ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গোলটেবিলে বক্তারা ॥ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১০ সুপারিশ

রাজধানীতে ৮৭ ভাগ বাস মিনিবাস আইন মানে না, বেপরোয়া চলে

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২২ এপ্রিল ২০১৮

রাজধানীতে ৮৭ ভাগ বাস মিনিবাস আইন মানে না, বেপরোয়া চলে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘সড়কে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা উত্তরণের উপায়’ র্শীষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এই অভিমত তুলে ধরেন। আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, রাজধানীসহ সারাদেশের গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছে। বাসে বাসে রেষারেষি করে বেপরোয়া চলাচল ও পাল্লাপাল্লির কারণেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন যাত্রীরা। যত্রতত্র বাস থামানো, রাস্তার মাঝপথে গতি কমিয়ে চলন্ত বাসে যাত্রী ওঠানামা করানো, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, যাত্রী ধরার জন্য বাসে বাসে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা, অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা ঢাকার গণপরিবহনের নিত্যদিনের চিত্র। সম্প্রতি সরকারী তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় সারাদেশ কেঁদে উঠলেও প্রতিদিন বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কে ঝরছে কমপক্ষে ৬৪টি তাজা প্রাণ। আহত ও পঙ্গুত্বের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে ১৫০-এর বেশি মানুষ। সড়ক ব্যবস্থাপনা, সড়কের শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে বলে দাবি করেন বক্তারা। সমিতির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে নিবন্ধিত ৩১ লাখ যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনিবন্ধিত, ভুয়া নম্বরধারী ও অযান্ত্রিক যান মিলে প্রায় ৫০ লাখ যানবাহন রাস্তায় চলছে। যার ৭২ শতাংশ ফিটনেস অযোগ্য। অন্যদিকে সারাদেশে ৭০ লাখ চালকের মধ্যে বিআরটিএ লাইসেন্স আছে মাত্র ১৬ লাখ চালকের। রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়া চলাচল করে। ফলে এসব বাসে দুর্ঘটনায় কারো হাত, কারো পা, কারো মাথা বা কারো জীবন পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। সংগঠনের সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ সেলের তথ্যমতে, সারাদেশে জানুয়ারি ২০১৮ থেকে ২০ এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত ১ হাজার ৭৭৯ সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৮৪১ জনের প্রাণহানিসহ ৫ হাজার ৪৭৭ আহত হয়েছেন। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন ২৮৮ জন। বিআরটিএ ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তথাকথিত সনাতন পদ্ধতিতে জরিমানা আদায়ে ব্যস্ত এমন অভিযোগ করে গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেন, ট্রাফিক পুলিশ পরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে পরিবহনে চাঁদাবাজি, টোকেনবাজি, জরিমানা আদায় ও অর্থ আত্মসাতের মহোৎসবে মেতে উঠেছে। প্রকৃত মালিক ও শ্রমিক সংগঠনকে কোনঠাসা করে সরকারের লেজুড়বৃত্তিক গুটিকয় সংগঠন এই সেক্টরের মালিক-শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণের পরিবর্তে চাঁদাবাজি, পারমিট বাণিজ্য, কর্তৃত্ব জাহির, ক্ষমতা প্রদর্শনে ব্যস্ত। রাজনৈতিক ঠিকাদাররা সরকারের কোট গায়ে দিয়ে সরকারের আপন লোক সেজে সড়কে শত শত কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়ে যেনতেনভাবে কাজ করে বিল নিয়ে লাপাত্তা হচ্ছে। অথবা রাস্তা কেটে মাসের পর মাস ফেলে রেখে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। এহেন পরিস্থিতিতে সড়কে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি আজ চরম আকার ধারণ করেছে বলে দাবি করেন বক্তারা। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আমরা এসব দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা নয় পরিকল্পিত হত্যাকা- বলতে চাই। কেননা, আমাদের সড়কে সমস্ত অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখে নৈরাজ্যকর পরিবেশে আমাদের যাতায়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। নগরীর প্রতিটি বাস-মিনিবাসের ব্যবসা মূলত চালকরা নিয়ন্ত্রণ করছে। দৈনিক চুক্তিভিত্তিক ইজারায় প্রতিটি মালিক তার বাসটি চালকের হাতে তুলে দিয়েছে। এতেই চালকরা যাত্রী ধরার জন্য বাসে বাসে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এমন পরিস্থিতিতে বাস চালাতে গিয়ে