ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

জাপানীদের রুচি বদলে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২২ এপ্রিল ২০১৮

জাপানীদের রুচি বদলে যাচ্ছে

টোকিওর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইয়োশিওয়ারা নামে এক এলাকা আছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে এলাকাটির নাম ছিল এডো। সে সময় ওটা ছিল জাপানের নাম করা বেশ্যাপল্লীগুলোর একটি। নারী ও পুরুষ দুই ধরনের বেশ্যা রাস্তায় হেঁটে বেড়াত খদ্দের জোটানোর জন্য। সব ধরনের সার্ভিস বা সেবাই দিত তারা। চার শ’ বছর পর এখনও ইয়োশিওয়ারা যৌন ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে রয়ে গেছে। তবে খদ্দেরদের রুচি, আকাক্সক্ষা, কামনা-বাসনার ধারা বদলেছে। সেগুলো আগের মতো অত স্পষ্ট ও স্থূল নয়। এখন ‘ফিমেল এম্পারার’-এর মতো অসংখ্য ‘সোপল্যান্ড’ গজিয়ে উঠেছে, যেখানে খদ্দেররা তাদের পরিবর্তিত ইচ্ছা এবং কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার সুযোগ পান। সোপল্যান্ড হচ্ছে বিশেষ ধরনের স্লানাগার। সেখানে শুধুমাত্র অন্তর্বাস পড়া মেয়েরা পুরুষদের সারা শরীর ঘষে মেজে স্নান করিয়ে দেয় এবং এ সময় চাইলে পুরুষরা নানাভাবেই নিজেদের যৌন কামনা পূরণ করতে পারে ৯৪ ডলারের বিনিময়ে, যা ১০ হাজার ইয়েনের সমান। ইয়োশিওয়ারার এই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে জাপানের যৌনশিল্পের বৃহত্তর পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়েছে। এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত পাওয়া কঠিন। তবে ভ্যাজাইনাল সেক্সের মতো উগ্র ধরনের সার্ভিসের পরিবর্তে অনুগ্র ও লঘুমাত্রিক যৌন সার্ভিসগুলো অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখানে বলে রাখা ভাল যে, জাপানে পতিতাবৃত্তি অর্থাৎ অর্থের বিনিময়ে নারী পুরুষের যৌনসঙ্গম বেআইনী, যদিও তা ব্যাপক পরিসরে লভ্য। অন্যদিকে ওরালসেক্স বৈধ। মাসাহিরো ইয়ামাদা নামে এক সমাজবিজ্ঞানী বলেন, জাপানে যৌন ব্যবসায় শুধুমাত্র সঙ্গম নয়, উপরন্তু অন্তরঙ্গতা ও রোমাঞ্চের জন্য আকুল আকাক্সক্ষাও দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। তাই এ ধরনের সেক্স সার্ভিসের বিকাশ ঘটে চলেছে। যেমন ধরুন কায়াবাকুরার সংখ্যা বেড়েছে। এগুলো হচ্ছে এমন স্থান সেখানে পুরুষরা যায় নারীদের দ্বারা মদ্য পরিবেশিত হওয়ার ও আদর-যতœ লাভের আশায়। তেমনি বাড়ছে ইমেজ ক্লাবের সংখ্যা, যেখানে পুরুষরা নানা ধরনের ফ্যান্টাসি নিয়ে কাজ করে। ওনাকুরা শপগুলো পুরুষদের নারী কর্মচারীদের দৃষ্টির সামনে হস্তমৈথুন করার সুযোগ দেয়। পর্নোগ্রাফি শিল্পের অবস্থাও রমরমা। অপেক্ষাকৃত কম ইন্দ্রীয়পরায়ণ সার্ভিসের দিকে জাপানীদের ঝুঁকে পড়ার কাজ শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। এ সময় মার্কিন দখলদারদের মধ্যকার অতি শালীন লোকজন জাপানী কর্তৃপক্ষকে অর্থের বিনিময়ে ভ্যাজাইনাল সেক্স করার ব্যবস্থাটি বেআইনী ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছিল। সেই