ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘নজরুলের সাম্যবাদে প্রাধান্য পেয়েছে বাঁধভাঙ্গা আবেগ আর উচ্ছ্বাস’

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২১ এপ্রিল ২০১৮

 ‘নজরুলের সাম্যবাদে প্রাধান্য পেয়েছে  বাঁধভাঙ্গা আবেগ  আর উচ্ছ্বাস’

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী থেকে ॥ মানুষকেই তিনি সর্বদেশ সর্বযুগ সর্বকালের পরম-জ্ঞাতি হিসেবে মেনেছেন এবং জেনেছেন। এ প্রসঙ্গে তার সুস্পষ্ট উচ্চারণ...গাহি সাম্যের গান-মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি। নজরুলের সাম্যবাদ একান্তই হৃদয়লব্ধ বিষয়। দর্শন, তত্ত্ব আর মননশীলতার পরিবর্তে নজরুলের সাম্যবাদে মূলত প্রাধান্য পেয়েছে বাঁধভাঙ্গা আবেগ আর উচ্ছ্বাস। তবু নজরুলের কবিতায় যে সাম্যবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে, সেখানে, তার সমাজ-সচেতনতা এবং সুষম প্রতিষ্ঠার আত্যন্তিক আকাক্সক্ষা স্বতঃই প্রকাশিত। তার এই সাম্যবাদী ভাবনা বাংলা কবিতার ইতিহাসে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে, সন্দেহ নেই। একুশ শতকে নজরুল- এ স্লোগানকে সামনে রেখে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিন্তা-চেতনা, আদর্শ, দর্শন এবং তার সমস্ত সৃষ্টিকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে নীলফামারীতে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী জাতীয় নজরুল সম্মেলন-২০১৮ এর দ্বিতীয় দিন শুক্রবার “সামাজিক সাম্য ও নজরুল” বিষয়ে আলোচনায় আলোচকগণ কবি নজরুল ইসলামের পটভূমি নিয়ে এ সব কথা তুলে ধরেন। আজ শনিবার সন্ধ্যায় তিনদিনব্যাপী জাতীয় নজরুল সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিকেল চারটায় শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে নীলফামারীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আজহারুল ইসলামের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন নজরুল একাডেমির সচিব ও প্রকল্প পরিচালক আব্দুর রহিম, সম্মিলিত সংস্কৃতি জোটের আহ্বায়ক আহসান রহিম মঞ্জিম, নীলফামারী সরকারী কলেজের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, নজরুল গীতি শিল্পী অসিত কুমার ধর। আলোচকগণ বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পৃথিবীব্যাপী হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রতিবেশে বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের উজ্জ্বল আবির্ভাব। বস্তুত, তার শিল্পীমানসের শিকড় প্রোথিত ছিল নবজাগ্রত বাঙালী মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানসমৃত্তিকায়। রাজনীতি-সচেতনতা ও জনমূল-সংলগ্নতা নজরুলের শিল্পী চৈতন্যে এনেছিল নতুন মাত্রা। তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা-আন্দোলন এবং নবজাগ্রত মুসলিম মধ্যবিত্তের স্বপ্ন-সম্ভাবনা নজরুলের কবিমানসকে করে তুলেছিল আলোক উদ্ভাসিত। তাই রোমান্টিকতায় তিনি বৈষম্যমূলক ঔপনিবেশিক সমাজের পরিবর্তে কল্পনা করেছেন শোষণমুক্ত সাম্যবাদী সমাজ; অসত্য-অকল্যাণের রাহুগ্রাস থেকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছেন স্বদেশের মাটি আর মানুষকে। যুদ্ধোত্তর বিরুদ্ধ প্রতিবেশে দাঁড়িয়েও তিনি গেয়েছেন জীবনের জয়গান, উচ্চারণ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য বিদ্রোহের বাণী। কাজী নজরুল ইসলাম কখনো উচ্চারণ করেছেন বিদ্রোহের বাণী, কখনো বা গেয়েছেন সাম্যের গান। ১৯২৫ সালে ‘সাম্যবাদী’ কাব্য প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল ইসলাম সাম্যের কবি হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। তার ‘সর্বহারা’ (১৯২৬) কাব্যেও সাম্যবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটে। এ দুই কাব্যে নজরুলের সাম্যবাদী চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে,তা দর্শন-পরিশ্রুত নয় বরং একান্তই রোমান্টিক মানসপ্রবণতাজাত। ফলে বিদ্রোহের মতো নজরুলের সাম্যবাদী চিন্তাও মূলত আবেগ আর উচ্ছ্বাসের প্রকাশ। নজরুলের সাম্যবাদ প্রধানত তার নিজস্ব ভাবনাজাত-মানবতাবাদই যার মৌল ভিত্তি। মানুষের মুক্তি, নর-নারীর বৈষম্যমোচন এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি তার সাম্যবাদী চিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। কবি মানবতার জয়গানে আজীবন ছিলেন মুখর। মানুষকে ঘৃণা করা বা ছোট ভাবা নজরুল অন্যায় বলে মনে করতেন। তার সাম্যবাদে মানুষে-মানুষে কোন ভেদ নেই, তাই তিনি স্বীকার করেননি কিংবা মেনে নেননি রাজায়-প্রজায় ভেদ। মানুষকে তিনি কেবল মানুষ হিসেবেই ভেবেছেন, অন্য কোন পরিচয়ে নয়। নজরুলের সাম্যবাদে পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যেই রচিত হয় আত্মীয়তার মৈত্রী-বন্ধন। তাই পাপী-তাপী, ধনী-দরিদ্র, পতিতা-বারাঙ্গনা সকলেই কি ভেদাভেদ স্বীকার করেননি। নারী ও পুরুষকে তিনি সমান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেছেন। তাই তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন- আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোন ভেদাভেদ নাই। আলোচকরা বলেন, নজরুলের সাম্যবাদ একান্তই হৃদয়লব্ধ বিষয়। দর্শন, তত্ত্ব আর মননশীলতার পরিবর্তে নজরুলের সাম্যবাদে মূলত প্রাধান্য পেয়েছে বাঁধভাঙ্গা আবেগ আর উচ্ছ্বাস। তবু নজরুলের কবিতায় যে সাম্যবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে, সেখানে, তার সমাজ-সচেতনতা এবং সুষম প্রতিষ্ঠার আত্যন্তিক আকাক্সক্ষা স্বতঃই প্রকাশিত। তার এই সাম্যবাদী ভাবনা বাংলা কবিতার ইতিহাসে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে, সন্দেহ নেই। আলোচনা শেষে এই সম্মেলন ঘিরে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে নজরুল গীতি, নৃত্য ও কবিতা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ শেষে নজরুলের জীবন-পরিক্রমার ওপর তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এরপর সাংস্কৃতিক পর্বে শুরু হয় সমবেত কণ্ঠে গান দুটি পরিবেশন করেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের শিল্পী ও স্থানীয় শিল্পীবৃন্দ। এরপর একক গান পরিবেশ করেন সালাউদ্দিন আহমেদ ও ইয়াসমীন মুশতারী, রতনা বর্ধন, কল্পনা আনাম, হোসনে আরা লিপি, শাহানা ইসলাম ও চন্দ্রাবতী রানী। একক গান শেষে কবিতা, নৃত্য পরিবেশন করে ঢাকা ও নীলফামারীর শিল্পবৃন্দ। উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার সকালে নীলফামারী শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন কবি পৌত্রী ও কবি নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য খিলখিল কাজী।
×