ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতে কৃষকদের আয় বাড়াতে মোদির চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ০৭:৪১, ২২ এপ্রিল ২০১৮

ভারতে কৃষকদের আয় বাড়াতে মোদির চ্যালেঞ্জ

ভারতের বর্তমান নরেন্দ্র মোদির সরকার অন্যান্য খাতের ন্যায় কৃষি খাতের উন্নয়নেও একের পর এক নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে। এর অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে-গ্রামীণ কৃষকদের আয় বাড়ানো। বিশেষ করে সরকার স্পষ্টতই ঘোষণা দিয়েছে, আগামী ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের বার্ষিক আয় দ্বিগুণে উন্নীত করা হবে। যা বর্তমান সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষি খাতে বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো থেকে শুরু করে সরকারের নেয়া নানামুখী উদ্যোগ কতটা সফল হবে, এনিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে বেশ আলোচনা-সমালোচনাও আছে। কিন্তু এরপরেও সরকার তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নে অনড়। ১২৫ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে কর্মসংস্থানে সবার ওপরে রয়েছে গ্রামীণ কৃষি। ২০১৫ সালে প্রকাশিত কেন্দ্রীয় সরকারের এমপ্লয়মেন্ট-আনএমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, ভারতের শতকরা ৫৮ দশমিক ১ ভাগ মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে কৃষি থেকে। কর্মসংস্থানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নির্মাণ শিল্প। শতকরা ১১ দশমিক ৬ ভাগ মানুষের কর্মসংস্থান হয় এ খাতে। ক্ষুদ্র ব্যবসাবাণিজ্যে কর্মসংস্থান শতকরা ৭ দশমিক ১ ভাগ। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে উৎপাদনভিত্তিক শিল্পে কর্মসংস্থান হয় শতকরা ৭ দশমিক ৯ ভাগ মানুষের। কর্মসংস্থানে ব্যাপক ভূমিকা সত্ত্বেও ভারতের গ্রামীণ কৃষক সমাজ যথেষ্ট অবহেলিত রয়ে গেছে। শহরের মানুষের সঙ্গে জীবনযাপনে বিশেষ করে আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে গ্রামীণ কৃষকদের ব্যবধান প্রকট হয়ে উঠেছে। ১৯৮৭-৮৮ সাল থেকে ২০০৭-০৮ দুই দশকে ভারতের গ্রামের মানুষের মাথাপিছু খাদ্য বাবদ ব্যয় বৃদ্ধির হার ছিল মোট আয়ের শতকরা ১৬ দশমিক ১ ভাগ। আর শহরের ক্ষেত্রে তা ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৯ ভাগ। মাথাপিছু খাদ্য বহির্ভূত ব্যয় আরও তাৎপর্যপূর্ণ। আজও ভারতের শহরের মানুষ আয়ের শতকরা ৬০ ভাগ অর্থ ব্যয় করে খাদ্য বহির্ভূত খাতে। গ্রামের ক্ষেত্রে এ হার শতকরা ৪৮ ভাগ। শিক্ষা, যাতায়াত, চিকিৎসা, অন্যান্য ভোগ্যপণ্য, বাড়ি ভাড়া ইত্যাদি খাতেও শহরের মানুষের ব্যয়ের সঙ্গে গ্রামের কৃষকের মাথাপিছু ব্যয়ের বিরাট পার্থক্য রয়েছে। যদি ভারতে মাথাপিছু মাসিক ব্যয় বৃদ্ধির হারের দিকে আসা যায়, তাহলে দেখা যাবে ২০০৭-০৮ সালের হিসেবে গ্রামের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ছিল ১৯৬ দশমিক ১৬ শতাংশ আর শহরের ক্ষেত্রে তা ছিল ৩৬৪ দশমিক ১১ শতাংশ। ১৯৮৭-৮৮ সালে এ হার ছিল যথাক্রমে ১৫৮.১০ শতাংশ ও ২৪৯.৯২ শতাংশ। ভারতে এভাবে শহর ও গ্রামের মানুষের মধ্যে আয় এবং জীবনযাপন ব্যয়ের মধ্যে বৈষম্য ও ব্যবধান ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠেছে। সরকারী তথ্য বলছে ভারতের একটি কৃষক পরিবারের মাসিক ব্যয় নির্বাহ করার জন্য ন্যূনতম যে আয়ের প্রয়োজন, শতকরা ৭০ ভাগ কৃষকের আয় তার ধারে কাছে নেই। সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর ন্যূনতম মাসিক বেতন ১৮ হাজার টাকা। যা ভারতের ৯০ ভাগ কৃষক অর্জন করতে পারে না। খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের এমপ্লয়মেন্ট-আনএমপ্লয়মেন্ট সার্ভে অনুযায়ী ভারতের ৭৬ দশমিক ৯ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারের মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার কম। শতকরা ৭০ ভাগ কৃষক কৃষির থেকে যে আয় করে, তা দিয়ে তাদের সংসার প্রতিপালন করা কঠিন। শতকরা ৫২ ভাগ কৃষক পরিবারের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ গড়ে ৪৭ হাজার টাকা। একটি