ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নির্বাচনে অনিয়ম হলে আন্দোলন জোরদার করবে

গাজীপুর ও খুলনা সিটির ভোটে জিতে ঘুরে দাঁড়াতে চায় বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২১ এপ্রিল ২০১৮

গাজীপুর ও খুলনা সিটির ভোটে জিতে ঘুরে দাঁড়াতে চায় বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ আসন্ন গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয় পেতে বিএনপি মরিয়া। এজন্য ইতোমধ্যেই দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা মাঠে নেমে পড়েছেন। লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন কেন্দ্রীয় ও দুই সিটির স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে। এ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে দলের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে ২০ দফা প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এরপরও নির্বাচনে অনিয়ম হলে আন্দোলন জোরদার করবে বিএনপি। আর এ আন্দোলনের মাধ্যমেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশের দাবি আদায়ের চেষ্টা করবে। এদিকে গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের প্রচার জোরদার করতে ইতিমধ্যেই দলের স্থায়ী কমিটির দুই সদস্যকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে দেয়া হয়েছে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন আর গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে দেয়া হয়েছে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সমন্বয়কের দায়িত্ব। এ ছাড়া এ দুই সিটিতে ২০ দলীয় জোটের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়েও দু’টি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। খুলনায় জোটের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদকে এবং সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মঞ্জুর হোসেন ঈসাকে। আর গাজীপুরে ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দারকে এবং সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহদাত হোসেন সেলিমকে। এ কমিটির সঙ্গে জোটের সকল কেন্দ্রীয় নেতাকে কাজ করার কথা বলা হয়েছে। লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত তফসিল অনুসারে ১৫ মে গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত এবং ২৪ এপ্রিল প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ করা হবে। আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচার শুরু করা যাবে প্রতীক বরাদ্দের দিন থেকেই। বিএনপির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশনের কাছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমিশনের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে ১৭ এপ্রিল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে ২০ দফা প্রস্তাব পেশ করেন বিএনপির ৬ সিনিয়র নেতা। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে নির্বাচনের সাত দিন আগে সেনাবাহিনী মোতায়েন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা, গাজীপুরের পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার, দুই সিটির প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে সিটি ক্যামেরা স্থাপন, নির্বাচনে সব প্রার্থীর প্রচারণায় সমান সুযোগ দেয়া, নিজ ওয়ার্ডের কোন ভোটারকে নির্বাচনের কোন দায়িত্ব না দেয়া, নির্বাচনের আগে দুই সিটির বিএনপি নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যমূলক মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দেয়া, অভিযোগ কেন্দ্র চালু করে অভিযোগের ১২ ঘণ্টার মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা, পর্যাপ্তসংখ্যক পেশাদার পর্যবেক্ষক নিয়োগ, কোন দলীয় নেতাকর্মীদের ভোট কেন্দ্রে অবস্থান করার সুযোগ না দেয়া, ভোট কেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠককালে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে পারছেন না। তাই নির্বাচনের ওপর ভোটারদের আস্থা নেই। সেনা মোতায়েন হলে নির্বাচনে ভোটারদের আস্থা ফিরে আসবে। তারা সিটি নির্বাচনে বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সহায়তা দিতে যে সমন্বয় কমিটি গঠন হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা বলেন, বিভাগীয় কমিশনার রিটার্নিং কর্মকর্তার তুলনায় সিনিয়র। তিনি তদারকি করতে পারেন, সহায়তা নয়। এজন্য এই কমিটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা ইসির ক্ষমতাকে খর্ব করেছে। আইনের কোন ধারায় কোন এখতিয়ারে ইসি এই কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে, তা জানতে চায় বিএনপি। দুই সিটি নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে জনপ্রিয়তা যাচাই করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিজয়ী হতে চায় দলটি। ইতোমধ্যেই কেন্দ্র থেকে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের কাছে প্রচারে সরব হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে নির্বাচনী প্রচারে সক্রিয় করা হচ্ছে। মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন জোরদার করতে প্রভাবশালী শরিক দলগুলোকে কাউন্সিলর পদে ছাড় দেয়া হচ্ছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এখন কারাবন্দী থাকায় বিএনপি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবে কি নেবে না এমন জল্পনা কল্পনার মধ্যেই ৩১ জানুয়ারি গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি এ বিষয়ে নড়েচড়ে বসে। এর পর থেকে দফায় দফায় দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সর্বশেষ ২০ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি। বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় থাকা বিএনপি গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চায়। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের চ্যালেঞ্জ হিসেবে এ দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থীসহ অধিকাংশ কাউন্সিলর প্রার্থী যাতে বিজয়ী হয় সেভাবেই প্রস্তুতি জোরদার করছে। তবে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হলে এ ইস্যুতে রাজপথ উত্তপ্ত করার মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলন গতিশীল করার কৌশল নেবে বিএনপি। জানা যায়, গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজয়ের লক্ষ্যেই এবার মেয়র পদে বর্তমান মেয়রদেরই মনোনয়ন না দিয়ে নতুন প্রার্থী নির্বাচন করে বিএনপি। সে অনুসারে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে বর্তমান মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নানের জায়গায় মনোনয়ন দেয়া হয় দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হাসান উদ্দিন সরকারকে। আর খুলনা সিটি কর্পোরেশনে বর্তমান মেয়র মনিরুজ্জানকে মনোনয়ন না দিয়ে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রার্থী, দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৩ সালের ৬ জুলাই। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী বর্তমানে দলের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এ মান্নান আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ্যাডভোকেট আজমতউল্লাহ খানকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন। ওই বছরই ১৫ জুন খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেককে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি দলীয় প্রার্থী মনিরুজ্জামান। এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা আশা করব গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। সকল ভোটার যেন নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে আমরা তা চাই। দলের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই আমরা ২০ দফা প্রস্তাব দিয়েছি। এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে নির্বাচন অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। আমরা চাই নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করুক। গাজীপুর ও খুলনা সিটিতে সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে আন্দোলন জোরদার করা হবে। আর আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পতন ঘটিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায় করা হবে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আমরা বারবার নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক করেছি। এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেনি। আমরা দেখতে চাই গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হোক। তা না হলে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারের পতন ঘটানো হবে।
×