ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাইলট সুস্থ ছিলেন বিমানেও কোন ত্রুটি ছিল না

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২৩ এপ্রিল ২০১৮

পাইলট সুস্থ ছিলেন বিমানেও কোন ত্রুটি ছিল না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সেদিন পাইলটও সুস্থ ছিলেন, প্লেনটি উড্ডয়নযোগ্য ছিল, এলাইনমেন্টও ঠিক ছিল। তারপরও কেন ইউএস-বাংলার প্লেনটি ত্রিভুবন বিমানবন্দরে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হলো সেটাই একটা বড় প্রশ্ন। এ প্রশ্নের সঠিক জবাব মূল তদন্তে বের হয়ে আসবে। রবিবার রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য প্রকাশ করে দুর্ঘটনার এক মাসের মাথায় প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে ইউএস-বাংলার সিইও আসিফ ইমরান বলেন, এতে অনেক কিছুই অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। তিনি খুব সুস্পষ্টভাবেই বলেন, কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হওয়া ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিএস-২১১ ফ্লাইটের উড়োজাহাজে কোন যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। নেপাল ও বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন জানিয়েছে, দুর্ঘটনা কবলিত প্লেনটিতে কোন টেকনিক্যাল ত্রুটি ছিল না। ইউএস-বাংলার নিজস্ব প্রতিবেদনেও কোন কারিগরি ত্রুটি ছিল না বলে প্রতীয়মান হয়। এছাড়া ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন। তার অবসাদগ্রস্ত হওয়া কিংবা জোর করে পাঠানোর বিষয়টি অবান্তর। ইমরান আসিফ বলেন-দুঃখজনক হলেও সত্য, দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন গণমাধ্যম কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ছবি প্রকাশ করে। বলা হয়েছে বিমানটি পুরনো ছিল, পাইলটকে জোর করে পাঠানো হয়েছে, তিনি অবসাদগ্রস্ত ছিলেন। তবে এসব তথ্য সঠিক নয়। ক্যাপ্টেন আবিদ দুর্ঘটনা পূর্ববর্তী সর্বশেষ রিপোর্টে ফ্লাইংয়ের জন্য ফিট ছিলেন। তার মেডিক্যাল রিপোর্ট ছিল ‘ক্লাস ওয়ান’। বাংলাদেশের পাইলটদের মধ্যে ১২ জন ডিসিপি পাইলট আছেন তাদের মধ্যে আবিদ অন্যতম। ইউএস-বাংলার পাইলটের ফ্লাইং মনিটরিং করার জন্য এফডিএম ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। এফডিএম পর্যালোচনা করে ক্যাপ্টেনের কোন অসঙ্গতি থাকলে ব্রিফ করে। প্রয়োজনে ইন্সট্রাক্টরের মাধ্যমে আরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। তবে আবিদের ক্ষেত্রে এটির প্রয়োজন হয়নি। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী একজন পাইলট দৈনিক ১৪ ঘণ্টা ডিউটি করতে পারেন। রুল অনুযায়ী তিনি ১১ ঘণ্টা ফ্লাই করতে পারেন। দুর্ঘটনার দিন যদি আবিদ ফ্লাইট নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসতেন তাহলে তার ফ্লাইং আওয়ার ৭ ঘণ্টার কম হতো। তার ক্যারিয়ারের মোট ফ্লাইং আওয়ার প্রায় ৬ হাজার ঘণ্টা। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের সিইও ইমরান আসিফ বলেন, এছাড়াও কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি প্রায় ২ বছর ধরে ইউএস-বাংলায় কর্মরত ছিলেন। তিনি ‘আরিরাং এভিয়েশন’ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বৈমানিক, তার ফ্লাইং আওয়ার ছিল ৪০০ ঘণ্টার বেশি। নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণকালে নিজেদের প্লেন দুর্ঘটনার বিষয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ বলেছে, একটি ফ্লাইটকে দেয়া ল্যান্ডিং ক্লিয়ারেন্স (অবতরণের অনুমতি) বাতিল না করেই অন্য ফ্লাইটকে অবতরণ বা উড্ডয়ন করতে দেয়া আন্তর্জাতিক নিয়মের ব্যত্যয়। তাছাড়া, দুর্ঘটনার দুই মিনিটের মধ্যে উদ্ধারকর্মীরা গেলে হতাহতের সংখ্যা কম হতো। