ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গাজী সালেহ উদ্দিন

একজন জাফর ইকবাল বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ২৩ এপ্রিল ২০১৮

একজন জাফর ইকবাল  বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি

ড. জাফর ইকবালের প্রথম নাম শুনি তিনি সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর। আমেরিকা থেকে তিনি অনেক লোভনীয় চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশে সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। সত্যিকার অর্থে তখন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসাইটে প্রথিতযশা এমন কোন শিক্ষক ছিলেন না। তাই এক অর্থে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় জাফর ইকবালের নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে। এই পরিচয়ের আরেকটি কারণ ছিল তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই এবং শহীদ পরিবারের সন্তান। আমার পিতার ন্যায় তার পিতাও বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আমাদের পিতা ও ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তেই এদেশ স্বাধীন হয়েছে। হয়ত সে কারণেই তার উপস্থিতি সূক্ষ্ম ও গভীরভাবে মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছিল। দুজনের দেখা বা সাক্ষাত হওয়ার কথা নয়। কারণ আমরা দুজন দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, যা পাহাড়ঘেরা একটি এলাকা এবং ডিসিপ্লিনও আলাদা। তিনি বিজ্ঞানের আর আমি সমাজবিজ্ঞানের। দুজন পরিচিত হওয়ার যোগসূত্রতা সৃষ্টি হয় ২০০৪ সালে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব নির্বাচিত হই। সেই কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন ড. ইয়াসমিন হক, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ড. জাফর ইকবালের স্ত্রী। এরপর থেকে আমরা একই পরিবারভুক্ত হয়ে রয়েছি। গত ৩ মার্চ শনিবার বিকেলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ড. জাফর ইকবালকে হত্যার জন্য আক্রমণ করে মাদ্রাসা পড়ুয়া ফয়জুর হাসান নামের এক যুবক। পরে তাকে হাতেনাতে আটক করা হয়েছে। বর্তমানে সে পুলিশ হেফাজতে রয়েছে। পত্রিকা সূত্রে প্রকাশ, তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দশদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে মহামান্য আদালত। বিভিন্ন সময় ড. জাফর ইকবালকে হত্যার জন্য উড়ো চিঠি, কাফনের কাপড় পর্যন্ত পাঠানো হয়েছে। তাই গত এক বছর ধরে ড. জাফর ইকবালকে সরকার পুলিশ প্রটোকল দিচ্ছে। এ ব্যাপারে মাঝে-মধ্যে কথা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশের পাহারায় থাকার মতো বিড়ম্বনা আর কিছু নেই। একই অবস্থায় আমাকে পড়তে হয়েছিল ২০০০ সালে। তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের ছাত্রদের গ্রেফতার ও তাদের রাজনীতি করার সুযোগ-সুবিধা সীমিত হয়ে যাওয়ায় ৩০ ডিসেম্বর ২০০০ সালে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বাসায় বোমা হামলা করা হয়। আমার ছেলে তানভীরকে অপহরণ এবং আমাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল। তখনই সরকার আমার বাসায় পুলিশ প্রহরা বসায়। একজন শিক্ষকের বাসায় পুলিশ থাকা, তাদের অবস্থানের অবকাঠামো থাকার কথা নয়। তার ওপর তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা এটি আরেক ধরনের বিড়ম্বনা। তাই একটি সুস্থ সমাজে নাগরিককে যদি পুলিশ প্রহরায় থাকতে হয় এবং তিনি যদি শিক্ষক হন, তাহলে সেই সমাজে বা রাষ্ট্রে গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক চর্চা করা দুরূহ। বাংলাদেশের দীর্ঘ সমাজ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বর্তমান যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিশ্বস্বীকৃত তা কখনও বাংলাদেশের রাজনীতি বা সমাজ কাঠামোতে ছিল না। প্রত্যেকটি গ্রাম ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। গ্রামের বাইরে থেকে যেসব জিনিস যেমন লবণ, লোহাজাত দ্রব্য ইত্যাদি আমদানি করতে হতো তা গ্রাম্য পঞ্চায়েত বা গ্রাম্য সমাজই পরিচালনা করত। উৎপাদনের একটি অংশ খাজনা দেয়া ছাড়া আর কোনভাবেই শাসক শ্রেণীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। মুঘল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও বাংলাদেশে আধুনিক গণতন্ত্রের চর্চা হয়নি। ৭১-এর স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্যক বুঝতে পেরেছিলেন যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত করতে হলে প্রথমে প্রয়োজন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা। যার প্রভাব পড়বে ব্যক্তিজীবনে, সমাজে ও রাষ্ট্রে। তাই তিনি ১৯৭২ সালের সংবিধান ও বিশ্ববিদ্যালয় আইন ’৭৩ সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে সংসদে বিল পাস করিয়েছিলেন। রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা একই ধাঁচে করে সাংসদ বা জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে জবাবদিহিতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিবেকের কাছে জবাবদিহিতা রেখেছিলেন। যেহেতু বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তাই ভাষার জন্য এবং একটি সংস্কৃতিনির্ভর রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য যা প্রথম প্রয়োজন তিনি তা করেছিলেন, তা হলো- রাষ্ট্রভাষা বাংলা সকল ক্ষেত্রে ব্যবহারের নির্দেশ। এমনকি আদালতের রায়ও বাংলায় লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা হলো- ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। পূর্বাপর ঘটনা বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করে আমার রাজনীতিবিদ, দেশ পরিচালনাকারীদের, সামরিক/সিভিল অফিসারদের ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে প্রশ্ন- একাত্তর সালে আমরা যে দেশ পেয়েছিলাম আমরা আশা করেছিলাম এ দেশটি একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী শোষণহীন সমাজ হিসেবে গড়ে উঠবে। তার কাছাকাছি আমরা আছি কিনা? পত্রিকায় প্রকাশিত খবর, ফয়জুরের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সে জাফর ইকবালকে হত্যা করার জন্যই ছুরি চালিয়েছিল। একজন যুবক যার চোখেমুখে থাকবে আগামী দিনের সুন্দর ভবিষ্যত, সেই কিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনসম্মুখে একজন নিরীহ অধ্যাপককে হত্যা করার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে গেছে। আক্রমণকারীর ভাষায় জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু। সেই যুবক নিশ্চয়ই বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও শিক্ষা গ্রহণ করেছে। সে একটি সামাজিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, যেখানে শুধু ধর্মান্ধতারই শিক্ষা দেয়া হয়। সেখান থেকে তার ধারণা হয়েছে বা কেউ তাকে ধারণা দিয়েছে যে, জাফর ইকবাল বেঁচে থাকলে ইসলামের ক্ষতি হবে। তাই তাকে হত্যা করতে হবে। এই শিক্ষা সে তার পরিবার, সমাজ বা প্রতিষ্ঠানে পেয়েছে। ইসলাম ধর্ম কি এতই ঠুনকো যে, একজন জাফর ইকবাল তার ক্ষতি করতে পারে? তাহলে কেন জাফর ইকবালকে বা প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষকে হত্যা করতে হবে ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করার জন্য? ড. জাফর ইকবাল কি কখনও ধর্মবিরোধী এমন কোন কথা বলেছেন, যাতে ইসলাম ধর্ম ধ্বংস হতে পারে? ড. জাফর ইকবালের মূল ধ্যান-ধারণা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন আর আগামী প্রজন্ম যাতে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে গড়ে উঠে সেই প্রচেষ্টায় তিনি বিজ্ঞানকে, গণিতকে সাধারণ পাঠকের কাছে নিয়ে গেছেন। তার লেখা গল্প, প্রবন্ধগুলো যুক্তি ও বিজ্ঞাননির্ভর। ফলে ক্রমেই একটি বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ে উঠছে। শিশু ও যুবকদের কাছে তিনি ‘হ্যামিলনের বংশীবাদক’ হয়ে উঠেছেন। সম্ভবত সেখানেই তাদের ভয়। একটি শ্রেণী বা গোষ্ঠী চাচ্ছে বাংলাদেশের সমাজটা হয়ে উঠুক মধ্যপ্রাচ্যের মতো, ধর্মান্ধতাই যেখানে মুখ্য। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে উঠা মূল্যবোধ, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল সেই মূল্যবোধ থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গেছি। প্রশ্ন জাগে এটি কীভাবে হলো, যেখানে বাংলাদেশের সমাজ আরও প্রগতিশীল, মুক্তচিন্তার অধিকারী হওয়ার কথা, সেখানে এই পশ্চাৎপদতা কেন? তাহলে কি বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতিতে এমন কোন ত্রুটি রয়েছে যা আমাদের সমাজকে পিছিয়ে দিচ্ছে এবং এর পেছনে কোন দল, গোষ্ঠী বা কারিগর রয়েছে যারা এই পশ্চাৎপদ সমাজ থেকে লাভবান হবে? প্রথমত, সম্ভবত বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যে দেশে শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা পদ্ধতি কি হবে এটা নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা হচ্ছে। যার মূল লক্ষ্যে এখনও পৌঁছতে পারেনি। এর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, যারা এদেশকে বর্তমান ও সামনে শাসন করছে বা করবে তাদের ছেলেমেয়ে এদেশে শিক্ষা গ্রহণ করছে না। স্বভাবতই এ নিয়ে তাদের তেমন কোন মাথাব্যথা নেই। স্বাধীনতা উত্তরকালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। ফলে মুক্তিযুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রায় বেশিরভাগ বাঙালী একই কাতারে দাঁড়াতে পেরেছে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে ইংরেজী, আরবী মিলে প্রায় তেরো ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা পদ্ধতি ভিন্ন। সেখানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কোন গুরুত্ব নেই বা বাংলাদেশের সংস্কৃতি নির্ভরশীল কোন পাঠ্যসূচী নেই। এমনকি কোন কোন ইংরেজী স্কুলে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছে যে, স্কুলে কেউ বাংলায় কথা বললে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হবে। ধর্মনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা কওমি মাদ্রাসা। তাদের নিজস্ব পাঠ্যসূচী ও কার্যক্রম রয়েছে। সরকারের কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ তাদের ওপর নেই। ফলে বাংলাদেশে বসবাস করেও তারা ভিন দেশ ও সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। একটি দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নির্ভর করে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর, যা বাংলাদেশে এখনও গবেষণা পর্যায়ে রয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৭ বছর পরও সিদ্ধান্ত হয়নি বাংলাদেশের জন্য কোন্ শিক্ষাব্যবস্থা উপযুক্ত। তাই যেসব প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ, যারা চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মকে বিজ্ঞানমনস্ক, উদার চিন্তার অধিকারী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষতার পথে এগিয়ে নিতে প্রফেসর জাফর ইকবালের মতো তাদের জন্য কি আগামী বাংলাদেশ আবাসযোগ্য হয়ে উঠেছে? লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×