বাসের নিচে কে পড়ল বা কার হাত বা পা গেল তা দেখার সময় নেই চালকের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ১০টি সুপারিশ তুলে ধরে। দাবির মধ্যে রয়েছে নগরীতে বাসে বাসে প্রতিযোগিতা বন্ধে কোম্পানিভিত্তিক একই কালারের বাস সার্ভিস চালু করা, উন্নত বিশ্বের আদলে আমলাতন্ত্রের বাইরে এসে পেশাদারিত্ব সম্পন্ন গণপরিবহন সার্ভিস অথরিটির নামে একটি টিম গঠন করা, প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত এই টিম নগরজুড়ে গণপরিবহনের সমস্যা-সম্ভাবনা চিহ্নিত করে প্রতিদিনের সমস্যা প্রতিদিন সমাধান করে নগরীর গণপরিবহন ব্যবস্থা একটি শৃঙ্খলায় নিয়ে আসবে এবং সড়কের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করবে। গণপরিবহনের মান, যাত্রী সেবার মান, বাস টার্মিনালের পরিবেশ, যাত্রী ও গণপরিবহন সংক্রান্ত যে কোন সমস্যা তাৎক্ষণিক সমাধান করবে। ট্রাফিক পুলিশ, বিআরটিএ ও অনান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এই টিমের নির্দেশনা মানতে বাধ্য থাকবে। এই ধরনের একটি টিম জরুরীভিত্তিতে গঠন করা। এছাড়াও ট্রাফিক বিভাগের কার্যক্রম জবাবদিহিতার আওতায় আনা, চালকের হাতে দৈনিক জমাভিত্তিক বাস ইজারা দেয়া বন্ধ করা, বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা জনবান্ধব করা, আদালত পরিচালনার মাধ্যমে পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে, ট্রাফিক পুলিশের মামলার জরিমানা সরাসরি ব্যাংকে জমা দেয়ার বিধান নিশ্চিত করতে হবে, সড়কে চাঁদাবাজি, টোকেন বাণিজ্য, দখলবাজি, হকার ও অন্যদের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, রুট পারমিট ইস্যু প্রক্রিয়ায় ঢাকা মেট্রো আরটিসিতে মালিক-শ্রমিক নেতাদের পরিবর্তে পেশাদারিত্ব ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোকজন নিয়ে পুনর্গঠন করতে হবে, ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে, পরিবহনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যাত্রীসাধারণের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরা ও মত প্রকাশের স্বার্থে যাত্রী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, মানবাধিকারের অন্যতম শর্ত মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার। আমাদের সড়কে এই অধিকার অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের চাকায় পিষ্ট হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে আইনের প্রয়োগ থাকলেও আমাদের এখানে প্রকৃত পক্ষে আইনের কোন প্রয়োগ নেই। সড়ক পরিবহন সেক্টরে নতুন যে আইন করা হচ্ছে তাতে সবার মতামতের প্রতিফলন হয়নি ফলে এই সেক্টরের সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা কঠিন। তিনি প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইন বিল আকারে পাস করার আগে সবার মতামত নিয়ে সব কিছু বিচার- বিশ্লেষণ করে আইন সন্নিবেশনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি এই সেক্টরের সমস্যা সমাধানে যাত্রীসাধারণের মতামত ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে এই সেক্টরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি জানান। ডিটিসিএ’র সাবেক নির্বাহী পরিচালক গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, আমরা ইতোমধ্যে মেয়র প্রয়াত আনিসুল হকের নেতৃত্বে কাজ করে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সরকারের কাছে দায়ের করেছি। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে ঢাকা শহরের গণপরিবহনের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা দূর হবে। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্য এই সমস্যাগুলো জিইয়ে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, সড়ক পরিবহন সেক্টরের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উপায়ও বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে সরকারের কাছে দিয়েছে। তারপরও সরকার বছরের পর বছর এসব সমস্যা সমাধান না করে এই সমস্যাকে পুঁজি করে রাখা হচ্ছে। বুয়েটের অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, মাদকের হাত থেকে পরিবহন সেক্টরকে রক্ষা করা না গেলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বাড়তেই থাকবে। তিনি অবিলম্বে নৈরাজ্য বন্ধে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আইন না মানার প্রবণতাকে সড়কে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী করেন। তিনি বলেন, যারা নিহত হন শুধু তারাই মারা যান না; পুরো পরিবারটি মারা যায়। কেননা, ওই পরিবারের পরিচালক যখন মারা যান তখন পরিবারটির আর অস্তিত্ব থাকে না।
×