ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আমির হোসেন

আঁধার কবলিত এক জনপদের গল্প

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ২০ এপ্রিল ২০১৮

আঁধার কবলিত এক জনপদের গল্প

কথাসাহিত্যিক নুরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের লেখা বিলডাকিনি উপন্যাসটি প্রকাশ পায় ২০১৮ সালের ভাষার মাসে। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অন্য প্রকাশ এবং প্রচ্ছদ এঁকেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ। গ্রন্থটিকে তিনি উৎসর্গ করেছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে। বিলডাকিনি আঁধার কবলিত এক জনপদের গল্প। যে গল্পে যৌন নির্যাতনের শিকার এক নারীর নিপীড়িত জীবন এবং তার অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ ও মাতৃত্ব অর্জনের আকাক্সক্ষাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ সমাজের নানা পরতের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচিত হয়েছে। আবার এ উপন্যাস শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আরেক নারীর সংগ্রামের উপাখ্যানও। উপন্যাসটির যৌন নির্যাতনের অংশটুকু ইংরেজী সাহিত্যের শেষ্ঠ উপন্যাসিক টমাস হার্ডির টেস অব দ্য ডারবারভিলসের সঙ্গে তুলনীয়। উভয় উপন্যাসেই অর্থনৈতিক আধিপত্যের কারণে সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্রটি লক্ষণীয় হয়ে উঠে। টেস অব দ্য ডারবারভিলস’এ টেস ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের জন্য কাজের সন্ধানে গিয়ে যৌন লালসার শিকার হয়ে তার খামার মালিক এ্যালেক কর্তৃক ধর্ষিত হয়। যদিও উপন্যাসের শেষাংশে টেস এ্যালেককে হত্যা করে। এবং এ খুনের দায়ে টেসের বিচার হয় ও তাকে প্রাণদ-ের আদেশ দেয়া হয়। নুরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের বিলডাকিনিতে হানুফার সহজ-সরল ভূমিহীন স্বামী আকবর বাচ্চু ম-লের বাড়িতে বছরে কামলা হিসাবে গতর খাটে। একদিকে বিলের মাঝে আকবরের নামে বরাদ্দকৃত সামান্য খাসজামি আর অন্যদিকে হানুফার হৃষ্ট-পুষ্ট শরীর ম-লকে লোভী করে তুলে। তাই ফন্দিফিকির করে ম-ল আকবরকে লাল পতাকার সদস্য বানিয়ে জেলে পাঠায়। এতে আকবরের খাসজামি ম-লের হাতে আসে। আর অন্যদিকে আকবরকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার নাম করে হানুফাকে ভোগ করার পথ খুলে যায়। হানুফা বাচ্চু ম-ল কর্তৃক প্রায় নিয়মিত ধর্ষিত হতো-যার ফলে তার স্বামী আকবর জেলে থাকার পরও সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। ম-লের রক্তচক্ষুর শাসানিতে হানুফা তার পেটের বাচ্চা নষ্ট করতে ম-লের বাড়ির কামলার সঙ্গে নৌকায় করে শহরে যায়। কিন্তু হানুফা কামলা লোকটার পরামর্শে তার পেটের বাচ্চা নষ্ট না করে নৌকায় ফিরে আসে। তখন ফেরার পথে কামলা লোকটি ম-লকে হত্যা করে বিলডাকিনির জলে ফেলে দেয়। বিলডাকিনিতে অঝোরধারায় বৃষ্টি নামে। কামলা লোকটার ভেতরও দমিত প্রাকৃত তৃষ্ণা জেগে ওঠে। সেও হানুফাকে ভোগ করে একই কায়দায়। এক্ষেত্রে মালিক-মজুর উভয়ই অবতীর্ণ হয় ধর্ষকের ভূমিকায়-হানুফা শিকার হয় তাদের যৌন লালসার। তবে ম-লকে কে বা কারা খুন করেছে তা গোপনই থেকে যায়। ম-ল মারা যাওয়ার পর তার স্থান দখল করে নেয় তার বড় মেয়ে আয়েশার স্বামী এ্যাডভোকেট ইব্রাহিম। মাওলানা আবু বকরও কম যায় না। তাদের নিপীড়নের যুপকাষ্ঠ থেকে হানুফা কোনরকমে সাময়িকভাবে রক্ষা পায় ম-লের ছোট মেয়ে বিউটি ও বারীণ মাস্টারের সাহসী ভূমিকার বদলাতে। হার্ডির টেস অব দ্য ডারবারভিলস’এ যেমন পল্লী-প্রকৃতির বিশেষত ওয়েসেক্স অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রাম ও সুখ-দুঃখের ছবি ফুঁটে উঠেছে-তেমনি নুরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের বিলডাকিনিতে নিম্নাঞ্চলের বিশেষ করে চলনবিল অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিপীড়ন-নিষ্পেষণের কাহিনী মূর্ত হয়ে উঠেছে। সামগ্রিক অর্থে এ উপন্যাস কেবল বিলডাকিনি গ্রামের গল্প নয়, এতে যেমন আকবর ও হানুফাকে নিপীড়নের মাধ্যমে সমকালীন গ্রামীণ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ ও শোষণের চালচ্চিত্র বিধৃত হয়েছে, তেমনি বিউটি ও বারীণ মাস্টারের ভূমিকার ফলে সাধারণ মানুষের জেগে উঠার সম্ভাবনার চিত্রও প্রতিফলিত হয়েছে।
×