সরকারী সমীক্ষায় বলা হয়েছে, একটি কৃষি পরিবারের কৃষি থেকে বাঁচার মতো অর্থ রোজগার করতে প্রয়োজন কমপক্ষে ১০ একর জমি। এরসঙ্গে প্রয়োজন যুক্তিসঙ্গত মূল্যে কৃষি উপকরণ। কিন্তু অধিকাংশ কৃষকের তা নেই। কৃষি খাতের দুরবস্থার কারণেই ভারতে কৃষি বহির্ভূত ক্ষেত্রের ভূমিকা ক্রমে বাড়ছে। যা ২০০৫ সালে ছিল ২৭ শতাংশ, ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ শতাংশে। ২০১৫ সালে কৃষি বহির্ভূত ক্ষেত্রে ভূমিকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে। কৃষক ও কৃষিক্ষেত্রের উন্নয়নে স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতে নেয়া হচ্ছে একের পর এক উদ্যোগ। এরমধ্যে বর্তমান নরেন্দ্র মোদির সরকার ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় বার্ষিক দ্বিগুণ করার সুস্পষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করেছে। এবং যে কোন মূল্যে তা বাস্তবায়নে সরকার অনেকটাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি এক্ষেত্রে স্থানীয় রাজ্যগুলোও নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৬-১৭ সালের সংশোধিত বাজেটে গ্রামোন্নয়ন ও কৃষিখাতে ১,৮৭,২২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এ বরাদ্দের ১,২৮,৫৫০ কোটি টাকা কেবলমাত্র গ্রামোন্নয়ন খাতে। বাকি ৫২,৫৫০ কোটি টাকা কৃষি ও কৃষক কল্যাণ খাতে। এ বরাদ্দের সঙ্গে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ২ লাখ কোটি টাকা গ্রামোন্নয়নের কাজে ৫ বছরে ব্যয় হবে। পরবর্তী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই খাতে অর্থ ব্যয় ২৪ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বর্তমান সরকারের প্রথম দুই বছরে খরার কারণে কৃষিক্ষেত্রে বিপুল ক্ষতি হয়েছে। কৃষকদের রোজগার ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ব্যাপক ফসল নষ্ট হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে কৃষি ফসল বীমার মতো যুগান্তকারী একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যার নামকরণ করা হয় ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা’। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল যতবেশি সম্ভব ফসলকে বীমার আওতায় নিয়ে আসা। এর ফলশ্রুতিতে একবছরে বীমার আওতায় নিয়ে আসার পরিমাণ ২৩ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। একই সঙ্গে এ খাতে বরাদ্দ ৫৫০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনার অধীনে ৩.৫ কোটি কৃষকের বীমা করা হয়েছে এবং বীমার পরিমাণ ১ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। উর্বরতা রক্ষা করে একই জমিতে অধিক ফসল তোলার জন্য সয়েল হেলথ কার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জমির মাটি পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে সরকার অনেকটাই এগিয়েছে। মোট ২.৫৩ কোটি নমুনার মধ্যে ২.৩ কোটি নমুনা ইতোমধ্যে পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট ৭.১১ কোটি সয়েল হেলথ কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। কৃষকদের জন্য দেশজুড়ে কৃষি বাজার তৈরি হয়েছে। কৃষকের পণ্য যাতে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া যায়, সে ব্যবস্থা করাই কৃষি বাজারের কাজ। নিম মিশ্রিত ইউরিয়া সার ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়ান হয়েছে। ইউরিয়া উৎপাদনকারীদের নিম মিশ্রিত সার তৈরি করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে ফসলের উৎপাদন বাড়ছে এবং তা বেশি উন্নতমানেরও হচ্ছে। এমন ধরনের নানামুখী উদ্যোগ-আয়োজন বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমান নরেন্দ্র মোদি সরকার কৃষিখাতের উন্নয়নের পাশাপাশি কৃষকদের বার্ষিক আয় বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কৃষক সমাজ হচ্ছে দেশের প্রাণ ভোমরা। সরকার সংশ্লিষ্ট ছাড়াও মাঠপর্যায়ের কৃষকরাও মনে করে, এসব উদ্যোগ ও প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নে প্রান্তিক কৃষকদের অর্থনৈতিক জীবনধারা আমূল পাল্টে যাবে। কৃষি হবে আরও লাভজনক পণ্য।
×