ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

রাজীবের চলে যাওয়া সড়ক-পরিবহন বিধি লঙ্ঘন

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২২ এপ্রিল ২০১৮

রাজীবের চলে যাওয়া সড়ক-পরিবহন বিধি লঙ্ঘন

ঢাকার সরকারী তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব শুধু হাতই হারালেন না বেপরোয়া চালকের বেসামাল গতিতে প্রাণটাকেও বলি দিতে হলো শেষ অবধি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ এপ্রিল মঙ্গলবার রাজীব চিরতরে বিদায় নেন। শেষ কয়দিন তাকে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। চিকিৎকসরা সব সময়ই শঙ্কিত ছিলেন রাজীব আদৌ সুস্থ হবেন কিনা। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে সার্বক্ষণিক চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে থাকা রাজীবকে মৃত্যুর সঙ্গে অনবরত লড়াই করে শেষ কয়টা দিন কাটাতে হয়। গত ৩ এপ্রিল গাড়ি চালকের উম্মত্ততায় কাওরান বাজার সিগন্যালের মোড়ে বিআরটিসি বাসে দাঁড়ানো অবস্থায় বিপরীত দিক থেকে আসা অন্য একটি বাসের প্রচণ্ড পেষণে রাজীবের ডান হাতটি খসে পড়ে শরীর থেকে। এমন মর্মান্তিক লোমহর্ষক ঘটনা বাসযাত্রী আর পথচারীদের বিস্ময়ে, বেদনায় হতবাক করে দেয়। তারপর থেকে তার চিকিৎসার ব্যাপারে কোন ধরনের গাফিলতি করা হয়নি। চিকিৎসকরাও তাদের সাধ্যমতো সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছেন। সরকারও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার তাদের হাতে তুলে নেয়। তারপরেও শেষ রক্ষা হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণসংহার বাংলাদেশে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার মতোই চলতে থাকে। তাতে কত সম্ভাবনাময় জীবন যে অকালে ঝরে যায় সেই সংখ্যারও শেষ নেই। সড়ক পরিবহনে এমন আকস্মিক এবং অতর্কিত ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার বিষয়টিকে নিছক দুর্ঘটনার আবর্তে ফেললে তা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা যাবে না। নিয়তির দোহাই দিয়ে এমন বীভৎস ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়ারও কোন সুযোগ নেই। গণপরিবহনের চালকদের মধ্যে অকারণে, অপ্রয়োজনে সড়ক আইনবিরোধী কার্যকলাপে জনজীবনে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাতে করে মূল্যবান প্রাণটিই অসময়ের চলে যায়। তীব্র যানজটে যখন যাত্রীদের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম সেই অসহনীয় অবস্থায় পরিবহনের চালকদের গরম মাথা আরও অগ্নিশর্মা হয়। ডানে-বামে কোন দিকে না তাকিয়ে গাড়ির গতি যে পরিমাণ লাগামহীন করে বাড়ানো হয় তাতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণও থাকে না। ট্রাফিকের বেহাল অবস্থায় এবং বিপন্ন সড়ক ব্যবস্থায় গাড়ি চালকেরা কোন ধরনের আইন কানুনকে তোয়াক্কাও করে না। শুধু গাড়ির চালককে দোষ দিয়ে লাভ কি? পথচারীরা নিজেরাও কি সজাগ বা সতর্ক থাকে রাস্তা পারাপারে? গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে প্রায় আধ কিলোমিটার পর পর ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও অসংখ্য মানুষ গাড়ি চলাচলের মাঝখান দিয়ে রাস্তা পার হয়। এটাও কোনভাবেই সড়ক পরিবহন আইনের আওতায় পড়ে না। উল্টো দিকে গাড়ি চলাচল হরহামেশাই ঘটে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আরও জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। একে তো গাড়ি চালকরা গতি নির্ণয় বিধি মোতাবেক করে না, তার ওপর যদি সম্মুখে পথচারীর রাস্তা পার হবার ঘটনা ঘটে তাহলে বাসের