ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষার বাতিঘর সেকান্দার

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২১ এপ্রিল ২০১৮

শিক্ষার বাতিঘর সেকান্দার

কোনরকম নামটি লিখতে পারেন। বয়স ৮৫ বছর। বৈশাখে ৮৬ তে পা রাখবেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জোটেনি। কিন্তু তাতে কী! এখন তার কাছ থেকেই রয়েছে অনেক কিছু শেখার। মাত্র ৫০ শতক জমির মালিক ছিলেন। ওই জমিতেই বাড়িঘর। তার ৪০ শতক দান করেছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য। যেন নিজের আলোয় এখন গ্রামটির শতাধিক শিশুর শিক্ষার আলো জ্বালাচ্ছেন বয়োবৃদ্ধ সেকান্দার সিকদার। মানুষটির সব যেন শেখার। এখনও রাতভর ঝাঁকি জাল দিয়ে মাছ শিকার করে তা বিক্রি করেন। সংসারে যোগান দেন। দিনের একভাগ ঘুমিয়ে থাকেন। অজোপাড়াগাঁ খেচাউপাড়া গ্রামে বেড়িবাঁধের কান্ট্রি সাইটের স্লোপঘেঁষা একটি ছোট্ট ঘর আলোকিত মানুষটির। জানালেন, আশির দশকের শেষের দিকে বেসরকারী সংস্থা কারিতাস একটি সাইক্লোন শেল্টার কাম স্কুল করতে জায়গা খুঁজছিল। খ্রীস্টান সংস্থা তাই সচেতন, কিন্তু ধর্মান্ধ অবস্থাপন্ন মানুষ কেউ জায়গা দিচ্ছিল না। সংস্থার লোকজন ফেরত যাচ্ছিলেন। তখন নিজে তাদের ডেকে ৪০ শতক জমি স্কুলের নামে একদিনের মধ্যে দলিল করে দেন। সেখানে ভবন নির্মাণ করা হয়। এর পরে ওই ভবনে প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৯১ সালে একটি প্রাইমারি স্কুল। ভবনটি ফের জীর্ণদশায় পরিণত হয়। তখন নিজের ঘরের বারান্দায় ক্লাস করানোর জন্য পাঁচটি বছর ছেড়ে দিয়েছেন। শিক্ষকরা দুপুরে খেতে না পারলে খাওয়াতেন। এই মানুষটি যেন গ্রামটির শিক্ষার বাতিঘর হিসেবে কাজ করেছেন। পাঁচ ছেলের চারজনে বিয়ে করে আলাদা থাকছে। ছোট ছেলে তার সঙ্গে থাকেন। সকলের সঙ্গে রয়েছে সুসম্পর্ক। জীবনের বহুকাল কেটেছে অভাব-অনটনে। যেন গল্পের মতো। জানালেন, কলাগাছ সেদ্ধ করে খেয়েছেন। লোনা পানির কারণে এক কানি (আট বিঘা) জমিতে দুই মণ ধানও পাওয়া যায়নি। এক পট চালের সঙ্গে ১০ পট কলাই ডাল মেশানো ভাত খেতেন। তখন বয়স ১২-১৩ বছর। চার বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন। যেন জীবনযুদ্ধের সকল প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করেছেন মানুষটি। সবশেষ গেল বছর জীর্ণদশার স্কুলভবনের জায়গায় অত্যাধুনিক একটি বহুমুখী আশ্রয়কেন্দ্র কাম স্কুল ভবন করা হয়। শিক্ষার জন্য রয়েছে মানুষটি অনাবিল আগ্রহ। স্কুলের খোঁজ-খবর রাখেন নিয়মিত। কথার ফাঁকে অসুস্থ এক শিক্ষকের খবর জানতে চায় প্রধান শিক্ষক মুকুলের কাছে। যেন নিজের সন্তানের মতো ভাবেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। স্কুলটি সরকারী হয়েছে। ভাল বেতন পাচ্ছেন শিক্ষকরা। সেকান্দার সিকদার নিজে ছেলে- মেয়েদেরকে লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। কিন্তু নাতি-নাতনিদের নিয়মিত লেখাপড়া করাচ্ছেন। কেউ হাইস্কুলে। কেউ আবার প্রাইমারিতে। প্রচন্ড অতিথিপরায়ন এই বৃদ্ধ মানুষটি এখনও রাতভর মাছ ধরেন; যা ভাবলেই অবাক লাগে। গড়ে দুই-আড়াই শ’ টাকার মাছ বিক্রি করেন। তামাটে বর্ণের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে এখনও সতেজতার ছাপ ফুটে আছে। বার্ধক্য যেন ঘায়েল করতে পারেনি এখনও। সব চুলে পাক ধরেনি। দৃঢ়চেতার আলোকিত এই মানুষটি জানালেন, তিনি এখন পর্যন্ত নিরোগ। তবে হয়তোবা ১০-১২ বছর বাঁচতে পারেন। এমন ভাবনায় অকপটে বলে যাচ্ছেন। শুধু শিক্ষায় সম্পত্তির ৯০ ভাগসহ সব দিয়ে যাওয়া মানুষটির কখনও কিছু চাওয়া-পাওয়ার ছিল না। কিন্তু এখন আবদারের সুরে দাবি, তার যে কোন এক নাতিকে স্কুলের সহায়ক কিংবা নাইটগার্ডের কোন পদে চাকরি দেয়া হয়। আর কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। সময় পেলেই এখনও স্কুলের অত্যাধুনিক ভবনটিতে গিয়ে যেন শান্তির পরশ খুঁজে বেড়ান এই মানুষটি। যেন মহাতৃপ্ত মানুষ সেকান্দার সিকদার। যখন শিশুরা নিরাপদ ভবনে ক্লাস করে তখন মনপ্রাণ স্বস্তিতে পরিপূর্ণ থাকে মানুষটির। তখন তার অন্তরকে নিরন্তর সুখানুভূতি মনে করেন। শিক্ষকরাও এই মানুষটি শ্রদ্ধা করেন। বোঝেন তার মনের ভাষা। -মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া থেকে
×