ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের নদী পুনরুজ্জীবনে ড্রেজিং শেখ হাসিনার ভিশন

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ২৩ এপ্রিল ২০১৮

বাংলাদেশের নদী পুনরুজ্জীবনে ড্রেজিং শেখ হাসিনার ভিশন

বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন- বন্যা, নদীভাঙ্গন, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষকে রক্ষা করতে হলে এবং নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নে পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন একান্ত অপরিহার্য। জাতির জনক এও অনুধাবন করেছিলেন যে, বন্যা প্রতিরক্ষা এবং লবণাক্ততা দূরীকরণের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ তথা ভারতের সঙ্গে সমঝোতা এবং সহযোগিতা ছাড়া কেবল দুরূহই নয়, প্রায় অসম্ভব। তাই তিনি প্রথম সুযোগেই (মার্চ, ১৯৭২) ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পানি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার অঙ্গীকার সংবলিত চুক্তি (Treaty of friendship) স্বাক্ষর করেন এবং বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন। জাতির দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর এই ভিশন বাস্তবায়ন হওয়ার পূর্বেই তিনি স্বাধীনতাবিরোধী আততায়ীদের হাতে নৃশংসভাবে সপরিবারে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ধীরে ধীরে মন্থর হতে থাকে। বাংলাদেশের পানিসম্পদ উন্নয়নের বিষয়টি যেন হয়ে গিয়েছিল দাতা সংস্থা এবং বিদেশী উপদেষ্টাদের বিষয়। বিদেশী উপদেষ্টারা একেক সময় একেক কনসেপ্ট নিয়ে এসেছে, আর আমরা তা অনুসরণ করেছি মাত্র। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণের পর পানিসম্পদের ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের বিষয়টি পুনরায় গুরুত্ব পায়। তিনি বঙ্গবন্ধুর ভিশন অনুসরণ করেই যাত্রা শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুকন্যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে ঐতিহাসিক গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় (১৯৯৬), বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা হ্রাসের জন্য গড়াই নদী ড্রেজিং করা হয়, জাতীয় পানি পলিসি এবং জাতীয় পানি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার নদী-জাল পুনরুজ্জীবন এবং এ জন্য ড্রেজিংয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। ড্রেজিং সম্পর্কে তার ভিশনের মূল কথা হলো- জালের মতো বিস্তৃত বাংলাদেশের নদ-নদী-খাল-বিলগুলো (River Network- নদী-জাল) পুনরুজ্জীবিত করা। উদ্দেশ্য নদীর নাব্য প্রতিষ্ঠা এবং ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি, বর্ষার পানি দ্রুত নিষ্কাশন, নদী-নালা-খাল-বিলে পানি সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের নামে নদী, পুকুর, জলাশয় ভরাট না করা। কারণ, সংরক্ষিত পানি কৃষি কাজে, জীববৈচিত্র্য রক্ষায়, পরিবেশ এবং নদীর স্বাস্থ্য রক্ষণাবেক্ষণের কাজে লাগবে। দুঃখের বিষয়, তার ভিশন দাতা সংস্থা এবং তাদের উপদেষ্টারা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন, আমরাও ব্যর্থ হয়েছি। দাতা সংস্থা এবং তাদের উপদেষ্টারা তো বটেই, এমনকি আমরাও ড্রেজিং সম্পর্কে মধুমতির শাখা নদী বাইগড় পারের কন্যা শেখ হাসিনার ভিশনকে ইতিবাচকভাবে (Positively) দেখিনি। কারণ বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষিত ক্রুগ মিশন রিপোর্ট প্রণয়ন (১৯৫৯) এবং