ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধাদের দেহাবশেষ

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ২২ এপ্রিল ২০১৮

মুক্তিযোদ্ধাদের দেহাবশেষ

ইতিহাসের দায়ভার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বর্তায়। সেই দায় থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ সাধ্য না হলেও এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা কম নয়। সাতচল্লিশ বছর হয়ে গেলেও ঘটনার মৃত্যু নেই। ইতিহাস হয়ে আছে ১৯৭১ সাল। বাঙালী জাতির মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা লাভের বছর। কিন্তু সেই স্বাধীনতা পাবার জন্য ত্রিশ লাখ প্রাণ বলিদান হয়েছিল। বাঙালী সশস্ত্র যুদ্ধে নেমেছিল পাক হানাদার বাহিনী থেকে দেশকে দখলমুক্ত করার জন্য। তরুণ যোদ্ধারা লড়াই করে দেশ স্বাধীন করেছে। সম্মুখ সমরে পাকিস্তানী হানাদারদের পরাজিত করেছে। অনেকে শহীদ হয়েছেন। এর মধ্যে অনেকের মরদেহ সীমান্তের ওপারে ভারতে সমাধিস্থ করা হয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর সেই সব মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পঁচাত্তর পরবর্তী রাজাকার পুনর্বাসনকারী সামরিক জান্তা শাসকরা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনা দূরে থাক, সমাধিস্থলগুলো পর্যন্ত চিহ্নিত করেনি। ফলে সেসব বিস্তৃতির অতলে চলে যায়। ২০০১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বাংলাদেশ সফরের সময় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই আলোকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপ-আঞ্চলিক কমিটি দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। ২০০৬ সালে পাকিস্তানের করাচী থেকে ফিরিয়ে আনা হয় বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ। ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর ভারত থেকে আনা হয় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের মরদেহ তাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। ভারতে চিরনিন্দ্রায় শায়িত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল খুঁজে বের করার কাজটি ব্যক্তিগত উদ্যোগে শুরু করেন বীরপ্রতীক কাজী সাজ্জাদ আলী জহির। ভারতের অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কবরস্থান পরিদর্শন করে তিন হাজার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি চিহ্নিত করেন। সাহসিকতাপূর্ণ এবং অভাবনীয় এ কাজের জন্য শেখ হাসিনার সরকার ২০১৩ সালে এই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষককে স্বাধীনতা পদক প্রদান করেন। ২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষেয়ক মন্ত্রণালয় তাকেসহ চার সদস্যের যে কমিটি গঠন করে, তারা ভারতের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন। এ বিষয়ে একমত হন যে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সমাহিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি চিহ্নিত করা হয়েছে তা পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সমাধি কিনা-তা ইতোমধ্যে ভারত সরকার পরীক্ষা করেছে। এতে দেখা গেছে; চিহ্নিত ৯৫ ভাগ কবরই বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ধর্মীয় কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে বলে মন্ত্রণালয় মনে করছে। মরদেহ শনাক্ত করতে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের সহায়তায় এসব মুক্তিযোদ্ধার হাড়গড় পরীক্ষা করে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা হবে। যাতে তাদের আত্মীয়স্বজনরা সম্মান জানাতে পারে। দুঃখজনক যে, ছয় বছর আগে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল দেহাবশেষ আনার। কিন্তু অগ্রগতি হয়নি। দু’দেশের মধ্যে কোন ‘প্রটোকল’ সই হয়নি। এমনকি দেহাবশেষ আনার বিষয়ে কোন পদক্ষেপও নেয়া হয়নি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এতগুলো দেহাবশেষ কীভাবে আনা যায় সে বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। ২০১৭ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী বলেছিলেন ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগে দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। কিন্তু কথা ও কাজে মিল পাওয়া যায় না। একাত্তরের ডিসেম্বরে হানাদার মুক্ত বাংলাদেশে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে এলেও অনেকে ফেরেননি। যারা শহীদ হয়েছে, তাদের পিতা-মাতা, স্ত্রী, সন্তানরা জানে না তাদের সন্তানের সমাধি কোথায়? নিখোঁজ যোদ্ধার জন্য পরিবারের সদস্যরা আজও পথ চেয়ে বসে থাকেন। পর্যায়ক্রমে দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার কাজটি চলতি নির্বাচনী বছরে সম্ভব হবে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী ষড়যন্ত্রের এইকালে দেহাবশেষ এনে মর্যাদার সঙ্গে সমাহিত করা ইতিহাসের দায়ভারও পূরণ করবে। জাতির জন্য এর আবেদন বিশাল।
×