ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নববর্ষের দিনলিপি

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২১ এপ্রিল ২০১৮

নববর্ষের দিনলিপি

এবারের পহেলা বৈশাখ নিয়ে সামিহা, তাসফিয়ার আনন্দের সীমা নেই। সামিহা এবার ক্লাস সিক্সে উঠেছে, আর তাসফিয়া ক্লাস টু তে। ঢাকা শহরে বৈশাখ মানেই রমনার বটমূল, মঙ্গলশোভাযাত্রা। কিন্তু ভিড়ের কারণে ঢাকায় থেকেও প্রতিবছর সেসবে অংশ নেয়া সম্ভব হয় না। এজন্য তারা এবার পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নানু বাড়ি যাচ্ছে। অনেক গল্প শুনলেও বৈশাখে কখনও গ্রামে যাওয়া হয়নি। পুরো রাস্তাজুড়ে তারা মায়ের কাছে গ্রামের বৈশাখের গল্প শুনতে শুনতে এসেছে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে গ্রামে হালখাতা হয়। বড় মেলা বসে। ছোট বেলায় তারা সবাই মিলে মেলায় যেতেন। নানা রকম খাবার খেতেন। বিভিন্ন খেলা দেখতেন। তারা নানুবাড়ি পৌঁছেই দেখল ছোট্ট তাজরি আর তনিমা আপু চলে এসেছে ওদের আগেই। তাজরি সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে আর তনিমা আপু ক্লাস নাইনে পড়ে। বাড়ির সামনেই বড় দুটো চুলা বানানো হয়েছে। রান্নার আয়োজন চলছে। বেশ কজন মিলে আটা মাখাচ্ছে। পুরি বানানো হবে। আর বড় একটা পাত্রে বুন্দিয়া ভাজা হচ্ছে। ভেজে উঠিয়েই ঢেলে দিচ্ছে চিনির রস ভর্তি আরেকটা পাত্রে। কালকে নানুর দোকানে যারা আসবে তাদের কে মিষ্টিমুখ করানোর জন্য এই আয়োজন। নানু এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। তার হাতে কিছু কার্ড। দোকানের ক্রেতাদের কে হালখাতায় আমন্ত্রণ দেয়ার জন্য কার্ডগুলো বানানো হয়েছে। নিয়মিত ক্রেতারা সারা বছরের বেচাকেনার হিসেব মিটিয়ে দেবেন বছরের প্রথম দিনে। কিছু কার্ড বিলি করতে বাকি আছে সেগুলো নিয়েই নানুভাই ব্যস্ত। বাড়ির মেয়েরা বারান্দায় বসে গল্প করছিল। সামিহা আর তাসফিয়াও গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। নানিমণি গল্প বলছেন। তারা যখন ছোট ছিলেন তখন নাকি গ্রামের সব দোকানেই হালখাতার অনুষ্ঠান হত। পুরো গ্রামে উৎসবের গন্ধ পাওয়া যেত। এখন আস্তে আস্তে সেসব প্রচলন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে তারা বংশানুক্রমে হালখাতার ধারা বহাল রেখেছেন। কৌতুহলী তাজরি জানতে চাইলো, ‘হালখাতাটা কেমন খাতা?’ নানিমণি হেসে জবাব দিলেন, ‘হিসাব রাখার খাতা। আগেকার দিনে দোকানদাররা সব হিসাব রাখতো খাতায়। কাগজে কলমে। তখন তো কম্পিউটার ছিল না। নতুন বছর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা নতুন বছরের হিসাবের জন্য নতুন খাতা খুলত। সেই উপলক্ষেই এই অনুষ্ঠান। এজন্যই এটার নাম হালখাতা।’ সামিহা খাবারের পরিমাণ জানতে চাইলে তনিমা আপু বলল, ‘প্রায় হাজারখানেক লুচি আর প্রায় আধা মণ বুন্দিয়া বানানো হচ্ছে।’ তাজরি তালি দিয়ে বলে উঠল, ‘তাহলে আমরাও কালকে দোকানে যাব পুরি খেতে।’ উপস্থিত সবাই হেসে ফেলল। নানুভাই এসে বললেন, ‘দোকানে হালখাতা শেষ করে আমরা মেলায় যাব।’ পহেলা বৈশাখের দিন সকাল বেলা সবাই সেজেগুজে নানুর সঙ্গে দোকানে গেল। অনেক রকম মানুষ চারদিকে। নানুভাই সবার সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবাই পুরি বুন্দিয়া খাচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের বাবা মার সঙ্গে এসেছে। বিকেলবেলা নানুর সঙ্গে সবাই মিলে মেলায় গেল। এত বড় মেলা দেখে তো তারা অবাক। ঢাকাতেও বড় বড় মেলা হয় কিন্তু এই মেলাটা একদম অন্যরকম। মায়ের কাছে যেমনটা শুনেছিল ঠিক তেমন। চাষের জমিতেই মেলা বসেছে। একটা নাগর দোলা বসানো হয়েছে। একটা লোক দড়ির ওপর দাঁড়িয়ে সারকাস দেখাচ্ছে। পাশেই মোরগের লড়াই হচ্ছে। আরেকপাশে একজন একটি টিয়ে পাখি নিয়ে বসে আছে। সামনে অনেক খাম। এই টিয়ে পাখি নাকি মানুষের ভাগ্য বলে দেয়। নানু সবাইকে চরকি কিনে দিলেন। সেই সঙ্গে গরম গরম জিলিপি, নলেন গুড়ের সন্দেস। তাজরি আর তাসফিয়াকে রান্নাবাটি খেলনা কিনে দিলেন। মাটির পাতিলে নকশা আঁকা। আর লোহার বানানো বঁটি আর কড়াই একদম সত্যিকারের বঁটি কড়াই এর মতো। মাটির পুতুলের পাশে সাজানো আছে ছোট ছোট টিনের আলমারি, বাক্স, খাট। কাঠের ছাঁচে রং লাগিয়ে একজন হাতে আলপনার ছাপ দিয়ে দিচ্ছে। পাশেই আরেকজন অনেক রকম চুড়ি বিক্রি করছে। বাঁশের জিনিস আর দড়ির জিনিসও বিক্রি হচ্ছে। সন্ধ্যে নামার আগেই তারা বাড়ি ফিরে এলো। কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ ঝড় শুরু হলো। তনিমা আপু বলল এটা এ বছরের প্রথম ঝড়। কালবৈশাখী ঝড়। বাতাসের তোড়ে গাছপালা সব মাটিতে আছড়ে পড়তে লাগলো। মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামবে। হঠাৎ দেখা গেল একদল ছেলেমেয়ে হৈ হৈ করতে করতে ঝড়ের মধ্যে ছুটে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে তাজরি বলল, ‘ওরা কোথায় যাচ্ছে? ওদের ভয় লাগছে না?’ নানিমণি বলল, ‘ওরা আম কুড়াতে যাচ্ছে। আমের মৌসুমে ঝড় উঠলেই গ্রামের ছেলেমেয়েরা বাগানে বাগনে ঘুরে ঘুরে আম কুড়ায়।‘ তারাও বায়না করল যে যেতে চায়। তারপর সবাই মিলে ছুটে গেল বাগানের দিকে। চারদিকে অনেক ডালপালা ভেঙ্গে পড়েছে। সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে দু’একটা আম দেখা যাচ্ছে। প্রথমবারের মতো ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াতে কুড়াতে আনন্দে তাসফিয়া বলে উঠল, ‘ঝড়ের দিনে মামার বাড়ি আম কুড়াতে সুখ..।’ ১ম বর্ষ (সম্মান), বাংলা বিভাগ, মিরপুর কলেজ অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×