ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শুঁটকির ব্যবসায় ধস

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ২৩ এপ্রিল ২০১৮

 শুঁটকির ব্যবসায় ধস

সংবাদদাতা, সৈয়দপুর, নীলফামারী ॥ শুঁটকিতে লবণ মিশিয়ে ওজন বৃদ্ধি, ব্যবস্থাপনাগত সুবিধার অভাব ও ব্যাংকের চড়া সুদ। নানা সমস্যায় শুঁটকির ভোক্তা চাহিদা কমেছে। ধস নেমেছে সৈয়দপুরের শুঁটকি ব্যবসায়। এতে ক্রমান্বয়ে পুঁজি হারিয়ে অনেকে পেশা বদলেছে। কেউবা হয়েছে দেউলিয়া। এভাবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সৈয়দপুরের শুঁটকি ব্যবসা হুমকিতে পড়েছে। সূত্র মতে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা এসে ১৯৮০ সালে সৈয়দপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল মহাসড়কের সামনে গুদাম ভাড়া নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে শুঁটকির ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার প্রসার ঘটাতে অনেকে ব্যাংক ঋণ নিয়ে চালান এ ব্যবসা। এতে কয়েক বছরের মধ্যে চট্টগ্রামের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ আড়তে পরিণত হয় সৈয়দপুর। তারা চট্টগ্রাম, খুলনা, পাবনা ও বরিশালের বিভিন্ন শুঁটকির মোকাম থেকে সামুদ্রিক ও দেশীয় শুকনা মাছ আমদানি করে দেশব্যাপী সরবরাহ করেন। এমনকী অনেকে ভারতের অন্ধপ্রদেশ থেকে এলসির মাধ্যমেও আমদানি করেন। সূত্রটি আরও জানায়, সে সময় এখানকার পাইকারি ও আড়তদারের মাধ্যমে প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার শুঁটকি বিক্রি হতো সৈয়দপুরের এ আড়ত থেকে। আমদানি হতো দেশী ষোল, গজার, পুঁটি, টাকি, টেংরা, গচি, শিংসহ প্রায় ২০ প্রজাতী ওপোয়া, পাতা, গলদা, ইকচটি, কামিলা, চকলেট, ধঞ্চা, কাওয়া, পাইল্লা, রকেট মিলে ১০ রকম সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি। ২২ জন আড়তদার ৬১ জন পাইকারি বিক্রেতা সমৃদ্ধ করেছিল শুঁটকির এ ব্যবসাকে। তবে গ্রাহক ঠকানোর কৌশল, ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা আর চড়া সুদের ফাঁদে পড়ে অনেকে দেউলিয়া হয়েছে। বাকিরা রয়েছে অপেক্ষায়। সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের টার্মিনাল এলাকার এ শুঁটকির আড়তটি অত্যন্ত খোলামেলা। ছড়ানো-ছিটানো আড়ত ঘর। শত শত যানবাহনের চলাচলে ধুলিময় মহাসড়কের পাশে খুচরা, পাইকারি ও মোকামঘর। সেখানে খোলামেলা শুঁটকির বস্তা। শেড না থাকায় পলিথিনের ওপর চলছে ব্যবসা। নেই পয়ঃনিষ্কাশন ও শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা। পর্যাপ্ত গুদাম ঘর না থাকায় খোলা বস্তায় রাখা হয়েছে শুঁটকি। খবর নিয়ে জানা গেছে, এখানে শুঁটকির গুণগত মান যাচাইয়ের কোন ব্যবস্থা নেই। উৎপাদকরা কাঁচা মাছে লবণ মিশিয়ে শুকিয়ে পাঠাচ্ছে এ আড়তে। এ সব এখন