ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

না-ফেরার দেশে তারকা ফুটবলার মনু

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২১ এপ্রিল ২০১৮

না-ফেরার দেশে তারকা ফুটবলার মনু

রুমেল খান ॥ দেশের ফুটবলের জীর্ণশীর্ণ অবস্থা। কারুর মতে-মুমূর্ষু অবস্থা। পতনের সামনে দাঁড়িয়ে দেশের ফুটবল। আর এমন সময় মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করে হেরে গেলেন মনির হোসেন মনুও। আজকের প্রজন্ম তাকে চেনে না। কিন্তু যারা তাকে চেনে তারা জানে মনু আসলে কে, কি এবং কেমন ফুটবলার ছিলেন আশির দশকে। সেই ‘কালো চিতা’ খ্যাত মনু চলে গেলেন না ফেরার দেশে, মাত্র ৫৬ বছর বয়সেই। শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) লিভার সিরোসিসে ভুগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তুখোড় এ ফুটবলার। ওইদিনই মুগদাপাড়া স্থানীয় মসজিদে জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে মনুকে দাফন করা হয়। গত বছরের ১২ জুলাই একই হাসপাতালে একই রোগ নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মনু। সেবার চিকিৎসাধীন ছিলেন ১৪ দিন। ১৬ কেজি ওজন হারিয়েছিলেন। আর এবার হারালেন নিজের জীবনটাই। আশির দশকে দেশের ক্লাব ফুটবলে যে ক’জন তারকা ফুটবলার ছিলেন, তাদের একজন এই মনু। মোহামেডানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে বল পায়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ঢাকার ফুটবলে। খেলতেন রাইট উইঙ্গার পজিশনে। যদিও ক্যারিয়ারের শুরুতে ছিলেন স্ট্রাইকার। কিন্তু শৈশবের প্রিয় ও স্বপ্নের ক্লাব মোহামেডানের খেলার জন্য প্লেয়িং পজিশনই বদলে ফেলেন তিনি। ১৯৮৩-৮৫ টানা তিন বছর মোহামেডান লীগ জিততে পারেনি। ঠিক তখনই ১৯৮৬ সালে ১২ নম্বর জার্সিধারী মনুর কল্যাণেই শিরোপা পুনরুদ্ধার করে সাদা-কালোরা। লীগের শেষ ম্যাচে ড্র করলেই আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে, আর মোহামেডানকে চ্যাম্পিয়ন হতে হলে জিততেই হবেÑ এমন সমীকরণের কঠিন ম্যাচে মোহামেডান ২-০ গোলে আবাহনীকে হারিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। গোল করেছিলেন মনু ও ইলিয়াস (ইলিয়াসের গোলের জোগান দেন মনুই)। সেই জয়ের পর মনুকে মাথায় তুলে নেচেছিলেন মোহামেডান সমর্থকরা। সবার ভালবাসায় সিক্ত হন মনু। আর এই ভালবাসার টানেই সেবার অর্থলোভে মোহামেডান ছেড়ে যাননি মনু। এমনই ছিল তার ক্লাবপ্রেম। ১৯৮৭ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় চীনের গোয়াংডং ক্লাবের বিপক্ষে বাংলাদেশ সাদা দলের হয়ে তার আছে আরও একটি দুর্দান্ত গোল। ডি-বক্সের বাইরে থেকে তার নেয়া শটটি হঠাৎ বাঁক খেয়ে হতভম্ব করে দিয়েছিল চীনের গোলরক্ষককে। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত মোহামেডানে খেলেন (যোগ দেন ১৯৮৪ সালে)। ১৯৮৮ সালে চলে যান ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুল ক্লাবে। ইনজুরির কারণেই দীর্ঘায়িত হতে পারেনি তার ফুটবল ক্যারিয়ার। শান্তিনগর, মালিবাগ অভিযাত্রী, আরামবাগ, বিআরটিসি, সিলেট ও ঢাকা জেলার হয়ে খেলেছেন ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে। খেলোয়াড়ী জীবনে মাঠে তীব্র শূটিং পাওয়ার ছিল মনুর। করতেন চমৎকার সব মাইনাসও। ১৯৮৫ সালে প্রথম সুযোগ পান জাতীয় দলে। সেবার সাফ গেমসের দলে থাকলেও কোন ম্যাচ তাকে খেলাননি কোচ সালাউদ্দিন। মনুর জীবনের স্মরণীয় ঘটনাগুলোর একটি হচ্ছে বর্তমান বাফুফে সভাপতি কাজী মোঃ সালাউদ্দিন মনুর খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে বলেছিলেন, ‘তোকে আমি দ্বিতীয় সালাউদ্দিন বানাবো!’ ওই সময় খেলা ছেড়ে সালাউদ্দিন আবাহনীর কোচ। এছাড়াও সতীর্থ বাদল রায় এবং আব্দুস সালাম মুর্শেদী মনুকে সেই সময় বলেছিলেন, ‘তুই যদি মোহামেডান ছাড়িস, তাহলে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে যেতে হবে!’ তাদের কথায় টাকার কথা না ভেবেই মনু রয়ে যান মোহামেডানে। সারাজীবন শুধু কষ্টই করে গেলেন মনু। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। তবে জন্ম ঢাকার আরামবাগে। মাত্র চার বয়স বয়সেই হারিয়েছিলেন মা-বাবাকে। শৈশবেই দেখেছেন দারিদ্র্য। এ জন্য পড়াশোনাটাও বেশিদূর করতে পারেননি। আরামবাগে ‘কাশেমের দোকান’ বলে একটা খাবারের দোকানে অর্থের জন্য কাজও করেছেন। যাদের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে জীবনের সেরা সময়টা পার করে এসেছেন সেই তারাই খোঁজ নেয়ার সময় পাননি একসময় প্রচ- গতির কারণে ‘হরিণ’ ও ‘চিতাবাঘ’ খ্যাত মনুর! ১৯৮৭ সালের প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে মনু বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে খেলে ‘সেরা খেলোয়াড়ের’ পুরস্কারও লাভ করেছিলেন। উচ্চতা ছিল মাত্র ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। তারপরও বল পায়ে প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ভেঙ্গে ঢুকে পড়তেন অনায়াসে। তাই ঢাকার ফুটবলে তার নাম হয়ে যায় ‘কালো চিতা’। ছিলেন ‘হিট এ্যান্ড রান’ খেলোয়াড়। যতদিন খেলেছেন, ততদিন ছিলেন প্রতিপক্ষের ত্রাস। মনুর ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছে বাফুফে, মোহামেডান, সোনালী অতীত ক্লাব, মনসুর স্পোর্টিং ক্লাব, বাংলাদেশ ফুটবল সাপোর্টার্স ফোরামসহ আরও অনেক সংগঠন। শারীরিকভাবে হারিয়ে গেলেও এদেশের ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরকালই বেঁচে থাকবেন মনু।
×