ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভুলের বিরুদ্ধে ফুল, চোখ জুড়ানো সুন্দর

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ২৩ এপ্রিল ২০১৮

ভুলের বিরুদ্ধে ফুল, চোখ জুড়ানো সুন্দর

মোরসালিন মিজান ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে প্রবেশ করতে হয়নি। তার আগেই গা শিউরে ওঠে। ভয়াবহ আগুনের চিহ্ন। তা-বের ছবি। দূর থেকে দেখা যায়। বাড়ির সামনে যে খোলা চত্বর, সে চত্বরের সবুজটুকু পর্যন্ত বিনষ্ট করেছে দুর্বৃত্তরা। আন্দোলনের নামে এমন নিষ্ঠুরতা দেখে ফেরার সময় মন ছিল বিষণœ, হতাশ এবং ঠিক তখনই চোখে পড়ে নাগলিঙ্গম ফুলটি! গত সপ্তাহের কথা। এখনও মুগ্ধতা কাটেনি। ধ্বংসযজ্ঞের বিপরীতে নতুন প্রাণ। ভুলের বিরুদ্ধে ফুল। কী যে ভাল লাগছিল! তবে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নয়, এখন রাজধানীর আরও কয়েকটি স্থানে দৃশ্যমান হচ্ছে নাগলিঙ্গম। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও গাছটি আছে। তবে সংখ্যায় কম। খুব দুর্লভ। এ কারণে ফুলটি নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। নাগলিঙ্গম গাছটি বিশাল। মোটাসোটা কা-। লম্বায়ও অনেক। সোজা ওপরের দিকে উঠে গেছে। গাছ যেমন বড়, ফুলটিও তা-ই। ওপরের দিকে তাকালে মনে হয় রঙের ফোয়ারা! ঘ্রাণও মিষ্টি। চারপাশ ভরিয়ে রাখে। সারাবছরই কম বেশি ফুল হয়। এখন ঠিক মৌসুম নয়। কিন্তু এত রং রূপ নিয়ে সামনে এসেছে যে, মৌসুম বলেই মনে হচ্ছে। নাগলিঙ্গম ফুলের পরাগচক্র বিশেষ বাঁকানো। দেখতে ফণা তোলা সাপের মতো। এ কারণেই নাগের কথা মনে পড়ে যায়। সেই নাগ থেকে নাগলিঙ্গম। গাছটি যথেষ্ট দুর্লভ। সারাদেশে যা আছে, চাইলেই গুণে ফেলা যায়। সে তুলনায় রাজধানী ঢাকা এগিয়ে। বৃক্ষহীন শহরে ভাল সংখ্যায় আছে গাছটি। রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বলধা গার্ডেন ও চন্দ্রিমা উদ্যানে আছে বিভিন্ন বয়সী নাগলিঙ্গম। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টি, বাংলাদেশ বন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ৩টি, মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ১টি গাছ আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে আছে একটি গাছ। অন্যটি ভূতত্ত্ব বিভাগের পাশে। ফুল ধরা অবস্থায় গাছগুলো বিশেষ দৃশ্যমান হয়। তবে গাছ মানেই ফুল নয়। চারা রোপণের পর ১২ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তার পর ফুল। নাগলিঙ্গমের কা-ের সঙ্গে ঝুলে থাকে অসংখ্য মঞ্জরি। তিন মিটার দীর্ঘ মঞ্জরিতে ফুটে বড় গোলাকার ফুল। ফুলের ব্যাস ২ থেকে ৩ ইঞ্চি। এর ৬টি পাপড়ি। পাপড়িগুলো বাঁকানো, মাংসল। ভেতরের দিকে গাঢ় গোলাপী আর বাইরের দিকে হলদে ধরনের হয়ে থাকে। ভীষণ সুগন্ধি ফুলের চারপাশ ঘিরে থাকে মিষ্টি ঘ্রাণ। গন্ধ বিলিয়ে টপাটপ ঝরেও পড়ে। পাতা যেমন। ফুলও। কোন গাছের নিচে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে সেটি বেশ টের পাওয়া যায়। আপনি ঝরে পড়তে থাকে নাগলিঙ্গম ফুল। বড় এবং অপেক্ষাকৃত ভারি হওয়ায় ঝরে পড়ার সময় বেশ শব্দ হয়। বড় শরীর নিয়ে উঁচু থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ার কারণে প্রায়ই কিছু পাপড়ি ভেঙ্গে যেতে দেখা যায়। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা থেকে জানা যায়, নাগলিঙ্গম লিসাইথিডেসিয়া গোত্রের বৃক্ষ। আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণ এলাকা। গত দুই-তিন হাজার বছর আগে এর সন্ধান মেলে ভারতে। দেশটিকে এ বৃক্ষের উৎপত্তিস্থল বলে মনে করা হয়। তবে ধীরে ধীরে এটি পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বর্তমানে কম-বেশি সব দেশেই জন্মায়। ফুলটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শিবপূজায় অত্যাবশ্যক। পূজাতে দরকার হয় বলে শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশের বৌদ্ধ মন্দিরে গাছটি ব্যাপক হারে লাগানো হয়। বাংলাদেশেও গাছটি আছে বহু দিন। এ দেশে অনেকেই গাছটিকে নাগেশ্বর নামে জানেন। তবে উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মা জানান, নাগেশ্বর সম্পূর্ণ আলাদা একটি গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম কারম্নপিটা গায়েননসিস। ইংরেজী নাম ক্যানন বল। ক্যানন বলের মতো ফল ধরার কারণেই এমন নামকরণ। তিনি জানান, নাগলিঙ্গমের দ্রুততম বৃদ্ধি ঘটে। গোড়ার দিকে প্রায় ১৮ ফুট। ২৫ থেকে ৩০ ফুট লম্বা কান্ড। কান্ড সরল। পাতা গাঢ় সবুজ। লম্বায় ৫ থেকে ৭ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। চওড়ায় ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি। সারাবছরই পাতা ঝরে, নতুন পাতা গজায়। বাকলের রং বাদামী ধূসর এবং অসমান। নাগলিঙ্গমের ফল আরও শক্ত। এটি ২০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়। নয় মাসের মধ্যে পাকে। পরিপক্ব ফল মাটিতে পড়লে ফেটে যায়। বাতাসে ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়ায়। এ ফল পথচারীদের মাথায় পড়লে বিপদের সম্ভাবনা যথেষ্ট। ভেষজ গুণও আছে নাগলিঙ্গমের। ফুল, পাতা এবং বাকলের নির্যাস থেকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ হয়। এন্টিবায়োটিক, এনটিফাঙ্গাল এবং এন্টিসেপটিক হিসেবে ব্যবহার বিশেষ লক্ষণীয়। এ থেকে তৈরি ওষুধে পেটের পীড়া দূর হয়। পাতার রস ত্বকের নানা সমস্যায় কাজে দেয়। ম্যালেরিয়া রোগ নিরাময়ে এর পাতা ব্যবহার করা হয়। তবে রূপ ঘ্রাণ নাগলিঙ্গমের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য দিয়েই নিসর্গপ্রেমীদের মুগ্ধ করে রেখেছে ফুলটি।
×