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নেপালে প্রাথমিক তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আসিফ বলেছেন- ‘প্রাথমিক প্রতিবেদনে অনেক বিষয় আসতে পারতো, কিন্তু আসেনি। ‘আমার কাছে মনে হয়েছে কিছু বাস্তবসম্মত তথ্য, যেটির প্রতিফলন হওয়া উচিত ছিল, সেগুলো ঠিকমতো অ্যাড্রেস করা হয়নি। রিপোর্ট নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি, আমাদের মনে প্রশ্ন আছে। আমরা কিছু ব্যাপারে প্রশ্ন তুলছি। আমাদের কাছে কিছু ব্যাপার অসঙ্গিতপূর্ণ মনে হয়েছে। আমরা চাই এই ইনভেস্টিগেশন স্বচ্ছভাবে হোক। নেপাল যদি তাদের জবাবদিহিতা থেকে সরে আসে, তাদের কিন্তু আইকাওর কাছে জবাবদিহি করতে হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও আহত বিমানযাত্রীদের কাছ থেকে আমরা যা জেনেছি, তাতে আমাদের ধারণা যে, সত্যিই যদি ২ মিনিটের মধ্যে উদ্ধারকর্মীরা নিয়োজিত হতো তাহলে হতাহতের সংখ্যা হয়তো অনেক কম হতো। নেপাল বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইমরান আসিফ আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে আপনারা জেনেছেন দুর্ঘটনার আগে নেপালের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে পাইলটকে বিভ্রান্তিকর নির্দেশনাবলি দেয়া হয়েছে। কাঠমান্ডু কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ইউএস-বাংলার বৈমানিকদের ল্যান্ডিং ক্লিয়ারেন্স দেয়ার পর সেই ক্লিয়ারেন্স বাতিল না করেই এয়ারক্রাফটটিকে অন্যত্র ল্যান্ডিং করতে বলা হয় এবং একই সময় অন্য এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট অবতরণ করতে দেয়া হয়। একটি ফ্লাইটকে দেয়া ল্যান্ডিং ক্লিয়ারেন্স বাতিল না করেই অন্য ফ্লাইটকে অবতরণ বা উড্ডয়ন করতে দেয়াও আন্তর্জাতিক নিয়মের ব্যত্যয়। তিনি বলেন, ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ। এ পর্যন্ত অসংখ্য বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানে। নেপালের তদন্ত রিপোর্টে ১২ মার্চ দুর্ঘটনার পূর্বমুহূর্তে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে ইউএস-বাংলার বিমানের যোগাযোগের ত্রুটির বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েেেছ। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সে সময় ২৫ সেকেন্ডের জন্য টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু সেটিই স্বাভাবিক। কেননা সাধারণত ফাইনাল ল্যান্ডিং এ্যাপ্রোচের সময় টাওয়ারের সঙ্গে পাইলটের কথাবার্তা হয় না। বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিমানটির অবতরণের সময় এ্যালাইনমেন্ট সঠিক ছিল না বলে যে কথা বলা হয়েছে তাও সঠিক নয়। কারণ নেপালের তদন্ত রিপোর্টে এ ধরনের কোনও কথা বলা হয়নি। ইমরান আসিফ বলেন-এয়ারক্রাফট মেইনটেনেন্স অন্যান্য ট্রান্সপোর্টের মতো নয়। বিশ্বব্যাপী এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলো ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানইজেশনের (আইকাও) একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কেউ চাইলেই এর ব্যতিক্রম করা সম্ভব নয়। ইউএস-বাংলা শুরু থেকেই কঠোরভাবে এসব নীতিমালা অনুসরণ করে আসছে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের প্রতিটি এয়ারক্রাফট নিখুঁতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ইউরোপীয় কানাডিয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৭ জন বিদেশী প্রকৌশলী নিয়োজিত আছেন। এছাড়া ইউএস-বাংলায় ৬২ দেশীয় অভিজ্ঞ প্রকৌশলী কাজ করেন।’ গত ১২ মার্চ নেপালের স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ২০ মিনিটে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৬৭ জন আরোহী নিয়ে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়। তাদের মধ্যে ৩৩ জন বাংলাদেশী, একজন মালদ্বীপ, একজন চীনা এবং নেপালি ৩২ যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ৫১ জনের প্রাণহানি ঘটে।
×