নিয়ন্ত্রণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা ভাবাও বিবেচনা সাপেক্ষ। আর দূরপাল্লার গাড়িবহরে গতি নিয়ন্ত্রণে কোন বিধিনিষেধই মানা হয় না। কিলোমিটারপ্রতি কত গতি নির্ধারণ করা যাবে পরিবহন আইনে তা যথাযথভাবে উল্লেখ করা আছে। এখানে অবশ্য আরও একটি ব্যাপার থাকে ক্রটিপূর্ণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ গণপরিবহনের সদর্পে সড়ক-মহাসড়কে নিয়মমাফিক গতিকে লাগাম ছেড়ে দেয়া। প্রশিক্ষিত পরিবহন চালককেও আইন মতে পরীক্ষিত হতে হবে। এর অন্যথা হলে হিতে-বিপরীত অর্থাৎ দুর্ঘটনা থেকে বের হওয়া যাবে না। দক্ষ চালক, সুষ্ঠু পরিবহন আইন সর্বোপরি মূল গাড়িটিও রাস্তায় বের করার উপযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পথদুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক বেশি। কারণ হিসেবে প্রথমেই আসতে পারে উন্নতমান আর আধুনিক পরিবহনের পর্যাপ্ত অভাব। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালকের ঘাটতিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সব থেকে বেশি যেটা তা হলো, আইনকানুন না মানার অপসংস্কৃতি যা দেশের অলি-গলি থেকে আরম্ভ করে সড়ক-মহাসড়ক পর্যন্ত বিস্তৃত এবং ভয়ানকভাবে দুর্ঘটনার আবর্তে পতিত। সুষ্ঠু এবং সমন্বিত উপায়ে ট্রাফিক রীতিও মেনে চলা হয় না। ট্রাফিক ব্যবস্থার অনিয়ম সড়কের তীব্র যানজটকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। যথার্থ আইন-কানুন অনুসরণ করা যে কোন সচেতন নাগরিকের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। সময়ের চেয়ে যে জীবনের মূল্য অনেক বেশি তা সংশ্লিষ্ট সবাই স্বীকার করলেও এর জন্য যা যা করণীয় সেটুকু করার দায়ভাগ কিন্তু সিংহভাগ মানুষের থাকে না। যার নেতিবাচক প্রভাবগুলো আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়। কোন কারণ ছাড়া অথবা সামান্য কারণে সড়কে-মহাসড়কে মাত্রাতিরিক্ত যানজট শুধু মানুষকে দুঃসহ পরিস্থিতির দিকেই ঠেলে দেয় না দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরও পড়ে বিশেষ চাপ। যে পরিমাণ শ্রমঘণ্টাসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয় তার যথার্থ সম্পূরণ অন্য কিছু দিয়ে সম্ভব নয়। আর তাই সড়ক-মহাসড়কের অব্যবস্থা শুধু প্রাণঘাতীই নয় দেশের অর্থনীতির চাকাকেও নির্বিঘœ হতে বাধাগ্রস্ত করে। পথদুর্ঘটনার অন্যতম আরও একটি অব্যবস্থা রাস্তা-ঘাটের বেহাল পরিণতি। অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে যে পরিমাণ অবদান রাখে তা উল্লেখ করার মতো। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ার আনুষঙ্গিক পূর্ব শর্ত। সেই প্রেক্ষাপটে সড়ক-মহাসড়কের কারণে বরাদ্দকৃত উন্নয়ন প্রকল্প এই খাতকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে এই ধারণা করাই যায়। কিন্তু সেখানেও তৈরি করা হয় দুর্নীতির অভয়ারণ্য। প্রকল্পের অর্থে সড়ক বিনির্মাণে যে সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদান সংযোজন করা হয় সেখানেই আছে চরম অনিয়ম আর অব্যবস্থা। ভেজাল-মিশ্রিত রাস্তা তৈরির সাজসরঞ্জামের বেহাল অবস্থায় যথার্থ এবং মজবুত সড়ক নির্মাণে যে অনিয়মের সূত্রপাত সেখানেই হয়ে যায় গোড়ায় গলদ। ফলে সুষ্ঠু এবং মানসম্মত সড়কও আজ অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ। নদী এবং বৃষ্টিস্নাত বাংলায় পানির স্রোতধারার কোন সময়ই কমতি হয় না। ভারি যানবাহন এবং অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই পরিবহন কোনভাবেই সড়ক-মহাসড়কের বেহাল পরিস্থিতিকে সামাল দিতে পারে না। ফলে দুর্ঘটনাও হয়ে থাকে প্রতিদিনের বিষয়। প্রাণহানি যেমন