানা রকমের মিথ্যাচার ও সম্পর্ক তৈরি, নিজেকে সিঙ্গেল দাবি করা ইত্যাদি আজকাল অহরহ হচ্ছে। বিশেষ করে ফেসবুক পরকীয়া করাকে খুবই সহজ করে দিয়েছে। তালিকায় ফোনও আছে। সংসারে স্বামী বা স্ত্রীর অনুপস্থিতি, অশান্তি, দাম্পত্য কলহ, নিজেকে নিঃসঙ্গ ভেবে পরকীয়ায় সমর্পণ। আসলে পরকীয়ায় সমর্পণের জন্য জীবনসঙ্গীর চোখের আড়ালে সুযোগ বুঝে নিজেকে সিঙ্গেল পরিচয় দিয়েও পরকীয়া করেন অনেক মানুষ। এতে প্রেম করাটা সহজ হয়। একই সঙ্গে জীবন সঙ্গী ও পরকীয়ার সঙ্গী, দু’জনকেই ধোঁকা দেন তারা। নিজের সম্পর্কে মিথ্যা কাহিনী তৈরি করে নিজের অর্থ বিত্ত সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে এমন সব মিথ্যা কাহিনী তৈরি করেন যেন বিপরীত লিঙ্গ খুব আকর্ষণ বোধ করে আর তিনি অন্য কারো জীবন সঙ্গী এটা জানা সত্ত্বেও জৈবিক চাহিদার উন্মাদনার কারণে প্রেমে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
×