ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রমজানে ৬ পণ্য টার্গেট করে সক্রিয় ভোগ্যপণ্যের সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২১ এপ্রিল ২০১৮

রমজানে ৬ পণ্য টার্গেট করে সক্রিয় ভোগ্যপণ্যের সিন্ডিকেট

এম শাহজাহান ॥ রমজান মাস সামনে রেখে ছয়টি পণ্য টার্গেট করে সক্রিয় হয়ে উঠছে ভোগ্যপণ্যের সিন্ডিকেট। পণ্যগুলো হচ্ছে-ভোজ্যতেল, মশুর ডাল, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ এবং খেজুর। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও ইতোমধ্যে প্রতিকেজি চিনিতে বেড়েছে ৫ টাকা। গত বছরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ ও খেজুর। তবে এই সময়ে কমেছে মশুর ডাল ও ছোলার দাম। সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কোন সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের ভোগপণ্যের দাম নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে। রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা টিসিবি’র মাধ্যমে সারাদেশে পণ্য বিক্রি করা হবে। জানা গেছে, রমজান মাস সামনে রেখে এ বছর বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে। এছাড়া রমজানে চাহিদা রয়েছে এমন সব পণ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে আগাম নিরাপত্তা মজুদ গড়ে তোলা হয়েছে। যা চাহিদার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যগুলোর দাম কমায় ব্যবসায়ীরা আমদানির এলসি (লেটার অব ক্রেডিট বা ঋণপত্র) খুলছেন। প্রতিদিনই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশে ঢুকছে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্য। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, রমজানে ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে ২.৫ লাখ টন, চিনি ৩ লাখ টন, ছোলা ৮০ হাজার টন, খেজুর ১৮ হাজার টন এবং পেঁয়াজ ৪ লাখ টন। এর বিপরীতে প্রতিটি পণ্যই কয়েকগুণ বেশি ইতোমধ্যে আমদানি করে মজুদ করা হয়েছে। সরকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশও (টিসিবি) শবে-বরাতের পর থেকে খোলা বাজারে তাদের বিক্রয় কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বসু জনকণ্ঠকে বলেন, এ বছর রমজানে বেশি ব্যবহার হয় এমন ছয়টি পণ্যের কোন সঙ্কট হবে না। ইতোমধ্যে এসব পণ্যের বড় অংশ আমদানি করে মজুদ করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিদিনই আমদানিকৃতপণ্য দেশে আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, রমজান সামনে রেখে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ রকম কিছু হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সরকার। রমজানে নিয়মিত বাজার মনিটরিংসহ টিসিবি’র বিক্রি কার্যক্রম চালানো হবে। ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর কোন সুযোগ থাকবে না। তথ্যমতে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম নি¤œমুখী পর্যায়ে রয়েছে। অভ্যন্তরীণ মজুদ পরিস্থিতি ভাল অবস্থায় রয়েছে। এরপরও কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। গত দু’সপ্তায় ৫ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকায়। অথচ সারা বছর চিনি বিক্রি হয়েছে ৫২-৫৫ টাকায়। একই অবস্থা খোলা সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে। প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন তেল ৩ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৮৮ টাকায়। যদিও বোতলজাত সয়াবিন ও পামওয়েলের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। এছাড়া প্রতিকেজি খেজুরে ২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১২০-৩০০ টাকায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শবে-বরাত ও রোজা সামনে রেখে এসব জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার মৌলভীবাজার, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট এবং নারায়ণগঞ্জ বন্দর কেন্দ্রিক ভোগপণ্যের ব্যবসায়ীদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র গড়ে উঠেছে। এছাড়া ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক পর্যায়েও বড় ধরনের কারসাজির কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেশের ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক, পাইকার, মজুদদার এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। ওই সময় তিনি ব্যবসায়ীদের মতামত গ্রহণের পাশাপাশি রমজানে জিনিসপত্রের দাম না বাড়ানোর জন্য হুঁশিয়ারিও দেন। তবে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যমন্ত্রীর অনুরোধ ও হুঁশিয়ারিতে কতটুকু সতর্ক হউন সেটাই দেখার