ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুকুন্দ লাল আজও পায়নি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ২১ এপ্রিল ২০১৮

মুকুন্দ লাল আজও পায়নি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

‘হয়তবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না, বড় বড় মানুষের ভিড়ে, জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে, তোমাদের কথা কেউ কবে না।’ কালজয়ী এই গানের মর্মার্থ খুঁজে পাওয়া যায় ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী মুক্তিকামী অগণিত শহীদের কথা স্মরণ করে। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর অঞ্চলের ২ সহস্রাধিক মুক্তিকামী মানুষকে জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। অথচ সেদিনের আত্মোৎসর্গকারী নর-নারী সবার নাম ইতিহাসে লেখা নেই। একাত্তরে পাকি হানাদার বাহিনী এদেশীয় দালালদের ইশারায় কতজনকে হত্যা করেছে-কত মা বোনের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছে তার সঠিক সন্ধান মেলেনি আজও। সকল শহীদের তালিকাও তৈরি হয়নি পূর্ণাঙ্গভাবে। কে কখন কিভাবে শহীদ হয়েছেন তাও জানে না অনেকে। জানার বা খোঁজার প্রয়োজন বোধ করা হয়নি। এই লক্ষ শহীদের একজন মাদারীপুরের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী মুকুন্দ লাল সাহা। এই মুকুন্দ লাল সাহা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জেলার প্রথম শহীদ। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৭ বছরেও তিনি পাননি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। নামটুকুও লেখা নেই ইতিহাসের পাতায়। উপরন্তু পর্যায়ক্রমে বেদখল হয়ে গেছে শহীদ মুকুন্দ লাল সাহার বাড়িঘর সহায় সম্পত্তি। এক সময় এরা ৪ ভাই ছিলেন মাদারীপুরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক শহীদ মুকুন্দ লাল সাহা ছিলেন ৪ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় এবং চিরকুমার। তার মেজ ভাই রমনী মোহন সাহা, সেজ ভাই সুরেন্দ্র নাথ সাহা ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের নেতা এবং ছোট ভাই পরেশ নাথ সাহা ছিলেন তৎকালীন মহকুমার বনেদী ব্যবসায়ী। পরিবারের অভিভাবক মুকুন্দ লাল সাহাকে হত্যার পর স্বাধীন দেশে তাদের সকল ধন-সম্পদ একে একে গ্রাস হতে থাকে। তার মেজ ভাই রমনী মোহন সাহাকে হত্যা করা হয় স্বাধীনতার পরে। নিজ গদিতে তাকে হত্যা করে ডাকাতবেশী সন্ত্রাসীরা। এর পরেই বিশাল এই সাহা পরিবার ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। শহীদ মুকুন্দ লাল সাহার আদি বাড়ি ছিল শহরের পাশে রাস্তি ইউনিয়নের লক্ষ্মীগঞ্জে। আড়িয়াল খাঁ নদের ভাঙ্গনে সবকিছু বিলীন হয়ে যাওয়ার পর বর্তমান বিসিক শিল্প নগরীর অদূরে শ্রীনাথ সরকার লেনে বাড়ি করেন। ১৯৩৭-৩৮ সালের দিকে আবার আড়িয়াল খাঁর ভাঙ্গনের কবলে পড়েন তারা। নতুন করে ঘর বাঁধেন শহরের শান্তিনগর মিলন সিনেমা হলের কাছে। বর্তমানে শহীদ মুকুন্দ লাল সাহার একমাত্র বংশধর সুরজিৎ কুমার সাহা ও তার পরিবার বাংলাদেশে থাকলেও মাদারীপুর শহরে তাদের কোন বাড়িঘর নেই। ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল পাকিবাহিনী বিমান থেকে মাদারীপুর মুক্তিযোদ্ধাদের লিয়াজোঁ অফিস শহরের মিলন সিনেমা হল এবং আবদুল মান্নান ভূঁয়ার বাড়ি লক্ষ্য করে প্রথম গোলাবর্ষণ করে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় ওই দিন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে মাদারীপুরবাসী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটতে থাকে। ২৪ এপ্রিল স্থলপথে বিনা বাধায় হানাদার বাহিনী টেকেরহাট ফেরি পার হয়ে সদর থানার মস্তফাপুর হয়ে মাদারীপুর শহরে প্রবেশ করে। টেকেরহাট থেকে তাদের বরণ করে আনে পাকি বাহিনীর এদেশীয় দোসর কুখ্যাত পিস কমিটির নেতারা। এ সংবাদে মাদারীপুর শহরের লোকজন পালাতে শুরু করে। হানাদার বাহিনী শহরে প্রবেশ করেই প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও আওয়ামী লীগের এমপিএ আচমত আলী খান এবং মুক্তিযুদ্ধের আরেক সংগঠক সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার এমপির বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পরে তারা জেলার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র পুরান বাজারে প্রবেশ করে প্রথমেই মুকুন্দ লাল সাহাকে তার নিজ দোকানের গদিতে বসা অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে। স্বাধীনতাবিরোধীদের ইশারায় তাকে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। রক্তাক্ত অবস্থায় তার মৃতদেহ টেনেহিঁচড়ে বর্তমান রাজ্জাক হাওলাদার একাডেমির পেছনে নিয়ে মাটি চাপা দেয় তারা। এর পরে মাদারীপুর অঞ্চলজুড়ে শুরু করে ধ্বংসলীলা। -সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×