ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাগরিক সভায় বক্তাদের অভিযোগ

অপচয়, দুর্নীতির ঘাটতি মেটাতেই বারবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২১ এপ্রিল ২০১৮

অপচয়, দুর্নীতির ঘাটতি মেটাতেই বারবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অপচয়, অপব্যবহার আর দুর্নীতির ঘাটতি মেটাতেই বারবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়। শুক্রবার রাজধানীতে এক ঘরোয়া নাগরিক সভায় বক্তারা এমন অভিযোগ করেছেন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) নাগরিক কমিটি এই সভার আয়োজন করে। ভোক্তাস্বার্থ উপযোগী-পরিবেশবান্ধব এলএনজি ও এলপিজির যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের দাবিতে সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নাগরিক সভায় বক্তব্য রাখেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, অধ্যাপক এমএম আকাশ, অধ্যাপক বদরুল ইমাম, সিপিবির রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রমুখ। সার ও বিদ্যুত খাতে গ্যাস দেয়ায় লোকসান দেখিয়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম গ্রিড বিদ্যুত উৎপাদনে ২০৬ ভাগ বাড়িয়ে ৩ দশমিক ১৬ টাকা থেকে ১০ টাকা। ক্যাপটিভ বিদ্যুত উৎপাদনে ৬৬ ভাগ বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৬২ টাকা থেকে ১৬ টাকা এবং সার উৎপাদনে ৩৭২ ভাগ বাড়য়ে ২ দশমিক ৭১ টাকা থেকে ১২ দশমিক ৮০ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। শিল্পে ৯৩ ভাগ বাড়িয়ে ৭ দমশকি ৭৬ টাকা থেকে ১৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কোন যুক্তিতেই গ্যাসের মূল্যহারের এমন বৃদ্ধি ন্যায্য ও যৌক্তিক হতে পারে না। শিল্প, বাণিজ্য, পরিবহন, এমনকি আবাসিকে ব্যবহৃত গ্যাস বর্তমানে লোকসানে নেই। লাভে আছে। সে সব লাভ থেকে আসা ক্রস-সাবসিডিতে বিদ্যুত ও সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসে আর্থিক ক্ষতি সমন্বয় হয়। সে সমন্বয় হয়েও গ্যাস খাত লাভে থাকে। গ্যাস বিক্রির অর্থের প্রায় ৮০ শতাংশ এসডি-ভ্যাট, কর্পোরেট কর, সম্পদ মূল্য, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অনুদান, সাপোর্ট ফর শর্টফল তহবিলের হিস্যা- এমন সব নামে সরকার পায়। ক্রস-সাবসিডিতে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুত ও সার উৎপাদন ব্যয়বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে যে বিবেচনায়, এলএনজি মিশ্রিত গ্যাসের মূল্যহার নির্ধারণে সে বিবেচনা করা হচ্ছে না। তাছাড়া এত বেশি মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাত অর্থনীতির পক্ষে সহ্য করা সম্ভব কিনা, তাও বিবেচিত হয়নি। বর্তমানে দিন প্রতি গ্যাস সরবরাহ হয় ২ হাজার ৬৯০ মিলিয়ন ঘনফুট। মে মাস থেকে গ্রিডে দিনে এলএনজি যোগ হবে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি মিটার এলএনজি মিশ্রিত গ্যাসের বিক্রয় মূল্য গড়ে ১২ দশমিক ৯৫ টাকা। এ মূল্যহার নির্ধারণে প্রতি ঘনমিটার এলএনজির ক্রয়মূল্য (আমদানি ব্যয়) ধরা হয় ২০ দশমিক ২২ টাকা। ভোক্তাপর্যায়ে ভ্যাটসহ এলএনজির বিক্রয় মূল্যহার ২৬ দশমিক ৮২ টাকা। এসডি, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল চার্জ, জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল চার্জ ও সাপোর্ট ফর শর্টফল তহবিল চার্জ ধরা হয়নি। অথচ এলপিজির মূল্যহার ৫০ টাকা এবং সিএনজির মূল্যহার ৪০ টাকা। আবার এ মূল্যহার বাড়িয়ে ৪৮ টাকা করা হচ্ছে। এতে এলপিজির বাজার ও মুনাফা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু তাতে পরিবহন ভাড়া বাড়বে এবং সরকারের রাজস্ব কমবে। কিন্তু বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিইআরসির আইন লঙ্ঘন হলেও জ্বালানি বিভাগ এলপিজির মূল্যহার বিইআরসি কর্তৃক নির্ধারণ হতে দিচ্ছে না। গ্যাস খাতে রাজস্ব ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও গ্যাসের মূল্যহার বেড়েই চলেছে। মজুদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং সঙ্কট মোকাবেলায় গ্যাস অনুসন্ধান গুরুত্ব পাচ্ছে না। শিল্প ও আবাসিক গ্রাহককে চরম গ্যাস সঙ্কটে রাখা হচ্ছে। বিদ্যুত উৎপাদনে গ্যাস বণ্টন চরম বৈষম্যের শিকার। পরিবহন খাতে সিএনজি রেশনিং বাড়ছে। গ্যাস চুরি ও ঘুষ-দুর্নীতি বাড়ছে। অভিযোগ উঠেছে, এলএনজি ও এলপিজির বাজার সম্প্রসারণ ও মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জ্বালানি বিভাগ এমন সব কৌশল গ্রহণ করেছে। এসব চুরি, ঘুষ, দুর্নীতি, বৈষম্যে কোন প্রতিকার না করে এলএনজি আসার অজুহাতে আবারও গ্যাসের মূল্যহার গড়ে ৭৫ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। এলপিজির মূল্যহার পরিবহনে ৫০ টাকা করা হয়েছে। এলপিজি যেন সিএনজির বাজার দখলে নিতে পারে, সে-জন্য সিএনজির দাম ৪০ টাক থেকে বৃদ্ধি করে ৪৮ টাকা করা হচ্ছে। এমন মূল্যহার বৃদ্ধি অন্যায় ও গণনিপীড়নের শামিল বলে মনে করেন তিনি। অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তৃতায় সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, ছোট ছোট গোষ্ঠীর স্বার্থে মানুষের জীবন যাপনের ব্যয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বছরে দুই বার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। আবাসিক, পরিবহন ও শিল্প যে খাতেই দাম বাড়ুক তা সাধারণ মানুষের কাঁধে চাপছে। জনগণ টেকসই উন্নয়ন চায়। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা করতে চায়। আর সরকার এসবের ধারে কাছে নেই। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, সাধারণ মানুষের ব্যবহারের গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে। যা জীবন যাপনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও পরিবেশ দূষণ নৈরাজ্যের দিকে চলে যাচ্ছে। গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের ওপর জোর না দিয়ে আমদানির দিকে ঝোঁক বেশি সরকারের। যা অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, গ্যাসের দাম সঠিক করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করে ঘাটতি সমন্বয় করা সম্ভব। দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না।
×