বিষয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো জনকণ্ঠকে বলেন, রোজায় কারসাজি না হলে ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বাড়ার কোন সুযোগ নেই। তবে রোজা আসলেই মিল মালিকরা মিলগুলো সংস্কারের নামে চিনি সরবরাহ বন্ধ করে দেন। প্রতিবছর তাই হয়ে আসছে। এবার সংস্কারের নামে যাতে মিলগুলো বন্ধ রাখা না হয় সে ব্যাপারে সরকারী পর্যায়ে মনিটরিং করা প্রয়োজন। প্রতিবছর মিল সংস্কারের নামে সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়ানো হয়। আর এর খেসারত দিতে হয় সাধারণ ভোক্তাদের। এদিকে, এ বছর আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম নি¤œমুখী ধারায় রয়েছে। পেঁয়াজের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য গত এক মাসে প্রায় ২৪ শতাংশ কমেছে। অন্য পণ্যের দামও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ১৮ টাকা ৬৫ পয়সা থেকে ২০ টাকার মধ্যে উঠানামা করছে। একইভাবে সয়াবিন তেলের কেজিপ্রতি দাম ৬২-৬৪ টাকা, ছোলা ৪৬-৪৮ টাকা, চিনি ৩৮-৪১.৭৬ টাকা এবং খেজুরের দাম প্রতি কেজি ৭০ টাকার মধ্যে উঠানামা করছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশীয় বাজারে। বর্তমানে বাজারে খুচরা মূল্যে সয়াবিন কেজিপ্রতি ৮৫-৮৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া চিনি ৫৫-৬০ টাকা, ছোলা ৮০-৯০, খেজুর ১২০-৩০০ এবং পেঁয়াজ দেশী ৩৫-৪০ এবং আমদানি ২৫-৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীষং সংগঠন এফবিসিসিআই) সভাপতি মোঃ সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের সরবরাহ দেশজ উৎপাদন ও আমদানির দুইয়ের ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দাম উঠানামা করলে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন, এ বছর আমদানি ভাল পর্যায়ে রয়েছে। তবে রমজানে অসাধু চক্রের কারসাজি থাকে। এবার যাতে কারসাজি করার সুযোগ না পায় সেজন্য সরকারের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। রমজানে টিসিবির যতসব প্রস্তুতি ॥ আগামী রমজান মাস সামনে রেখে সারা দেশে ১৭৪-১৮০টি পয়েন্টে টিসিবি ট্রাক বসানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। যেখানে চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, সয়াবিন তেল ও খেজুর সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হবে। রাজধানী ঢাকার ২৫-৩০টি পয়েন্টে, চট্টগ্রামের ১০টি, অন্য বিভাগীয় শহরে ৫টি করে ট্রাক বসবে। এছাড়া জেলা শহরে দু’টি করে মোট ১৭৪-১৮০টি স্থানে অস্থায়ীভাবে ট্রাক বসিয়ে স্থানীয় বাজারের তুলনায় কিছুটা কম দামে পাঁচটি পণ্য বিক্রি করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন টিসিবি’র এক উর্ধতন কর্মকর্তা। রমজান উপলক্ষে পাঁচশ’ মেট্রিক টন সয়াবিন তেল, ১ হাজার ৫শ’ মেট্রিক টন ছোলা খোলা বাজারে ছাড়া হবে বলে জানা গেছে। ডাল চিনি ছোলা ও ভোজ্যতেলের আমদানি বাড়ছে ॥ রমজান সামনে রেখে এবার দেশে ছোলা, মসুর ও মটর ডাল এবং চিনি ও ভোজ্যতেলের আমদানি ও সরবরাহ বাড়ছে। প্রতিবছর রমজানের মাস চারেক আগে থেকে ছোলা, চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল ইত্যাদির আমদানি শুরু হয় বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য। কাস্টম হাউসের পরিসংখ্যান শাখার এক তথ্যে দেখা যায়, রমজান মাস সামনে রেখে গত জানুয়ারি-মার্চ সময়ে আবশ্যকীয় সব পণ্যের আমদানি বেড়েছে। এছাড়া ছোলা খেজুরসহ রমজানে চাহিদা বৃদ্ধি পায় এমন প্রয়োজনীয় সব পণ্য আমদানি হয়েছে প্রচুর। ভোজ্যতেলও আমদানি হয়েছে। গতবছর রমজানের পূর্বে যেমন আমদানি হয়েছিল এবারও হচ্ছে। এস আলম গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বিএসএম গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, আবদুল মোনেমসহ বিভিন্ন গ্রুপ রমজানের বাজার ধরতে অত্যাবশ্যকীয় বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানি করেছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রমজানে কোন পণ্যের সঙ্কট হবে না, পণ্যভেদে এবার আমদানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় তিন-চার গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এদিকে, বিদেশ থেকে আমদানি করা মসুর ডালের দাম এখন সবচেয়ে কম। প্রতিকেজি মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৬০-১১০ টাকায়। এত কম দামে মসুর ডাল এর আগে বেচাকেনা হয়নি। পাইকারি বাজারে দাম কমায় এখন খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ৬০-৬৫ টাকা দামে মোটা মসুর ডাল পাওয়া যাচ্ছে। বাজারে যখন প্রায় সব পণ্যের চড়া দাম, সেখানে মসুর ডাল ভোক্তাদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে।
×