নানাবিধ কারণে গ্রাহক চাহিদা কমায় বিক্রি নেমেছে এর অর্ধেকে। প্রভাবশালী অনেক পাইকারি ও আড়তদাররা ব্যাংক ঋণে জর্জরিত হয়ে দেউলিয়া হয়েছে। সৈয়দপুর শুঁটকি আড়তের ব্যবসায়ীরা জানায়, ব্যাংক ঋণের ১৫ ভাগ সুদের হার, সংরক্ষণে প্রশিক্ষণ না থাকাসহ লবণ মিশিয়ে মাছ শুকিয়ে উৎপাদিত শুঁটকি মাছের কারণে গত ১৫ বছরে অনেকে এ ব্যবসায় দেউলিয়া হয়েছে। এদের মধ্যে মোঃ শরিফ, আব্দুল গনী, জালাল মিয়া, আব্দুল মজিদ মিয়া, মফেল মিয়া, আঃ আজিজ, কবীর উদ্দিন বিশ্বাস, ইলিয়াস মিয়া, আঃ রহিম মিয়া, আঃ রাজ্জাক মিয়া, আঃ রশিদ মিয়া, আজিজুর রহমান, হায়দার আলী, আঃ রহীম সওদাগড় ও মোঃ মোক্তার হোসেন দেওলিয়া হয়েছেন। প্রত্যেকে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে দেশান্তরী হয়েছেন। অনেকে ঢাকার ১০ নম্বর মিরপুরের গোল চত্বরে কাঁধে করে মাছ বিক্রি করছেন। কেউবা করছেন কৃষি মজুরের কাজ। এ আড়তের পাইকারি শুঁটকি বিক্রেতারা জানান, লবণ মাখানো একটি আকারে ছোট শুঁটকি মাছ ৫ থেকে ৬ শত গ্রাম ওজন হয়। অথচ এ মাছটি শুধু রোদে শুকালে ২ থেকে ৩ শত গ্রাম হয়। এতে শুঁটকির আকার আর ওজন দেখে খুচরা ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের কাছে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। শরিফ নামে এক পাইকারি বিক্রেতা বলেন, শুঁটকি মাছ বিক্রিতে হাট-বাজারের ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহ। এতে তাদের কাছে পাওনা টাকা আদায় হচ্ছে না। এভাবে মহাজন আর ব্যাংকের ঋণ বাড়ছে প্রতিদিন। একই অভিযোগ মোকাম ব্যবসায়ীদের। সৈয়দপুর শুঁটকি আড়তের মোকাম ব্যবসায়ী বাহাউদ্দিন বাবলু জানান, ৭ মাস আগে রাজশাহী কৃষি অফিসের লোকজন এসে শুঁটকি মাছ সংরক্ষণে প্রশিক্ষণের কথা বলেছিল। এরপর আর কোন খবর নেই। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সংরক্ষণ জানা থাকলে বর্ষাকালে শুঁটকিতে পচন রোধ করা যেত। আপাতত নিমাপাতা ও শুকনা মরিচের গুঁড়া শুঁটকি সংরক্ষণে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে লবণের কারণে বর্ষাকালে শুঁটকি মাছ ভেজা থাকায় পচন রোধ করা যাচ্ছে না। এ আড়তের শুঁটকি মাছ ব্যবসায়ী সমিতি লিঃ এর সাধারণ সম্পাদক মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, স্বল্প লাভে ব্যাংক ঋণ, শুকনা মাছ সংরক্ষণে প্রশিক্ষণ ও শুঁটকি উৎপাদকরা লবণ মেশানো বন্ধ করলে এর সুদিন আবার ফিরবে। সংশ্লিষ্টরা যথাযথ পদক্ষেপ নিলে এটি বাস্তবে রূপ নেবে। সৈয়দপুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মিনারা হাফিজা ফেরদৌস বলেন, রংপুর বিভাগীয় মৎস্য কর্মকর্তা স্ব-উদ্যোগে এ শুঁটকি আড়ত পরিদর্শন করেছেন। তাদের সকল সমস্যা ও অব্যস্থাপনা চিহ্নিত করে পাঠানো হয়েছে। কোন নির্দেশনা আসলে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×