নিষেধাজ্ঞা শেষাবধি দেয়া হয় ১৯৫৮ সালে। সাম্প্রতিকালে অবশ্য জনমিতিগত ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোও পরিবর্তন ত্বরান্বিত করেছে। জাপানী জনগোষ্ঠীর প্রায় ২৮ শতাংশের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। এই অনুপাতটি বিশ্বের সর্বোচ্চ। বুড়োরা দীর্ঘদিন সুস্থ থাকছে তবে সেটা অনুগ্র ধরনের লঘুতর যৌনসেবা লাভের পর। এমন মন্তব্যটি করেছেন টোকিওর ইয়ানো রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কাটসুহিতো মাতসুশিমা। শুকান পোস্ট নামে একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সাম্প্রতিক এক সংস্করণে কিভাবে বয়স্ক লোকেরা ¯্রফে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার জন্য সোপল্যান্ডে যায়, তার বর্ণনা দেয়া আছে। ‘ডেলিভারি হেলথ’ ব্যবসার এক মালিক, যার প্রতিষ্ঠানটির কাজ হচ্ছে হিরোশিমায় বাড়িতে ও হোটেলে মেয়েদের আনা-নেয়া করা, তিনি জানিয়েছেন যে, আগে তার প্রধান খদ্দের ছিল ২০ বছরের কোটার যুবকরা। এখন তাদের জায়গা দখল করে নিয়েছে বুড়োরা। যৌন সঙ্গম করার চাইতে তারা বরং তরুণীদের সান্নিধ্যে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করেন। ‘মাই জার্নি’ নামে একটি যৌন ম্যাগাজিনের সম্পাদক আকিরো ইকোমা জানিয়েছেন, আজ তার প্রকাশনার লক্ষ্য হলো প্রধানত ৫০ ও ৬০-এর কোটার পুরুষরা। ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়া ছবিগুলো অপেক্ষাকৃত শালীন। জননেন্দ্রীয়ের ছবি নেই। স্তনের ছবি থাকলেও খুব বেশি নেই। এক ছবিতে দেখানো হয়েছে ছড়ি হাতে এক বয়স্ক লোক ‘এমস পপ লাইফ’ নামে এক প্রাপ্তবয়স্ক চেনশপের একটি আউটলেটে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাকে আকৃষ্ট করার জন্য ওখানে অনেক কিছুই আছে। তার একটি দৃষ্টান্ত হলো ‘সিলবার পর্নো’, যেখানে অভিনয় করেছেন মাওরি তেজুকা। নয় বছরের ক্যারিয়ার শেষে গত বছর তিনি ৮০ বছর বয়সে অবসরে যান। একই সময় যৌনশিল্প দৈহিক পরিতৃপ্তি মেটাতে কম আগ্রহী জাপানী তরুণদের চাহিদার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। এক সময় ইয়োশিওয়ারার গণিকাদের কাছে নিজেদের কৌমার্য হারানো তরুণ জাপানীদের কাছে অতি সাধারণ ঘটনা ছিল। জাপানী ভাষায় এটাকে বলা হয় ফুদেওরশি, যার অর্থ নতুন তুলির টানে শেখা। এখন তরুণরা প্রায়শই অনির্দিষ্টকাল ধরে কৌমার্য বজায় রেখে চলে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে যে, ৪২ শতাংশ অবিবাহিত পুরুষ ও ৪৪ শতাংশ অবিবাহিতা নারী ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত কখনই কারও সঙ্গে সেক্স করেনি। ৫০ শতাংশেরও বেশি জাপানী পুুরুষ ও ৬০ শতাংশেরও বেশি জাপানী মহিলা ৩০ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে বিয়ে করে থাকে। অনেক তরুণ সেক্সকে ‘মেন্দোকুসাই’ বা ক্লান্তিকর বিষয় বলে মন্তব্য করেছেন। তরুণদের জন্য যেসব সেক্স সার্ভিস রয়েছে, সেগুলো প্রায়শই হচ্ছে নিজেদের দ্বারাই সেক্স করা। মাতসুশিমা এর নাম দিয়েছেন ‘কোয়াসি সেক্স’। স্বমেহন