আইকো মাস্টার প্লান প্রণয়নের (১৯৬২-৬৪) সময় থেকে বর্তমান সময় অনেক পরিবর্তন হয়েছে, যে বিষয়টি বাইগড় নদীপারের (মধুমতির শাখা নদী) কন্যা পানিবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ না হয়েও নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং প্রজ্ঞা দিয়ে অনুধাবন করেছেন, তা বিদেশ থেকে উড়ে আশা তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা তো দূরের কথা, সাধারণভাবে এ দেশের সন্তান হয়ে আমরাও অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছি। দুঃখজনকই বটে। বাংলাদেশের নদী-জাল পুনরুজ্জীবিতকরণের কাজটি বিশাল। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদ-নদীগুলোর করুণ অবস্থার ওপর মর্মস্পর্শী শিরোনামে ছবিসহ ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ওই সব প্রতিবেদন থেকে কয়েকটি শিরোনাম উল্লেখ করা হচ্ছে: যেমন- কেউ কি নদীর কান্না শুনছেন; একদা নদী ছিল এখানে; হারিয়ে গেছে সে সব নদী; মরণদশায় এক সময়ের খরস্রোতা নদী; সেই নদীগুলো এখন শুধুই দীর্ঘশ্বাস ইত্যাদি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাকে বাঁচানোর জন্য জনগণকে সচেতন করার এই উদ্যোগটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এ পর্যন্ত ২৭৮টি নদী সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে- কুড়িগ্রামের ১৬ নদী, নীলফামারীর ২২, দিনাজপুরের পুনর্ভবা, ময়মনসিংহের অর্ধেক নদ-নদী, রাজশাহীর ৭, রংপুরের, ঠাকুরগাঁওয়ের, লালমনিরহাটের ১৩, কুষ্টিয়ার ৮, জয়পুরহাটে ৪, পঞ্চগড়ের অধিকাংশ নদী, ভয়াল ভৈরব, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, সিলেটে পিয়াইন, বগুড়ায় যমুনা, বাঙ্গালী, করতোয়া; জামালপুরে মিনাই, সুবর্ণখালী; সাতক্ষীরার ২৭, মানিকগঞ্জের ধলেশ্বরী, পুরাতন ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা, ইছামতি; নাটোরের ৩২ নদ-নদী; মাদারীপুরে শিবচরের ময়নাকাটা, কালকিনির টরকী ও পালরদী; কুমিল্লার ডাকাতিয়া, কালাডুমুর; চুয়াডাঙ্গার ৫; ঝিনাইদহের ১৫; চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রমত্তা পালাল, বাগেরহাটের ২৩; হবিগঞ্জের ২৫; মেহেরপুরের ৩, নেত্রকোনার ২১। এসব নদী বিলীন হয়ে গেছে, না হয় অস্তিত্ব সঙ্কটে এবং বিলীন হওয়ার পথে। কখনও কখনও এসব নদী নানাভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিবেদনের বাইরে আরও প্রায় শতাধিক নদী এরূপ বেহাল অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করতে হলে বিলীন হওয়া এবং অস্তিত্ব সঙ্কটে নিমজ্জিত এই শত শত নদী খনন করতে হবে। এখন প্রশ্ন- শত শত মৃতপ্রায় এবং হারিয়ে যাওয়া নদী পুনরুজ্জীবিত করা এবং রাখার মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা ব্যাপক ড্রেজিং ব্যতিরেকে আদৌ কি সম্ভব? সকলেই এক কথায় উত্তর দেবেন - না, সম্ভব না। যদি কেউ ভাবেন যে, ড্রেজিংয়ের বিকল্প রয়েছে তাহলে পরামর্শ প্রদানের জন্য অনুরোধ রইল। পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভিশনের আরেকটি দিক - নদীভাঙ্গন রোধ এবং নদীর তীর ও গর্ভ থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার করা। এক্ষেত্রেও ড্রেজিং ছাড়া চলবে না। পূর্বোক্ত বিশদ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক ড্রেজিংয়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনরূপ সংশয় বা অনীহা থাকার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় অবস্থানের জন্য ২০১৬ সালে পাউবো ২৪টি বড়-মাঝারি নদ-নদী ড্রেজিং করার জন্য বিপুল টাকা ব্যয় সংবলিত একটি ড্রেজিং প্রকল্প (ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প) প্রস্তুত করে। সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন হবে- কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ২৪টি বড়-মাঝারি নদ-নদী ড্রেজিং করলেই শত শত মৃতপ্রায় এবং হারিয়ে যাওয়া নদী কি পুনরুজ্জীবিত হবে? দেশব্যাপী বিস্তৃত নদী-জালের কী হবে? প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রীর ভিশন যথার্থভাবে অনুধাবন করে বাংলাদেশের নদী-জাল পুনরুজ্জীবনের জন্য (জবারাধষ ড়ভ ৎরাবৎ হবঃড়িৎশ) একটি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা। ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে নদীভাঙ্গন রোধ এবং ড্রেজিং সংক্রান্ত উল্লেখ রয়েছে; কিন্তু নদ-নদী-নালা-খাল-বিলগুলো পুনরুজ্জীবিত করার ভিশন (Revival of river network) অনুপস্থিত। পরিকল্পনা কমিশনের নেতৃত্বে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ প্রণীত হয়েছে। কিন্তু সেটাতেও প্রধানমন্ত্রীর ভিশন প্রতিফলিত হয়নি। কারণ একটাই- প্রধানমন্ত্রীর ভিশন দাতা সংস্থা এবং বিদেশী উপদেষ্টারা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন; আর আমরা বেশিরভাগই নানা কারণে দাতা সংস্থা/উপদেষ্টাদের অনুসরণ করছি। স¥রণ করা যেতে পারে, ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিশন যখন বঙ্গবন্ধুকন্যা ঘোষণা করেন (২০০৮), তখন অনেকেই অনুধাবন করতে পারেনি যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ কি হবে। আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ নানাভাবে এই ডিজিটালাইজেশনের সুবিধা ভোগ করছেন এবং এ নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। উন্নত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকন্যার দূরদৃষ্টি এবং ভিশন আজ সমগ্র বিশে^ই প্রশংসিত হচ্ছে। পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে ড্রেজিং সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর ভিশনের গভীরতার আরও দুটি বিষয় উল্লেখ করে এই নিবন্ধ শেষ করব। ২০১১ সালে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে (ফ্রেমওয়ার্ক এ্যাগ্রিমেন্ট) অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশের সহযোগিতার ধারা নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এই ধারাটি ঐতিহাসিক। একমাত্র তিনিই বুঝতে পেরেছেন যে, বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাকে (River system/network) চালু রাখতে হলে ভারত থেকে আগত ৫৪টি নদীতে পানি থাকতে হবে। তাই ভারতের নদীগুলোকে যেন তারা ড্রেজিং করে এ বিষয়ে তাদের সঙ্গেও আলোচনা করা হচ্ছে। এমন দিন আসতে পারে যখন বাংলাদেশ নিজের স্বার্থেই এসব নদী ড্রেজিংয়ের জন্য ভারতকে কারিগরি এবং আর্থিক সাহায্য দেবে। আমি অতিশয়োক্তি করলাম না। ইতোমধ্যে আমাদের অনেক প্রকৌশলী ভারতে নদী ব্যবস্থা সংক্রান্ত উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকন্যার ভিশন এ দেশের পেশাজীবী এবং নীতিনির্ধারকরা অচিরেই অনুধাবন করতে পারবেন এবং তার ভিশন বাস্তবায়িত হবে। নদীমাতৃক গ্রামবাংলার নদ-নদী-নালা-খাল-বিল প্রাণ ফিরে পাবে, জলাধারগুলো পানিতে থৈ থৈ করবে, গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপ পুনরুজ্জীবিত হবে এটাই আজ আমাদের কাম্য। লেখক : সদস্য, জাতীয় পানিসম্পদ কাউন্সিল সাবেক মহাপরিচালক, ওয়ারপো
×