ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তিন সমস্যায় যশোরের সবজি

ব্র্যান্ডিং না করায় বিদেশী বাজার হারানোর শঙ্কা

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ২৩ এপ্রিল ২০১৮

ব্র্যান্ডিং না করায় বিদেশী বাজার হারানোর শঙ্কা

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ বাজার হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে সারাদেশের মধ্যে প্রথমবারের মতো বিদেশে রফতানি করা যশোরের সবজির। বিদেশে রফতানিযোগ্য সবজির ব্র্যান্ডিং না থাকার সঙ্গে আরও তিন সমস্যার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এ নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন যশোরাঞ্চলের শ’ শ’ সবজি চাষী। সঙ্গে এই অঞ্চলে সবজি চাষে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানকারী এবং রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে হতাশা ভর করেছে। তাদের বক্তব্য, সরকার অচিরেই বিষয়টির প্রতি গুরুত্বের সঙ্গে নজর না দিলে যশোরাঞ্চলে সাসটেইনেবল এগ্রিকালচার ফুড সিকিউরিটি এ্যান্ড লিংকেজেস (সফল-২) কর্মসূচী মুখ থুবড়ে পড়বে। আর এটি হলে যশোরের পাশাপাশি গোটা দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। বন্ধ হয়ে যাবে সবজি রফতানির মাধ্যমে রেমিটেন্স আয়। আর সমস্যাগুলো যদি এখনই সমাধান করা যায় তাহলে গার্মেন্টস পণ্যের মতো অতি দ্রুত বিদেশী বাজার দখল করবে বাংলাদেশী সবজি- এমন আশা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের। সরকারীভাবে সারাদেশে সাসটেইনেবল এগ্রিকালচার ফুড সিকিউরিটি এ্যান্ড লিংকেজেস (সফল-২) প্রকল্পের আওতায় বালাইমুক্ত নিরাপদ সবজি চাষের জন্যে চারটি অঞ্চল নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- যশোর, টাঙ্গাইল, নরসিংদী এবং গাজীপুরের কাপাসিয়া। এই চারটি অঞ্চলের মধ্যে সর্বপ্রথম কাজ শুরু হয়েছে যশোরে। কেবল কাজই শুরু হয়নি, এখান থেকে রীতিমতো সবজি রফতানিও হচ্ছে। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, যশোর সদর উপজেলায় চারটি ব্লকে সাসটেইনেবল এগ্রিকালচার ফুড সিকিউরিটি এ্যান্ড লিংকেজেস (সফল-২) প্রকল্পের আওতায় বালাইমুক্ত নিরাপদ সবজি চাষ হচ্ছে। যে পাঁচটি ইউনিয়নে প্রকল্প চলছে সেগুলো হচ্ছে, চুড়ামনকাটি, হৈবতপুর, ইছালী ও লেবুতলা। এর বাইরে বাঘারপাড়া উপজেলার একটি ইউনিয়নেও সবজি চাষ চলছে। এসব এলাকার চারশ’ চাষীকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক দাতা সংস্থা সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া টেকনোলজি ও মার্কেটিং লিংকেজের কাজটি করছে। সলিডারিডাডের হয়ে স্থানীয়ভাবে মাঠ তৈরি এবং চাষীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বেসরকারী সংস্থা জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন। চুক্তিবদ্ধ চাষীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ছয়টি সবজি যথাক্রমে পটল, চিচিঙ্গা, কাকরোল, করলা, ঢেঁড়স ও বাঁধাকপি স্থানীয় বাজারের তুলনায় বেশি দরে কিনে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রফতানি করছে রিফাত এগ্রোবেজড প্রসেসিং লিমিটেড ও রিফাত এন্টারপ্রাইজ। একই সঙ্গে তারা ঢাকার অন্যান্য রফতানিকারকদের কাছেও বিক্রি করছে। কথা হয় এ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী কাজী মুন্নীর সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্তমানে চাষীরা স্বল্পমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করছে। একই সঙ্গে বালাই দমনে বিভিন্ন ধরনের ফেরোমন ব্যবহার করা হচ্ছে। যেটির মাধ্যমে উৎপাদিত সবজি নিতে বিদেশীদের আপত্তি কম। চেষ্টা করা হচ্ছে অতিদ্রুত কীটনাশক একেবারেই বাদ দেয়ার। কাজী মুন্নী বলেন, সারাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম যশোর থেকে সবজি রফতানি শুরু হয়েছে। পটলের দু’টি চালান ইতোমধ্যে চলে গেছে। করলার চালান কয়েক দিনের মধ্যে যাবে। এর আগে বাঁধাকপি গিয়েছে। কিন্তু অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না যশোরের সবজি। তিনি আরও বলেন, বাজার দরের চেয়ে চুক্তিবদ্ধ চাষীকে প্রত্যেক সবজিতে কেজি প্রতি দু’টাকা বেশি দেয়া হয়। এরপর সংগৃহীত সবজি গ্রেডিংয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাদ পড়ে। তার ওপর রয়েছে পরিবহন খরচ। সব মিলিয়ে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে যে খরচ পড়ছে সেই দরে রফতানিকারকরা নিচ্ছেন না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, একটি সংঘবদ্ধ চক্র ঢাকার কাওরানবাজার থেকে কোন রকম কোয়ালিটি ছাড়াই সবজি কিনে বিদেশে পাঠাচ্ছে। সেখানে তারা কম দামে সবজি বিক্রি করায় প্রতিযোগিতায় কোয়ালিটি সম্পন্ন যশোরের সবজি টিকতে পারছে না। রফতানিকারকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ কারণে এখনই সরকারের রফতানিযোগ্য সবজিকে ব্র্যান্ডিং করা জরুরী হয়ে পড়েছে। তা না হলে রাশিয়ার দশা হবে। রাশিয়া যে রকম সবজি নেয়া বন্ধ করেছে, অন্যান্য দেশও এক সময় সেটিই করবে কোয়ালিটি সম্পন্ন না হওয়ার কারণে। যা দেশের সুনাম নষ্ট করবে এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, এটি গেল এক সমস্যা। এর সঙ্গে অন্যান্য যে অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে সেগুলো হচ্ছে, রফতানিযোগ্য সবজি ফ্রিজিং ভ্যানে করে নিতে হয়। একটি ফ্রিজিং ভ্যানের দাম অনেক বেশি। যা কেনা অসম্ভব। অথচ সরকারের বিভিন্ন দফতরে অনেক ফ্রিজিং ভ্যান অহেতুক পড়ে রয়েছে। যা এই প্রকল্পে ব্যবহারের জন্যে দিতে পারে। আর সেটি সম্ভব না হলে, কিস্তিতে কেনার ব্যবস্থা করে দিতে পারে সংশ্লিষ্ট দফতর। তা না হলে সবজির মান ঠিক থাকবে না। আরেক সমস্যা হচ্ছে পরিবহন। যশোর থেকে রফতানিযোগ্য সবজির গাড়ি ফেরিঘাটে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। ফেরিতে উঠতে পারে না। আবার দিনের বেলায় ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। এসব কারণে বিদেশী বিমানের সিডিউল মিস হচ্ছে। ফলে অনেক রফতানিকারক আস্থা রাখতে পারছেন না। তারা যশোরের সবজি নেয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। পথে দেরি হওয়ার কারণে ঢাকায় পৌঁছানোর পরও রফতানিকারকরা সবজি নেননি এমন ঘটনাও ঘটেছে। এসব সমস্যা যদি অবিলম্বে সমাধান করা না যায় তাহলে যশোরের বিশাল এই সম্ভাবনা মাঠে মারা যাবে। প্রকল্প সামনে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। কারণ আর্থিকভাবে বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হলে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা যাবে না। পরিবহন সমস্যা, বিশেষ করে ফেরিঘাটের অসুবিধা দূর করতে যশোরের জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করা হয়েছে বলে জানান কাজী মুন্নী। তাদের এই আবেদনের বিষয়ে জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল বলেন, একটি আবেদন পেয়েছি। ব্যস্ততার কারণে পদক্ষেপ নেয়া যায়নি। যতদ্রুত সম্ভব এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। চাষীর কল্যাণে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবকিছু করা হবে। চুড়ামনকাটি এলাকার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, চাষীদের যেভাবে মোটিভেশন দেয়া হচ্ছে এটি নিয়মিত রাখতে পারলে সামনে অনেক ভাল ফল পাওয়া যাবে। যশোর সদর উপজেলা অফিসের উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা শ্যামল কুমার নাথ বলেন, আমরা প্রকল্পটি নিয়মিত দেখাশোনা করি। কারিগরি সহায়তা দিয়ে আসছি। এটি যদি ঠিক রাখা যায় তাহলে খুব তাড়াতাড়ি সারাদেশের মধ্যে মডেল হবে। সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন গুড এগ্রিকালচার প্রাকটিস (গ্যাপ)-এর শর্ত দিয়েছে। এটি পূরণ করার চেষ্টা চলছে। যদি পূরণ করা যায় তাহলে গার্মেন্টস শিল্পের মতো সবজির বাজারও গড়ে উঠবে। যার মধ্যে যশোর থাকবে প্রধান। যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (উপ-পরিচালক) কাজী হাবিবুর রহমান বলেন, ইতোমধ্যে বিষমুক্ত পটল ১০ মেট্রিক টন বিদেশে গেছে। সামনে করলা যাবে। চাষীরা স্থানীয় বাজারের তুলনায় বেশি দর পাচ্ছেন। দিন দিন সচেতন হচ্ছেন। সব মিলিয়ে যশোরের এই সম্ভাবনাময় প্রকল্পটি স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখতে উদ্ভূত সমস্যা সমাধান জরুরী হয়ে পড়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যাতে রফতানিযোগ্য সবজির গাড়ি ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
×