বা হস্তমৈথুন আরও উপভোগ্য করে তোলার সার্ভিসগুলোর ব্যাপক প্রসার ঘটছে। যেমন কিছু কিছু ওয়েসবাইট আছে সেখানে নগ্ন মেয়েদের সঙ্গে চ্যাট করা যায়। আবার কিছু ভিডিও পার্লার আছে যেখানে পুরুষরা প্রাইভেট বুথে বসে এডাল্ট ডিভিডি দেখতে পারে। কেউ কেউ অবশ্য এসব কিছুকে সেক্সের ব্যাপারে জাপানী পুরুষদের আস্থা কমে আসার লক্ষণ হিসেবে দেখেন। স্থানীয় মিডিয়ায় এমন পুরুষদের ‘হার্ভিডোর’ (তৃণভোজী প্রাণী) আখ্যা দেয়া হয়েছে, যারা স্বাধীনচেতা মেয়েদের ভয়ের চোখে দেখে। জাপানে ‘মেইড কাফে’ গুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পুরুষদের কাছে। এসব কাফেতে ফ্রিল লাগানো এপ্রোন পড়া মেয়েরা খদ্দেরদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। তারা যতœ করে মুখে খাবার তুলে খাইয়ে দেয়। কাফেগুলোতে তাই পুরুষদের ভিড় লেগেই থাকে। বাড়তি পয়সা দিলে তারা খদ্দেরের শরীরজুড়ে হাতও বুলিয়ে দেয়। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, যৌনশিল্পে আরেক প্রবণতাও পুরুষদের আস্থাবোধের অভাবের জন্য দায়ী হতে পারে। সেটা হলো তরুণীদের ফেটিশিজম। অর্থাৎ অপ্রাণীবাচক বস্তুর সান্নিধ্য বা স্পর্শ পেলে তাদের যৌনাকাক্সক্ষা জাগ্রত হয়। সেটা হতে পারে পোশাক বা পায়ের মোজা কিংবা হাতের দস্তানা। এর ফলে কিছু কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুরুষদের স্কুলগার্লের পোশাক পরা কারো সঙ্গে হেঁটে বেড়ানো কিংবা শুয়ে থাকার সুযোগ দেয়। ব্যাপারটা বৈধ, যদি সেই যৌনকর্মী বাস্তবে স্কুলগামী বয়সের মেয়ে না হয়। সেক্স শিল্পের এই বিবর্তনে অর্থনীতিবিদদেরও হয়ত একটা ভূমিকা আছে। সেই দিনগুলো গত হয়েছে, যখন ইচ্ছামাফিক খরচ করার মতো প্রচুর অর্থ জাপানীদের হাতে ছিল। ডেলিভারি-হেলথ সার্ভিসের মালিক বলেছেন, সেক্স এখন ব্যয়বহুল। ‘মেইড কাফেতে’ একবার গেলেই খরচ হয়ে যায় এক হাজার ইয়েন। তথাপি প্রচলিত সেক্স শিল্পে ভাটা পড়ার অর্থ এই নয় যে, সামগ্রিক প্রাপ্তবয়স্ক বিনোদন শিল্পে ভাটা চলছে। ইয়ানো রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, সেক্স সংক্রান্ত স্থাপনা ও সার্ভিসগুলো ২০১৪ সালে ২.১ শতাংশ বেড়েছে এবং সেক্স শপগুলোয় বিক্রি বেড়েছে ১ শতাংশের কিছু কম। যদিও জাপানের জনসংখ্যা কমছে এবং লোকের বয়স বাড়ছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ পর্নোসাইট পর্নোহার জানিয়েছে যে, জাপান হলো এই সাইটের ট্রাফিকের চতুর্থ বৃহত্তম উৎস। পর্নোহারের সম্পাদক ইকোমা মনে করেন এর কারণ অংশত হলো এই যে, এই ব্যবসাটি অন্য যে কোন দেশের চাইতে জাপানে সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। অনেক কোম্পানি এখনও স্ট্রিপ ক্লাবের সমপর্যায়ের ক্লাবগুলোতে খদ্দেরদের মনোরঞ্জন করে চলেছে। আর অনেক দোকানেই বিক্রি হচ্ছে পর্নো ম্যাগাজিন। জাপানী পুরুষরা সরাসরি যৌন সঙ্গমের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলুক আর নাই ফেলুক, সৃজনশীল বিকল্প ব্যবস্থার অভাব তাদের নেই। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×