ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এক হাতের উপার্জনেই চলছে পাঁচ জনের সংসার

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২১ এপ্রিল ২০১৮

এক হাতের উপার্জনেই চলছে পাঁচ জনের সংসার

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ এক হাত দিয়ে খেটে খাওয়া মানুষটির নাম রবিউল হোসেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও পেটের দায়ে মেকানিকের কাজ করে সংসার চালান ৪০ বছর বয়সী এই অদম্য মানুষটি। বিগত ১৫ বছর ধরে তিনি রিক্সা ও ভ্যান মেরামত করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। রাজধানীর পুরান ঢাকার নারিন্দা এলাকায় বৃদ্ধ মা, ছোট বোন, ভাগ্নি ও এক ভাতিজাকে নিয়েই তার বসবাস। রবিউলের এক হাতের উপার্জনেই চলছে তার পরিবার। তার নিজের বউ-বাচ্চা না থাকলেও ভাইয়ের ছেলেকে নিজ সন্তানের মতো করে ছোটবেলা থেকেই লালন পালনের দায়িত্ব নিয়েছেন রবিউল। মেরামতের কাজ করেই ভাতিজাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। রবিউলের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের মুড়াপাড়ায়। তার বাবা শওকত আলী ও মা বিবি ফাতেমা। রবিউলের জন্মের পরপরই তার বাবা তাদের ছেড়ে চলে যান। তারপর থেকে তিন ভাই ও তিন বোনকে বড় করার ভার পড়ে তাদের মায়ের ওপর। অভাব-অনটনের সংসারে তার মা ও বড় ভাইদের পরিশ্রমের রোজগারে সামান্য খেয়ে পরে জীবন কেটেছে। রবিউল জনকণ্ঠকে জানান, ‘আমার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আমার বাম হাত ও পা অবশ হয়ে যায়। দারিদ্র্যের কারণে মা চিকিৎসা করাতে পারেননি। তারপর থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধিতা নিয়েই আমার জীবনযুদ্ধ শুরু হয়।’ কিভাবে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হলেন রবিউল- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে অনেক অপমান ও কষ্টের শিকার হয়েছি। বড় দুই ভাইয়ের পরিবার আছে এ কারণে আমাকে তারা বোঝা ভেবে রাত-দিন খাবার খোটা দিত। নিজের আপনজনদের কাছ থেকে পাওয়া কষ্টগুলো আমার মনোবল আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। যে কারণে আমি আজ নিজের এক হাত দিয়েও উপার্জন করে খেতে পারছি। এমনকি আমার আপনজনদেরও দেখভাল করছি। শারীরিক প্রতিবন্ধিতা কিছুই না, নিজের মনোবল ও ইচ্ছাটা আসল! এরপর আমি মুড়াপাড়ার নিজ বাড়ি ছেড়ে পুরান ঢাকায় চলে আসি। রাস্তায় রাত কাটাতাম, দিনের বেলায় একটি মেকানিকের দোকানে ভ্যান-রিক্সা মেরামতের কাজ করতাম। সেখান থেকেই কাজটি শিখেছিলাম। এরপর নিজেই রাস্তার ধারে বসে এ কাজ শুরু করি। বিগত ১৫ বছর ধরে এ কাজ করেই সংসার চালাচ্ছি। এখন আর আমি কারও ওপর নির্ভরশীল না।’ রবিউলের এক হাতের উপার্জনে চলে আরও চারটি পেট। কেন বোন, ভাগ্নি ও ভাতিজার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি? মানবিকতার কারণেই তাদের ভারণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন বলে জানালেন রবিউল। তিনি বলেন, ‘আমার ভাতিজার যখন ৪০ দিন বয়স তখন তার মা তাকে ছেড়ে চলে যায়। এরপর আমার মেজো ভাই ছোট বাচ্চাটিকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। সে বাচ্চাটিকে বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আমি ভাইয়ের কাছ থেকে প্রায় জোর করেই বাচ্চাটিকে নিয়ে আসি এবং ওর দায়িত্ব নেই। বর্তমানে তার বয়স ১৯ বছর। আমি অনেক কষ্টে তাকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছি। আর আমার ছোট বোনের স্বামী তাকে ও তার সন্তানকে রেখে অন্যত্র বিয়ে করেছে। তারপর আমার বোন ছোট মেয়েকে নিয়ে আমার কাছে আশ্রয় নেয়। আমি তাদের ফেলতে পারিনি। এরপর থেকে তাদের দু’জনের দায়িত্বও আমার কাঁধে এসে পড়েছে।’ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিক্সা-ভ্যান মেরামত করে রবিউলের উপার্জন হয় ৩০০-৪০০ টাকা। এই রোজগার দিয়েই বাড়ি ভাড়াসহ মোট পাঁচ জনের সংসার চালাতে হয় রবিউলকে। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও এই মানুষটি সরকারী প্রতিবন্ধী ভাতা পান না। তিনি আক্ষেপ করে জানান, ‘শুনেছি সরকার প্রতিবন্ধীদের ভাতা দেয়। কিন্তু আমি কখনও ভাতার টাকা পাইনি। ভাতা পেলেও হয়ত কিছুটা সাহায্য হতো। অন্তত প্রতিমাসে কিছু টাকা পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার এ কাজের কোন নিশ্চয়তা নেই। মঝে মাঝে শরীর খারাপ থাকলে কাজ করতে পারি না। আর আমি কাজ না করলে সংসার চলবে না। একটা দোকান থাকলে কাজের নিরাপত্তা পেতাম। কিন্তু সাধ থাকলেও সামর্থ্য নেই বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন পরিশ্রমী এই মানুষটি। শারীরিক প্রতিবন্ধিতা তাকে জীবনের কাছে হার মানাতে পারেনি। নিজের সদিচ্ছা থাকলে মানুষ অনেক কিছুই করতে পারে তার দৃষ্টান্ত এক হাতে খেটে খাওয়া রবিউল হোসেন। তার মতো পরিশ্রমী মানুষের জন্য বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
×