ঘটে পাশাপাশি সারাজীবন অসহায় আর পঙ্গুত্ববরণ করেও অসংখ্য মানুষের দিন কাটাতে হয়। আরও একটি প্রয়োজনীয় প্রসঙ্গ বাদ দিলে পথ-দুর্ঘটনার অনেক চিত্রই ঢাকা পড়ে যাবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকের অযৌক্তিক নীতিমালা আইনী ব্যবস্থার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন এবং কারণে অকারণে ভাড়া বৃদ্ধির অনিয়মে যাত্রীদের শৃঙ্খলিত করে রাখা। প্রতিযোগিতায় শুধু টিকে থাকায়ই নয় লাভবান হওয়ারও অদম্য ইচ্ছে থেকে মালিকপক্ষের যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ সেটাও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাকে অনেকখানি উস্কে দেয়। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে তাড়াহুড়া করে শুধু যাত্রী উঠানো-নামানোই নয় নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি চালিয়ে কে কার আগে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাবে তারও একটি হিড়িক পড়ে যায়। যে দুর্দশার শিকারে পরিণত হয় সাধারণ যাত্রী। রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন বিআরটিসি যার ভাড়া নির্ধারণ সরকার কর্তৃক হয়। তারপরেও চালক আর সহযোগীর কারসাজিতে সেখানেও অনিয়ম করা হয়ে থাকে। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানাধীন পরিবহনে মালিক পক্ষের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা তো থাকেই। তার ওপর চালক আর হেলপারের দুর্নীতির কোপানলেও যাত্রীদের পড়তে হয়। কিন্তু যাত্রীসেবার কোন ধরনের সুব্যবস্থা সেভাবে প্রতীয়মান হয় না। আর মহিলা যাত্রীদের দুর্ভোগ তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বাসচালক ও সুপারভাইজারের দ্বারা শারীকিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়া থেকে শুরু করে হরেক রকম বিপরীত ঘটনাপ্রবাহ তো থাকেই। সব মিলিয়ে পুরো পরিবহন ব্যবস্থাই এক মহাদুর্যোগের মুখোমুখি। আর যাত্রীদের মূল্যবান প্রাণ তো সব সময়ই ঝুঁকির আবর্তে থাকে। মানুষ এবং সমাজ পরস্পরের সম্পূরক এবং সহায়ক। মানুষের উপযোগী সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারলে তার দায় সবাইকে নিতে হয়। প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাই শুধু নয় বিচার বিভাগীয় স্বচ্ছতাও বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। আর প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিক সচেতনতা সব থেকে জরুরী। একজনের স্বেচ্ছাচারী গতি নির্ণয়ে আরেক জনের মূল্যবান প্রাণ নষ্ট হবে সেটা কখনও মেনে নেয়া যায় না। এর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা শক্ত এবং জোরালো হওয়া অপরিহার্য শর্ত। দ্রুত বিচার ব্যবস্থায় অপরাধীর তাৎক্ষণিক শাস্তিও সংশ্লিষ্টদের সতর্ক আর সাবধান করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা যাতে কোন প্রতিযোগিতামূলক অপকর্মের শিকার হতে না পারে সে ব্যাপারে সবাইকে দৃষ্টি নিবন্ধ করতে হবে। যে গাড়ি চালায় তার দায় যেমন সবচেয়ে বেশি, একইভাবে আনুষঙ্গিক বিষয় ও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনা সঙ্গত। ট্রাফিক ব্যাবস্থাও উন্নত আর আধুনিক করা সময়ের দাবি। আন্তর্জাতিক সড়ক পরিবহন আইন যথার্থভাবে অনুসরণ করে প্রাণ সংহারের মতো অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত ঘটনাকে আর কোনভাবেই বাড়তে দেয়া যায় না। চলাচলের অনুপযোগী গণপরিবহন, বেহাল সড়ক ব্যবস্থা এমনকি অদক্ষ চালককেও কোন রকম সুযোগ দেয়া থেকে বিরত থাকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অন্যতম দায়বদ্ধতা। লেখক : সাংবাদিক
×